অনলাইন ডেস্ক : করোনার কারণে নতুন নতুন সংকটে পড়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প। এর সমাধান করা হচ্ছে অভিনব উপায়ে। বড় প্রকল্প এগিয়ে নিতে এ উদ্যোগগুলো অনুকরণীয়।
কয়েক বছর আগে মেট্রোরেলের কাজ উদ্বোধনের আগে রাজধানীজুড়ে একটি ব্যানার লাগিয়েছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘মেট্রোরেল আসছে’। সেই ব্যানার দেখে রাজধানীবাসী নতুন এক ধরনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। দেশের প্রথম মেট্রোরেলের স্বপ্ন যেন সত্যি হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর রাস্তায় যানজটে বসে বিরক্তিকর অপেক্ষা নয়। মেট্রোরেলে চড়ে নিমেষেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবেন।
২০১২ সালে প্রকল্পের কাজ শুরুর কথা থাকলেও সেটি শুরু হয় ২০১৬ সালে। বিশ্বমানের মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য জাপানি ও থাইল্যান্ডের প্রকৌশলীরা যোগ দেন। রাজধানীবাসী তখন রাজপথে চলতে চলতে স্বপ্নের বীজ বোনেন, বিশ্বমানের আধুনিক প্রযুক্তিতে মাথার ওপরে চলবে রেলগাড়ি।
করোনা মানুষের জীবনের মতো মেট্রোরেলেরও সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। নতুন নতুন সংকট দেখা দেয় এ প্রকল্পে। আবার সমাধানের পথও খোঁজা হচ্ছে অভিনব উপায়ে। করোনা সংকটে কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় হাসপাতাল নির্মাণসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব সংকট নিরসনে অভিনব উপায়গুলো অন্য প্রকল্পের জন্যও অনুকরণীয়।
করোনার আগ পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার প্রকৌশলী, পরামর্শক, কর্মী কাজ করেন। প্রকল্পের কার্যক্রমের আটটি ভাগে বিদেশি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। দেশি ঠিকাদারেরাও সাব–কন্ট্রাক্টে কাজ করছেন। এ প্রকল্পে জাপান ও থাইল্যান্ডের প্রকৌশলী-পরামর্শকই বেশি। ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পূর্তকাজ শেষের দিকে। এখন রেলট্র্যাক বসানোর কাজ চলছে। কিন্তু আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বেশি কাজ বাকি। করোনার কারণে ছয় মাস কাজ শ্লথ হলেও তা পুষিয়ে নিতে পারবেন জাপানিরা। যেমন ভায়াড্যাক্ট লাগানোর জন্য এখন পাঁচটি ক্রেন কাজ করে। প্রয়োজনে সাতটি লাগানোর কথা জানিয়েছেন জাপানি ঠিকাদার। এক কিলোমিটার পর্যন্ত একটি ক্রেন দিয়ে কাজ করানো হয়। খরচ বিবেচনায় সাতটির বেশি লাগালে পোষাবে না ঠিকাদারের। তিনি জানান, করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিভিন্ন ধরনের অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ফিল্ড হাসপাতাল
প্রথমেই আসি, চলমান করোনা সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে। মার্চ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৬১ জন কর্মীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। তবে মেট্রোরেলের কর্মীদের কাজে যোগদানের আগে প্রথমেই করোনা পরীক্ষা করা হয়। করোনা শনাক্ত হলে কিংবা উপসর্গ থাকলে প্রকল্প এলাকায় কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনে সরকারনির্ধারিত হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। করোনাকালে কর্মীদের থাকার জন্য প্রকল্পে এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
করোনা সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে, এমন বিবেচনায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কর্মীদের জন্য দুটি ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করছে। উত্তরার পঞ্চবটী কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১৩ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং গাবতলীর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। আইসিইউ সুবিধা ছাড়া সব সুবিধাই সেখানে থাকছে। জানা গেছে, বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে ওই দুটি ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এই মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে।
কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মীদের জন্য এমন হাসপাতাল নির্মাণের নজির নেই। বড়জোর মেডিকেল সেন্টার তৈরি হয়েছে। কিন্তু করোনায় এবার মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে।
জাপানে বসে কাজের তদারকি
আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ করছে জাপানি ঠিকাদারি টেক্কেন করপোরেশন, এবি নিক্কো কগোয়ো ও সুবিটোমো মিটসুই। কিন্তু করোনার শুরুর পরপরই এ অংশের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অনেক জাপানি প্রকৌশলী নিজ দেশে ফিরে যান। অন্যদিকে করোনার শুরুতে জাপান সরকার তাদের দেশের নাগরিকদের ৩০ জুন পর্যন্ত করোনার ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ৩০ জুন পার হলেও নতুন কোনো নির্দেশনা দেয়নি জাপান সরকার। এসব কারণে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ আটকে যায়।
কয়েক দিন আগে এ সংকট নিরসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে ডিএমটিসিএল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেন মেট্রোরেলের প্রকল্পের প্রকৌশলীদের বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেওয়ার জন্য জাপান সরকারকে অনুরোধ করে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রোরেল স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। স্টেশন নির্মাণের কাজ ক্যামেরা লাগিয়ে জাপানে বসে তদারক করছেন দেশটির প্রকৌশলীরা। প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিচ্ছেন তাঁরা। যদি আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে জাপানি প্রকৌশলীরা আসতে না–ও পারেন, তাহলে বাকি কাজও একইভাবে তদারক করা হবে। ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে পরামর্শক সভা অনুষ্ঠিত হবে।
চার্টার্ড বিমানে প্রকৌশলী আনার উদ্যোগ
মেট্রোরেলের বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবা সংযোগের কাজ করছে ইতাল-থাই কোম্পানি। করোনার কারণে সব নিয়মিত ফ্লাইট বন্ধ থাকায় তাদের ২০-২৫ জন প্রকৌশলী থাইল্যান্ড থেকে আসতে পারছেন না। ফলে কাজও আটকে আছে। সম্প্রতি চার্টার্ড বিমানে করে ওই প্রকৌশলীদের ঢাকায় আনার অনুরোধ করে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কিন্তু ইতাল-থাই কর্তৃপক্ষ জানায়, একটি বড় বিমান চার্টার্ড করতে অনেক অর্থ খরচ হবে। ইতাল-থাইয়ের নিজস্ব ছয়-সাত আসনের উড়োজাহাজ আছে। নিজস্ব উড়োজাহাজে করেই তিন-চার দফায় ব্যাংকক থেকে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৌশলীদের আনতে চায়। এতে রাজি হয় ডিএমটিসিএল। এখন ডিএমটিসিএল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে ওই ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। জানা গেছে, চলতি মাসেই ব্যাংকক থেকে প্রকৌশলীরা ঢাকা আসতে পারেন।
অগ্রগতি ৪৬%
রাজধানীর যানজট কমাতে ২০১২ সালে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। গত জুন মাস পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের ৪৬ শতাংশ কাজ এগিয়েছে। উত্তরা থেকে আগাওগাঁও পর্যন্ত ৭৪ শতাংশ এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪১ শতাংশ কাজ হয়েছে।
করোনা সংকট দীর্ঘায়িত হলে আগামী বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পটি শেষ করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চলতি বছরের এডিপিতে এ প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ প্রকল্প এ বছর বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।