সেরীন ফেরদৌস : করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত (মিউটেটেড) নতুন একটি রূপ নিয়ে পৃথিবীব্যাপী চাপা ভয় ছড়িয়ে পড়েছে! ইংল্যান্ডের বেশ কিছু স্থানে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ এটি আগের ভাইরাসটির চেয়ে বেশি ছোঁয়াচে! এমন নয় যে, এটি আগের ভাইরাসের চেয়ে বেশি ক্ষতি করবে! অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, আমরা এই নতুন ভাইরাসকে সত্যিই সামলাতে পারব কি না! কেউ কেউ এটিকে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির ভাইরাস নামে আখ্যায়িত করছেন। তবে বিজ্ঞানীরা এটিকে ভাইরাসের স্বাভাবিক বিবর্তন বা ‘মিউটেশন’ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন!

ভাইরাসের নতুন ধরনটি সম্পর্কে বোঝাপড়া পরিষ্কার করার জন্য ‘মিউটেশন’ কী সেটা নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। মিউটেশন কেন হয়, কীভাবে হয়? মোটামুটি সহজ করে বলতে গেলে, ভাইরাসের মিউটেশন হলো ভাইরাসটির জিনের ভেতরে যে কোডিং থাকে তার সামান্য পরিবর্তন হওয়া। এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও চলমান প্রক্রিয়া। জীবজগতের সব প্রাণী এবং মানুষের বেলায়ও এ ঘটনা ঘটে চলেছে অবিরত। এর নাম বিবর্তন। বিবর্তন প্রাকৃতিকভাবেই অবশ্যম্ভাবী। সব প্রাণী ও উদ্ভিদ জগৎ প্রতিনিয়ত এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অতীতে গিয়েছে, ভবিষ্যতেও যাবে। কারণ প্রতিটি প্রাণী তার প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়। যেভাবেই হোক টিকে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যেতে চায়! ভাইরাসও এর বাইরে নয়। ভাইরাসের বেঁচে থাকার এই লড়াইটাকেই আমরা মিউটেশন হিসেবে চিহ্নিত করি।

যেকোনো ভাইরাসেরই দুটি অংশ থাকে। বাইরে একটি প্রোটিন ঢাকনা আর ভেতরে বংশগতির ধারক ও বাহক ডিএনএ। ডিএনএ একটি জটিলভাবে প্যাঁচানো লম্বা সিঁড়ির মতো জিনিস, যা গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে আছে। এই সিঁড়ির ভেতরে জটিল বংশগতির কোডিং লেখা থাকে। সেই কোডিং অনুযায়ী ভাইরাসের বংশবিস্তার ও চেহারার পরিবর্তন ঘটে থাকে। এই ডিএনএর বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাপ নিয়ে বাইরের প্রোটিন অংশটি তৈরি করে মেসেঞ্জার আরএনএ নামে আরেকটি মলিকুল। মেসেঞ্জার আরএনএ বংশগতির এই কোডিংয়ের ছাপ নিতে গিয়ে সব সময় লম্বা ও জটিল ডিএনএর একই জায়গা থেকে নিতে পারে না। প্রতিবারই একটু এদিক-সেদিক হয়ে যায়। এই একটু এদিক-সেদিক হয়ে যাওয়ার কারণে বাইরের প্রোটিন ঢাকনাটিরও অল্পবিস্তর পরিবর্তন হতে থাকে। ফলে মানুষেরই মতো ভাইরাসের কাজেও একটু পরিবর্তন ঘটে! এই যে পরিবর্তন ঘটে, তাকেই মিউটেশন হিসেবে অভিহিত করা হয়।

একটি উদাহরণ দিলে বোঝানো হয়তো সহজ হবে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, অ্যান্টিবায়োটিক অনেক দিন ধরে খেতে নেই। তাহলে সেটি আর শরীরে কাজ করে না। কেন বলি কথাটা? অ্যান্টিবায়োটিক কী? অ্যান্টিবায়োটিক হলো ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়ার একটি অংশের ছাপ তৈরি করে সেটা মানুষের দেহে ওষুধ আকারে প্রবেশ করানো। এতে মানুষের শরীর ওই ব্যাকটেরিয়ার ছাপকে মনে করে ‘ফরেন’ বা নিজস্ব অংশ নয় এমন কোনো উপাদান। তখন স্বাভাবিক ইমিউন সিস্টেম ওকে ধ্বংস করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এখন কেউ যদি অনেক অ্যান্টিবায়োটিক খায় এবং ওষুধে যে ব্যাকটেরিয়াটি মারা যেত, সেই ব্যাকটেরিয়াটি মিউটেট করে, তাহলে ওষুধের বিপরীতে টিকে থাকার পদ্ধতি সে বের করে ফেলল। সে নিজেকে একটু পরিবর্তিত করল তার ডিএনএ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে। ডিএনএর পরিবর্তন ব্যাকটেরিয়ার বাইরের চেহারায় পরিবর্তন আনে। ব্যাস, তাহলেই ওই নির্দিষ্ট ওষুধ যেটি ব্যাকটেরিয়ার বাইরের চেহারার ছাঁচে তৈরি করা হয়েছিল, তা আর তাকে কাবু করতে পারে না! ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মিউটেশন বা পরিবর্তন যখন ঘটে, তা কখনো মৃদু হতে পারে আবার অনেকগুলো পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেলে অনেক পরে এসে নতুন একটি চেহারা পেতে পারে।

তাই যদি হয়, তাহলে দেখা যেতে পারে, মিউটেশনের ফলে কভিড-১৯ ভাইরাসের মধ্যে বড় দাগের কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না! আমরা ভয়টা ঠিক কোথায় পাচ্ছি! বিজ্ঞানী ও গবেষকরা আমাদের আশ্বস্ত করছেন, বর্তমানের মিউটেটেড ভাইরাস (ই.১.১.৭) আগের ভাইরাসের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর নয়। প্যানডেমিকের শুরুতে ভাইরাসটির আদি অবস্থা সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) থেকে ভাইরাসটির জেনেটিক কোড বেশ কয়েকবারই পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আলাদা করে কোনো ধরনের অসুবিধা তৈরি করেনি বলে তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করার দরকার পড়েনি। তবে প্রায় এক বছর আগে যে ভাইরাসটি থেকে প্যানডেমিক শুরু হয়েছে, সেই ভাইরাসটি ইতিমধ্যেই ২৩ বার তার জেনেটিক কোডিং একটু একটু করে পরিবর্তন করে এমন চেহারা নিয়েছে, যেটি অতিসহজে মানুষের শরীরে, আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে প্রবেশ করতে পারছে।

টরন্টোর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফেকশাস ডিজিজ ডিভিশনের চেয়ারম্যান ড. জেরাল্ড ইভান্স বলছেন, এই নতুন ভাইরাসটির একটি বড় মিউটেশন দেখা গেছে তার বাইরের স্পাইক প্রোটিনগুলোতে (ভাইরাসের বাইরের পায়ের মতো অংশ, যা মানুষের সেলের দেয়ালে গিয়ে খাপমতো লেগে যায়! এবং পরে সেলের ভেতরে ঢুকে পড়ে)। ভাইরাসটির এই মিউটেশনে নতুন যে স্পাইক তৈরি হয়েছে, সেগুলো আরও মসৃণভাবে মানুষের সেলের বাইরের অংশের সঙ্গে আবদ্ধ হতে পারছে এবং এ কারণেই এটি আরও দ্রæত ছড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে। তার বাইরে ভাইরাসটি মানুষের অতিরিক্ত কোনো ক্ষতি করা বা মৃত্যুঝুঁকি বাড়তে পারে এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

কানাডার আরেক ইনফেকশাস ডিজিজ বিশেষজ্ঞ ডা. লিসা ব্যারেট সিটিভি নিউজকে বলেছেন, কভিড-১৯ ভাইরাসের ঠিক কী কী মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে রোগীর শরীরে কোন কোন বাড়তি উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, সেগুলোর দিকে এবং ভ্যাকসিন তার কাজ কতটুকু করছে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন, কভিডের বর্তমান ভ্যাকসিনগুলো মিউটেটেড ভাইরাসটির ক্ষেত্রেও সমানভাবেই কাজ করবে, তবে আরও গবেষণার দরকার আছে এ নিয়ে।

এবার আসে কভিড ভ্যাকসিনের কথা। এখন পর্যন্ত কানাডা-আমেরিকা যে ভ্যাকসিনগুলোকে ব্যবহার করছে, সেগুলো তৈরি করা হয়েছে আদি কভিড ভাইরাসের মেসেঞ্জার আরএনএ মলিকুলের ছাপ নিয়ে। এই মেসেঞ্জার আরএনএ মানুষের শরীরে ঢুকে কভিড ভাইরাসের অনুকরণে স্পাইক বানাবে। সেই স্পাইককে মানুষের ইমিউন সিস্টেম বহিরাগত শত্রু মনে করবে এবং তা প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। তাহলে প্রশ্ন থাকে, মিউটেটেড কভিড ভাইরাস থেকে এই ভ্যাকসিন মানুষকে সুরক্ষা দেবে কি না! বা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের অকার্যকর হওয়ার কোনো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কি না! পাবলিক হেলথ এজেন্সি অব কানাডা স¤প্রতি এক বিবৃতিতে নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছে, মিউটেটেড ভাইরাসটির বেলায়ও ভ্যাকসিন একইভাবে কাজ করবে। কিন্তু এটি যেহেতু দ্রুততায় ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে, সে কারণেই আমাদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আমাদের জানা থাকা দরকার, ভাইরাসের এই পরিবর্তনের অর্থ কিন্তু ভাইরাসটির সম্পূর্ণ পাল্টে যাওয়া নয় বা ভাইরাসটির পুরো গঠনেরও পরিবর্তন নয়। এই বাইরের স্পাইকগুলোকে লক্ষ করে যেসব কোম্পানি ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম ভ্যাকসিন তৈরি করেছে, তাদের ভ্যাকসিনগুলো একটু বেকায়দায় পড়লে পড়তেও পারে। তবে ফাইজার ও মডার্নার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন যেহেতু ভাইরাসের মেসেঞ্জার আরএনএ-অবলম্বনে তৈরি করা হয়েছে, তা মানুষের শরীরে যে ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, তা নতুন এই ভাইরাসের আক্রমণকেও প্রতিহত করবে।
লেখক : কানাডায় কর্মরত