অনলাইন ডেস্ক : মহামারি করোনার কারণে সারা বিশ্ব এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রায় সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। করোনার কারণে ইতিমধ্যে দেশে পোশাক শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। কর্মহারা হয়েছেন বহু মানুষ। দেড় কোটিরও বেশি মানুষ পেশা বদলের উপায় খুঁজছেন। ইতিমধ্যে বহু মানুষ পেশা বদলের যুদ্ধে জীবিকার সন্ধানে ছুটছেন।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় ভ্যানে করে পোলাউর চাল বিক্রি করেন এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘একটা কিছু তো করে খাইতে হবে। আমরা গরিব মানুষ। বসে থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে।’ এমনিভাবে মো. আনোয়ার একটি নিবন্ধিত স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মালিক কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। বেকার এই তরুণ শিক্ষক গ্রামে গিয়ে কৃষিখামার দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
রাজধানীর মিরপুরে শিক্ষিত যুবক মিঠু। একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ করতেন হিসাব বিভাগে। তিন মাস বেতন নাই। এখন বলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ডাকবে। তাই তিনি রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি টেবিলে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গগলস প্রভৃতি বিক্রি করছেন। বনশ্রীর নরসুন্দর নওশাদ। আগে ফোন করে সকালে বা বিকালে তার দেওয়া নির্ধারিত সময়ে কাস্টমার আসত। কিন্তু এখন তার কোনো কোনো দিন ১০০ টাকাও আয় হয় না। তাই ডাক পেলে তিনি খণ্ডকালীন নানা কাজ যেমন—রাজমিস্ত্রির সহকারী প্রভৃতি কাজ করেন।
স্থানীয় কয়েকটি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী—করোনার প্রভাবে বেকার হয়েছেন ১৪ লাখ প্রবাসী শ্রমিক। প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী জুন পর্যন্ত কাজ হারিয়ে এক লাখের বেশি শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। সেই সঙ্গে ছুটিতে আসা কয়েক লাখ শ্রমিক ফিরতে পারেননি কাজে। এদেরই মতো এক জন সৌদিফেরত পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ার মো. মনির। তিনি আর বিদেশ যেতে পারবেন কি না, জানেন না। তাই দেশেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। একইভাবে আইটি খাতের শ্রমিক, ফ্রি ল্যান্সার, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিক, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের কোটিরও বেশি কর্মহীন মানুষ অন্য পেশায় প্রবেশের চেষ্টা করছেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে—করোনার কারণে শুধু বাংলাদেশে চাকরি হারানোর তালিকায় যুক্ত হতে পারে অন্তত দেড় কোটি মানুষ।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এই দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারালেও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে চার জন করে সদস্য)।’
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এমপ্লয়মেন্ট সেক্টরের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল ইসলাম সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে বলেন, ‘কর্মহীন বিশাল এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বড় অংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করত। এরা যাতে কাজ চালিয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন দোকান বা ঘর ভাড়াসহ অন্যান্য খরচের সমপরিমাণ আপদকালীন ঋণ দেওয়া যেতে পারে; যাতে তারা কর্মচ্যুত না হয়ে পড়ে; তারা যাতে নতুন করে কাজ শুরু করতে পারে। সরকারও অনেকগুলো কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এখন এই কার্যক্রম যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং কর্মহীনরা যাতে সরকারের ঘোষিত কার্যক্রমের আওতায় উপকৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ‘তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে ইত্তেফাককে আরো বলেন, ‘এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তরা হয়তো জানেনও না এরকম একটা কর্মসূচি সরকার তাদের জন্য চালু করেছে। এদেরকে বিষয়টি জানাতে হবে। কীভাবে এই কর্মসূচির আওতায় তারা আসতে পারে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। জটিলতা ছাড়াই তারা কীভাবে সহজে ও দ্রুত এই ঋণ পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা না হলে সরকারের এই কর্মসূচি পুরোপুরি সফল নাও হতে পারে।’
কর্মহীন এসব মানুষ গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনে কীভাবে সহায়ক হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে গভার্নেন্স অ্যাডভোকেসি ফোরামের চেয়ারপারসন ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘করোনা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত করেছে। আর যেহেতু অর্থনীতি অচল হয়ে গেছে সেখানে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে। প্রথমে কর্মহীন অনেককে খাদ্যসামগ্রী দিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারের চলমান কর্মসূচি আরো সম্প্রসারিত করা হবে বলে শুনেছি। এছাড়া এদের কর্মসংস্থানের জন্য ইতিমধ্যে যে প্রণোদনা ঘোষণা হয়েছে সেগুলো যাতে দ্রুত পৌঁছে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তাও নিশ্চিত করতে হবে।’ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ইত্তেফাককে আরো বলেন, ‘ঘরে ফেরা কর্মহীনদের যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে এরা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ না হয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। এটা আমরা করতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।’
দেশে বর্তমানে ৬ কোটি ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কাজ করে কৃষি খাতে। বাকি প্রায় ৪ কোটি শ্রমিক কাজ করছে শিল্প ও সেবা খাতে। এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতেই অধিকাংশ শ্রমিক কাজ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ গরিব মানুষ আছে। তাদের মধ্যে পৌনে ২ কোটি মানুষ হতদরিদ্র। বিভিন্ন সংস্থা বলছে, করোনার কারণে এ সংখ্যা ৫ কোটিরও বেশি হতে পারে।