সাজ্জাদ আলী : আজই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসখানি তৃতীয়বারের মত পড়ে শেষ করলাম। প্রথমবার যখন পড়ি তখন আমি হাইস্কুলের নিচু কাসের ছাত্র। ১৯ বছর আগে দ্বিতীয়বার পড়েছিলাম। আজ তৃতীয়বার পড়া শেষ করে মনে হচ্ছে যে, প্রথম দু’বার পড়ার সময়ে এই উপন্যাসের মর্মবার্তা বোঝার মত পরিণত ছিলাম না। ভাবছি, কোনোভাবে যদি আরও দশ বছর বেঁচে যাই এবং গোরা উপন্যাস আবারও হাতে নেই; তখনও কি বইখানির মধ্যে আমি সমাজ চিন্তার আরো কোন নতুনরূপ খুঁজে পাব? ‘গোরা’, জীবন ছোঁয়া এক নতুনের হাতছানি।
করোনা’র ভয়ে ঘরে আটকে থাকার কারণে বইখানি আবারো পড়ার দুর্লভ সুযোগটি এলো। আমার তো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যদি আর কিছু নাও লিখতেন, তবুও তিনি শুধু মাত্র এই ‘গোরা’ উপন্যাসের জন্যই বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব লাভ করতেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো বিনয়ভূষণ, গৌরমোহন, পরেশবাবু, সুচরিতা, ললিতা, হারান, আনন্দময়ী, হরিমোহিনী প্রমুখ। এই চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের অসাম্য, ব্যক্তিজীবনের দ্ব›দ্ব, ধর্মীয় সংস্কারের ব্যবহারিক দিক, দেশপ্রেম, ইংরেজ ও তাদের দেশীয় দোসরদের ভারতবাসীর প্রতি হীন-দৃষ্টিভঙ্গি, মানব প্রেমের সুখ অনুভব, ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব, নৈতিকতাবোধ, ইত্যাদি জটিল বিষয়াবলীর যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণী ও কার্যকর সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা গভীর জীবনবোধে সমৃদ্ধ।
বন্ধুরা, গোরা উপন্যাসের রিভিউ লিখতে বসিনি। আজ বলব করোনা প্যানডিমিকের সুবাদে আমাদের আপতঃ বিকশিত নান্দনিকতা নিয়ে। আজকাল লেখকদের লেখা ছাপানো, চিন্তকদের চিন্তার প্রকাশ বা শিল্পীদের পরিবেশনা ইত্যাদি সব কাজের জন্য আর প্রকাশক, আয়োজক বা ব্রডকাষ্টারদের দ্বারস্থ হতে হয় না। বিনামূল্যের টেকনোলজী আর সামাজিক প্রচার মাধ্যম হাতের মুঠোয় থাকায় এ কাজটা আমরা নিজেরাই যখন তখন সারতে পারি। যেমন ধরুণ, এই রচনাটি টরন্টো’র বাংলা কাগজের জন্য লিখছি। এটি প্রকাশের অনুপোযুক্ত বিবেচনা করে সম্পাদক হয়ত ডাষ্টবিনে ফেলবেন। কিন্তু আমি তো আর কর্তৃপক্ষের মুখাপেক্ষি নই; নিজেই তো এখন প্রকাশক। ইচ্ছা করলেই তো লেখাটি ফেসবুকে ছেপে দিতে পারি।
করোনা সৃষ্ট জীবনের এই অনাহুত অবসরে আমরা গল্প, কবিতা, গান ইত্যাদিতে ফেসবুকের পাতা ভরে তুলেছি। যার মধ্যে যতটুকু অপ্রকাশিত প্রতিভা ছিল, তা এই করোনাকালে প্রস্ফুটিত হলো। লেখক লিখে ফেললাম, গায়ক গেয়ে উঠলাম, বক্তা বলে উঠলাম, আরো কত রকমের যে প্রকাশ আমাদের! কে পড়লো, কে শুনলো বা দেখলো, তা নিয়ে অত ভাবলে তো চলে না! নিরপেক্ষ পাঠক/শ্রোতা’র মনোযোগ না পেলেও, দলভুক্ত বন্ধুশ্রেণী তো ‘সাবাস’ বলছেই! এই সংকটকালে বদ্ধ ঘরে নিজের আনন্দই আমাদের গন্তব্য।
সেদিন এক পরিচিতা অটোয়া থেকে ফোন করেছেন। বলছেন, ভাইয়া আসছে রবিবার একটা টেলিভিশন টক শো’তে কথা বলার জন্য ঘন্টাখানেক সময় চাই। নিজেকে বেশ “বিশিষ্টজন” মনে হলো।
– জিজ্ঞাসা করলাম বোনগো, সেদিনের আলোচনার বিষয় কি? আর সহ আলোচক কে বা কারা থাকছেন?
– ভাইয়া, বিষয় “করোনা প্রতিরোধে করণীয়”। আলোচক আপনি একাই, তয় সাথে একজন কন্ঠশিল্পী গাইবো, আর একজন আবৃত্তিকারও থাকবো।
আলোচনার বিষয়বস্তু শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। আমি তো সংক্রমণ রোগের বিশেষজ্ঞ নই, নিজেই তো সারাক্ষণ বিষয়টিতে পরামর্শ নেয়ায় ব্যস্ত থাকি। এমন একটি টেকনিক্যাল বিষয়ে নাগরিকদের কর্তব্য বাতলে দেবার জ্ঞান কোথায় আমার? আবার এটাও বুঝে উঠলাম না যে, এ ধরণের একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্যে গান গাওয়া আর পদ্য পড়াটা কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়? তবে আমার ভাবনা যাই হোক, অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় আয়োজকদের নিজস্ব চিন্তা তো থাকবেই। আমন্ত্রণকারিণীর কাছে আরও জানতে চাইলাম,
– কোন টেলিভিশনে কাজ করেন আপনি?
– আমারটার নাম “চ্যানেল ৭১ টেলিভিশন” ভাইয়া।
– ৭১’ টিভি অটোয়ায় স্টুডিও খুলেছে নাকি, জানি না তো?
– না না ভাইয়া আমারটা বাংলাদেশের ওই টিভি’র শাখা না, এটা অটোয়াতেই আমরা বন্ধুরা মিলে খুলছি।
– বলেন কী? কানাডায় টেলিভিশন চ্যানেল খোলার খরচ তো শত শত মিলিয়ন ডলার?
– ভাইয়া, তেমন কোনও খরচই নাই, আমরা আইপি টিভি বাক্সে (ইন্টারনেট প্রটোকল), আর ফেসবুকে লাইভ ব্রডকাষ্ট করি।
– ও তাই বলুন! টরন্টোতে আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন আপনার মতই এই কাজটি করছেন। শুনেছি তাঁদের মধ্যে অন্তত গোটাদুই নাকি একেবারে “২৪ ঘন্টার পূর্ণাঙ্গ টেলিভিশন চ্যানেল”।
– ও সব ওদের ছল-চাতুরির কথা ভাইয়া। পূর্ণাঙ্গ-টুর্ণাঙ্গ কিচ্ছু না। আমাগো মতই ওরা সারাদিন বাংলাদ্যাশের নাটক-সিনেমা দেহায়।
– কি জানি, হয়ত তাই হবে। আপনারা যে যা করে আনন্দ পান, করুন।
– আপনি তো টেলিভিশনের লোক ভাইয়া, এগুলান সবই জানেন।
তা খানিকটা জানি বটে, তবে বুঝিনা মোটেই। গত ১৬ বছর কানাডিয়ান ন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য আমি বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান নির্মাণের স্বেচ্ছা-শ্রমিক। আমাদের প্রতিষ্ঠান অ্যাপিসোডগুলো তৈরী করে, আর কানাডিয়ান টেলিভিশন স্টেশনগুলো তা ব্রডকাষ্ট করে। আজকালকার এইসব “আইপি বাক্স আর ২৪ ঘন্টা টিভি’র” ব্যাপারটা আমার ঠিক মাথায় খেলে না। তবে এ নিয়ে ভদ্রমহিলার সাথে কথা বাড়াবার কিছু নাই। তাঁর আমন্ত্রণের বিনয়ী প্রত্যাখানের উপায় খুঁজতে গিয়ে দুটো কারণে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। প্রথমতঃ বিনা খরচে এই সুন্দরী একটি টেলিভিশন প্রচার মাধ্যমের মালিক বনতে পেরেছেন। আর দ্বিতীয় কারণঃ এলোপাথাড়ি এই সব ব্রডকাষ্টের সুবাদে আমার মতো মেধাহীনও সমাজ চিন্তকের আসনে বসবার আমন্ত্রণ পাচ্ছে।
লেখাটি শেষ করার আগে ওই গোরা উপন্যাস থেকে অন্যতম একটি নৈতিক শিক্ষার কথা বলব তবে,
কোনও এক গাঁয়ের নিরন্ন মজুর শ্রেণীর ওপর ইংরেজ পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘গোরা’ হাজতবাসি হলো। থানা-হাজত থেকে তাঁকে যেন জেলে যেতে না হয় সেজন্য তাঁর আইনজীবি বন্ধুরা আদালতে জামিন আবেদনের উদ্যোগ নিলো। কিন্তু গোরা বেঁকে বসল, এমন আবেদনে তাঁর সায় নাই। প্রথমতঃ ইংরেজ ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে সে জামিন ভিক্ষা করবে না। দ্বিতীয়তঃ সহস্র প্রতিবাদী দরিদ্র ভারতীয়, যাদের আইনজীবি বন্ধু নেই; তাঁরা উকিলের খরচ জোগাড় করতে না পেরে একতরফা বিচারে জেলবাস করে থাকে। গোরাও সেই আমজনতার ভাগ্য বরণ করে জেলে ঢুকলো।
মাসাধিক কাল পরে যেদিন গোরার শাস্তির মেয়াদ শেষ হলো, সেদিন জেল গেটে তার দলের ছেলেরা সদ্য রচিত দেশাত্ববোধক গানের সুরে এবং কুন্দ ফুলের মালা গলায় পরিয়ে গোরাকে সম্বর্ধনার উদ্যোগ নিলো। এমন তামাশা দেখে গোরা তো হতবাক! তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠলো, সে ছেলেদের ধমকে বিরত রাখতে চেষ্টা নিলো। বললো, ভারতমাতার জন্য যা কর্তব্য তার বেশি তো কিছু করিনি। সে জন্য তোমরা আমাকে সম্বর্ধিত করবে কেন? এতো মাতার অপমান, আর ছেলেদের জন্যও তা তো গৌরবের নয়!
পাঠক বন্ধুরা, আমরা যারা গোরা উপন্যাসখানি পড়েও অসংগত সম্মান/সম্বর্ধনার মোহ ত্যাগ করতে পারিনি; তারা অযথাই বইখানির পাতা উল্টে সময় ক্ষেপণ করেছি।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)