অনলাইন ডেস্ক : তারন আহসান যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব আলাবামায় এমবিএ পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কথা ছিল জুনে যাবেন। কিন্তু সেটা পিছিয়ে সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়ার কথা। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি জমা দিতে বলা হয়েছে। ভর্তি ফিসহ আনুষঙ্গিক কাজে লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু তারন বুঝতে পারছেন না, তিনি যেতে পারবেন কি না, বা কীভাবে কী করবেন। করোনা মহামারিতে তারনের মতো বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও অনেকে শিক্ষার্থীই অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। বিভিন্ন দেশের নানা নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়েছেন তাঁরা।
ইউনেসকোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষার্থী দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সবচেয়ে বেশি যান মালয়েশিয়ায়। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডা, ভারত ও জাপান। এ ছাড়া অন্য দেশেও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। শিক্ষামূলক পরামর্শক সংগঠন ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের কনসালটেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফ্যাকড-ক্যাব) জানিয়েছে, বছরে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখের মতো শিক্ষার্থী তাদের বিভিন্ন এজেন্সিতে পরামর্শের জন্য যান।
গত বছরের শেষ দিকে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে। এ বছরে এসে তা মহামারি আকার ধারণ করেছে। যেসব দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যান, সেসব দেশেও করোনা ছড়িয়েছে। যেখানে প্রকোপ সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, ক্লাস চলে অনলাইনে। বাংলাদেশেও প্রতিদিন করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যেসব শিক্ষার্থীর গ্রীষ্মের সেশনে যাওয়ার কথা ছিল, তাঁরা এখন আটকা পড়েছেন।
তারন আহসান বলেন, ‘অফার লেটার পেয়েছি ফেব্রুয়ারিতে। জুনে সেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। সেটা পিছিয়ে সেপ্টেম্বরে গিয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটাও মিস হবে। এখন আমি হোপলেস অবস্থায় আছি। ইউনিভার্সিটি চাচ্ছে ওদের টিউশন ফি দিয়ে দিই। কিন্তু সেটা যদি দিয়ে দিই তাহলে কত দিনে যেতে পারব, তারপর দূতাবাস কবে খুলবে, ভিসা প্রসেসিং কীভাবে কী হবে—সব নিয়ে চিন্তায় আছি।’
গত ৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট জানিয়েছে, আসন্ন সেশনে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যায়, তবে ওই দেশে থাকা বিদেশি শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে হবে। এ ছাড়া যাঁরা নতুন শিক্ষা সেশনে ভর্তি হতে যাবেন এবং সে কার্যক্রম যদি অনলাইনে চলে, তাহলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসাও দেওয়া হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যাওয়ার কথা ধীমান গোস্বামীর। যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তে ধীমানের এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ধীমান বলেন, ‘আগস্টে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু ওই দেশের সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের পর কী করবে জানি না।’
ধীমান পড়াশোনার পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্টেন্টশিপও পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এর জন্য ওরা আমাকে পে করবে এবং আমার টিউশন ফি মওকুফ করে দিয়েছে। কিন্তু অনলাইন ক্লাস করলে তো সেই দায়িত্ব পালন সম্ভব না। আর তখন যদি আমার টিউশন ফি মওকুফ না হয়, তাহলে দেশ থেকে টাকা দিয়ে সেটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু জানায়নি।’ এ ছাড়া অনলাইনে ক্লাস করতে হলেও তা বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে কতটা সুবিধাজনক হবে, তা নিয়েও তিনি চিন্তা করছেন।
কানাডার মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউফাউন্ডল্যান্ডে স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তানভীর ইসলাম। সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। ভিসা করাতে পারছেন না। ভিসা না করালে টিউশন ফিও দিতে পারবেন না। তানভীর পড়াশোনায় বিরতি দিতে চাননি। তাই দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার ভর্তি হয়েছেন। তানভীর বলেন, ‘কবে যেতে পারব ঠিক নেই। গ্যাপ দিতে চাই না। আর ক্রেডিট ট্রান্সফারের যেহেতু সুযোগ আছে, তাই দেশেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যাব। সব ঠিক হলে তখন যাব।’
বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতির এখনো তেমন উন্নতি হয়নি। অনেক দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সীমান্ত খুলে দেওয়ায় ৫৪টি দেশের নাগরিকেরা শেনজেন ভিসার সুবিধা ভোগ করবেন। তবে ওই তালিকায় নেই বাংলাদেশ। শেনজেন ভিসার মাধ্যমে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে অবাধে যাতায়াত করা যায়। তবে করোনার আগে যাঁদের ভিসা করা আছে, তাঁরাই যেতে পারছেন যুক্তরাজ্যে। কিন্তু করোনার কারণে দূতাবাসগুলো বন্ধ। ভিসা হওয়া না-হওয়া নিয়েও তাঁদের আশঙ্কা। এ ছাড়া কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, টিউশন ফি বেড়ে যাবে কি না, সব নিয়ে ভাবতে হচ্ছে তাঁদের।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের প্রভাষক ফওজিয়া আহমেদ জানান, তাঁর দুটি স্কলারশিপ হয়েছে। একটি কমনওয়েলথ বৃত্তির অধীনে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনে। যেটা শুরু হবে সেপ্টেম্বরে। বিশ্ববিদ্যালয় জুলাইয়ের শেষে জানাবে কীভাবে শুরু করবে। আরেকটি কানাডার ম্যানিটোবায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটাও সেপ্টেম্বরে, যেখানে তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডির জন্য সুযোগ পেয়েছেন। ফওজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের কানাডার ভিসা অফিস বন্ধ। এখানে ডিসেম্বরের মধ্যে আমাকে যেতেই হবে। আর সেপ্টেম্বরে অনলাইনে ক্লাস করতে হবে। এখন বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কথা শুনছি। আমাদের দেশের পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। কানাডা সব চালু করে দিলেও বাংলাদেশের জন্য কী পদক্ষেপ নেবে, বুঝতে পারছি না।’
রবি টেন মিনিটস স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক মুনজেরিন শহীদ অক্সফোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লায়েড লিঙ্গুয়েস্টিক অ্যান্ড সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ একুইজিশন বিষয়ে মাস্টার্স পড়তে যাচ্ছেন। শেভেনিং বৃত্তিও পেয়েছেন। অক্টোবরে ক্লাস শুরু হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিসা কীভাবে হবে, জানি না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, ওই সময় পর্যন্ত হয়তো অনলাইনে ক্লাস হবে। ওরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।’
ভিসা নিয়ে আশাবাদী ব্র্যাক এডুকেশন প্রোগ্রামের ডেপুটি ম্যানেজার আসিফ বায়েজিদ। তিনি ইউরোপিয়ান কমিশন প্রদত্ত ইরাসমাস মুন্ডুস বৃত্তির দুটো প্রোগ্রামে সুযোগ পেয়েছেন। প্রথমটা অস্ট্রিয়ায়, যেটা আগস্টে শুরু হবে। আসিফ বলেন, ‘অস্ট্রিয়া এ বছর কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী অনুমতি দিচ্ছে না। এটা এক বছরের জন্য স্থগিত। আরেকটা স্পেনে, যেটা সেপ্টেম্বরে শুরু হবে। ওই সময়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হবে।’ আসিফ সময়মতো যেতে পারবেন বলে আশাবাদী। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসার ক্ষেত্রে হয়তো অন্য দেশগুলো সমস্যা করবে না।
অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের কনসালটেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফ্যাকড-ক্যাব) সভাপতি কাজী ফরিদুল হক বলেন, ‘ইউরোপসহ অনেক জায়গাতেই এখনো বিদেশি নাগরিকদের ঢোকার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি নিতে রাজি আছে। কিন্তু ওই সব দেশের সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। দূতাবাসগুলো নতুন করে ভিসা ইস্যু করছে না। এ জন্য শিক্ষার্থীরা অনেক চিন্তায় আছে।’
ফ্যাকড-ক্যাবের অধীনে যেসব এজেন্সি আছে তাদের কাছে এ বছর পরামর্শ নিতে আসা শিক্ষার্থীও অনেক কমেছে বলে জানান কাজী ফরিদুল হক। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ শিক্ষার্থী বিদেশে যাওয়ার জন্য আমাদের কাছ আসে। এ বছর এই ৬ মাসে এসেছে ২ হাজারের মতো।’