মুরশাদ সুবহানী : বাংলা সাহিত্যের বিশাল অঙ্গন জুড়েই রয়েছেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নিজ সৃষ্টি, দেশী-বিদেশী সাহিত্য থেকে চয়ন করে বাংলা সাহিত্যে অকাতরে দান করেছেন । বাংলা সাহিত্যকে করেছেন ঐতিহ্যমন্ডিত। বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের সার্থক রূপায়ণ হয়েছে তাঁর হাতে। উন্মোচিত করেছেন মানব জীবনের নানা দিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একদা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,
বিশ শতকের সাহিত্যের প্রধান দিক ছিল মানুষের নি:সঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্ব আর প্রেম ভালোবাসার দ্যোতনা। সাহিত্য সমালোচকদের অনেকের মতে, মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা, বিষণ্ণতা, একাকিত্ব বিশ শতকের দিকে আধুনিক রূপায়ণ হলেও এর উন্মেষ ঘটে উনিশ শতকের শেষের দিকে। যা বাংলা সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময়ের মানুষ সে সময়কাল হলো সামন্তবাদী সমাজের উত্থানকাল।
বৃটিশ ভারতে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা-পিতামহ আগে জমিদার ছিলেন না। ব্যবসা- বাণিজ্য ছিল। তাঁরা পরে জমিদারী কিনে এই পদে ভূষিত হন।
ভারত বর্ষে সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উথ্থানকালে রচিত হয়েছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-শিল্প কর্ম তাঁর সাহিত্য যে কারণে ফুটে উঠেছে নি:সঙ্গতা, মনবৈপরীত্য, নর-নারীর মধ্যে দূরত্ব, বিরহ-বেদনা, বিশ্বাস-আস্থার অভাব ও সংকট।তিনি গভীর মনোনিবেশ করে এ সবই পর্যবেক্ষণ করেছেন একজন সাহিত্য শিল্পী, কবি হিসেবেই। শুধু তাই নয়, দেখেছেন, একজন মনো বিজ্ঞানীদের মত করেও।
মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনা, মিলন-আনন্দ, আবার লোভ-লালসা, ক্রোধ-ক্ষোভ, হিংসা-ঈর্ষা-বিদ্বেষ এগুলো আছে।কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিষয়গুলির প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলেন।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে নি:সঙ্গতা,একাকিত্ব, বিচ্ছন্নতা আর ভালবাসার এক সার্থক রূপায়ণই আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করবো সল্প পরিসরে।
কবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা, গল্প, উপন্যাস-নাটক-নাটিকা, প্রবন্ধ, সঙ্গীতের সব শাখা-প্রশাখায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছেন। লিখেছেন টানা প্রায় ৬০ বছর। বহু দেশ ঘুরেছেন। অনেক গুণি মানুষের সাথে তাঁর দেখা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের জন্যে তুলে এনেছেন বলতে গেলে অমূল্য রত্ন। তাঁর গল্পে বিচ্ছিন্নতা নি:সঙ্গতা, স্বামীর প্রতি মনোযোগিতার কারণে স্ত্রীর দেবরের প্রতি মনোযোগ-প্রেম-ভালোবাসা বহুমাত্রিকভাবে উঠে এসেছে।বিভিন্নভাবে চিত্রিত করেছেন মানুষের মনো জগতের এই দিকগুলো ।
নষ্টনীড় গল্পে রবীন্দ্রনাথ চিত্রায়িত করলেন, দাম্পত্য জীবনে কিভাবে নি:সঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ঘটে সেই দিকটি।… ‘‘ভূপতির ঘরে চারুলতার মতো আধুনিক রুচিশীল স্ত্রী আছে, তবুও ভূপতির সময় হয় না চারুলতাকে সঙ্গ দেওয়ার। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে আনলেন মনোযোগিতার এক দিক। ‘ভূপতির কাজ করিবার কোনো দরকার ছিল না। তাঁহার টাকা পয়সা যথেষ্ট ছিল এবং দেশটাও গরম। এই জন্য তাঁহাকে একটা ইংরাজি খবরের কাগজ বাহির করিতে হইলো। ইহার পরে সময়ের দীর্ঘতার জন্যে তাঁহাকে আর বিলাপ করিতে হয় নাই।’ কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্ত্রীর মনের খবর নেবার চেয়ে ইংরাজি পত্রিকার সম্পাদনা এবং লাভের দিকে ভূপতির নজর ছিল।এই কারণে পরবতীতে ভূপতি একা হয়ে পড়েছে।’’
……. সময় না দেওয়ার কারণে….স্বামীর প্রতি নারী মনের যে ভালবাসা তাতে ছেদ পড়তে থাকে। এক র্পায়ে চারুলতা তার একাকীত্ব কাটাতে দেবর অমলকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। চারু সাথে দেবর অমলের প্রতি প্রেম-ভালবাসার চেয়ে একজন কমলমতি অল্প বয়সী মেয়ের বন্ধুত্ব দিকটি বড় ছিল। অন্যদিকে ভূপতির চোখ ছিল বাইরের দিকে। আশ্রিত দেবর বৌঠান (চারুকে) তাহাকে লেখাপড়া শেখাতো। চারু আগ্রহে অমল লেখা শুরু করে। অমল রেখা পাঠ করে বৌঠানকে শুনাইত। অমল লেখক আর চারু তাহার একজন গুনমুগ্ধ শ্রোতা-পাঠক। ইহা তাহাদের নিজস্ব বিষয়।চারু চায়নি অমলের লেখা আর কেউ পড়ুক।’
[কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোধ করি বিপরীতমুখী স্রোত তৈরী করেছেন এখানে। তিনি দেবর অমলকে লেখক হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, তার বৌঠানের ইচ্ছায়। চারুর মনের কোনে এই ইচ্ছাটি লুকায়িত ছিল, তাঁর স্বামী ভূপতি একজন ইংরাজী পত্রিকার সম্পাদক। তাহার লেখা সবাই পড়ে। শুধু চারুর জন্যে সেটি পাঠ করা হয় না। একজন স্ত্রী একজন নারীর মনে স্বামীর লেখা শোনার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। চারু দেখেছেন, তাঁর স্বামীর লেখা দেশ-বিদেশে হয়তো সবাই পড়ে। চারু রুচিশীল ভদ্র মহিলা হওয়া সত্বেও তাঁর বিদ্যার জোর খুব বেশি না থাকায় ভূপতি হয়তো তাকে লেখা পাঠ করে শোনাননি। দেবরের কাছে লেখাপড়া শেখার আগ্রহের জন্মও এখান থেকেই। ভূপতি শিক্ষিত জন, নিজেও ইচ্ছা করলে স্ত্রীকে লেখা পড়া শেখাতে অথবা তার জন্যে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। এই কাজ করার মত সময় তার ছিল না। যে ভদ্রলোকের নিজের স্ত্রীর প্রতি সময় দেওয়ার মত সময়টুকু ছিল না, তিনি স্ত্রীর লেখাপড়ার আগ্রহ সৃষ্টি বা করবেন কিভাবে। এটি আমার নিজস্ব মতামত]
…..কিন্তু অমল তার লেখা পত্রিকায় পাঠালে তা প্রকাশ পায়। তার খ্যাতিবারে। অমল নিজেকে একজন বিশেষ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করে। নানা জায়গা হতে তার নিমন্ত্রণ আসতে থাকে। চারু অমলের লেখা শুধু নিজের সম্পত্তি বলিয়া মনের কোনে যে বাসনা লালন করেছিল তা আর রইলো না। অমলের লেখার প্রতি চারুর আগ্রহ কমতে থাকে। এখানে দেবর –বৌঠানের মধ্যে কিছুটা দুরত্ব তৈরী হয়। বিচ্ছন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই একাকিত্ব আর বিচ্ছন্নতা আরো জোরে চেপে বসে চারুর মনে। অমল বিয়ে করে বিলেতে চলে যাওয়ার পর।’
আমার মতামত : কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নষ্টনীড় গল্পে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দুরত্ব বিচ্ছন্নতা এবং পরে আশ্রিত দেবর অমলের চরিত্রকে এনে প্রথম দিকে বৌঠানের দেবরের প্রতি টান ও মমত্ববোধ ফুটিয়ে তুললেন, সেই অমল বৌঠানের আগ্রহে লেখালেখি শুরু করে। চারু যেটাকে তার নিজের একার সম্পত্তি বলেই মনে করতো। দেবর অমলও নারী চরিত্রের এই দিকটি বুঝতে অক্ষম হয়েছে। কবি গুরু এদিকে স্বামী অপর দিকে দেবর বৌঠানের চরিত্রে মধ্যে নারী মনের ভেতরের কল্পনাকে তুলে এনেছেন সুনিপুন কৌশলে। এখানেই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ।চারুর স্বামী ভূপতি, দেবর এই তিনটি চরিত্রকে এক করে নারীর মনের প্রতি পুরুষের যে উদাসীনতা সেটি উন্মোচিত করেছেন। এই উদাসীনতা বিচ্ছন্নতা, একাকিত্বের সৃষ্টি করে সে দিকটি দেখিয়েছেন।
“……. এমন সময় পরিচিত টেলিগ্রাফের হরকরা ভূপতিকে দেখিয়া তাহার হাতে একখানা টেলিগ্রাফ লইয়া দিল। বিলেতের টেলিগ্রাফ দেখিয়া ভূপতি ভারি ভয় পাইল । ভাবিল, অমলের হয়তো অসুখ করিয়াছে।ভয়ে ভয়ে খুলিয়া দেখিল টেলিগ্রামে লেখা আছে , ‘আমি ভালো আছি।’ ইহার অর্থ কী। পরীক্ষা করিয়া ইহা প্রী-পেড টেলিগ্রামের উত্তর ।… ভূপতি বাাড় আসিয়া স্ত্রীর হাতে টেলিগ্রাম দিল। ভূপতির হাতে টেলিগ্রাম দেখিয়া চারুর মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। ভূপতি কহিল, ‘আমি এর মানে কিছুই বুঝতে পারছিনে।’ অনুসন্ধানে ভূপতি মানে বুঝিল। চারু নিজের গহনা বন্ধক রাখিয়া টাকা ধার করিয়া টেলিগ্রাফ পাঠাইয়াছিল। ভূপতি ভাবিল এত করিবার দরকার ছিল না। আমাকে একটু অনুরোধ করিয়া ধরিলেই তো আমি টেলিগ্রাফ করিয়া দিতাম..।’ ….থাকিয়া থাকিয়া ভূপতির মনে কেবলই এই প্রশ্ন হইতে লাগিল, চারু কেন এত বাড়াবাড়ি করিল। একটা অষ্পষ্ট সন্দেহ অলক্ষ্যভাবে তাহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিল।
আমাদের মতামত: এই অষ্পষ্ট সন্দেহ হতেই নষ্টনীড় গল্পের ক্লাইমেক্সের সৃষ্টি। বিচ্ছন্নতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠে। দুরত্ব বাড়তে থাকে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুরুষ মনের সন্দেহের দিকটিও তুলে ধরলেন।
‘………..ভূপতি তাহার শয়নগৃহে গিয়া দেখিল, জানালার গরাদ ধরিয়া অশ্রæহীন অনিমেষ চারু বাহিরে দিকে চাহিয়া আছে। ভূপতি তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল-কিছু বলিল না, তাহার মাথার উপরে হাত রাখিল।’ ‘বন্ধুরা ভূপতিকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ব্যাপারখানা কী। এত ব্যস্ত কেন। ভূপতি কহিল, ‘খবরের কাগজ…বন্ধু। আবার খবরের কাগজ? ভূপতি। না আর নিজে কাগজ করছি নে। বন্ধু। তবে? ভূপতি মৈশুরে একটা কাগজ বের হবে, আমাকে তারা সম্পাদক করেছে। বন্ধু। বাড়িঘর ছেড়ে একবারে মৈশুরে যাবে? চারুকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ? ভূপতি। না, মামারা এখানে এসে থাকবেন।’ বাইরের আঘাত পেয়ে ভূপতি যখন অন্ত:পুরে এসে আশ্রয় নিতে চাইল, তখন সে দেখল অন্ত:পুরের চরিত্র তার বাহিরের জীবনের থেকেও জটিল।’ ভূপতি চারুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আবার নতুনভাবে কাজে বাড়ি ছেড়ে মৈশুরে চলে যাবার প্রস্তুতি নেয়। সে চারুকে সঙ্গে নিতে চায় না চারু যেতে চাইলেও। ‘ভূপতি বুঝিল, অমলের বিচ্ছেদস্মৃতি যে বাড়িতে বেষ্টন কয়িা জ্বলিতেছে, চারু দাবানলগ্রস্ত হরিণীর মতো সে বাড়ি পরিত্যাগ করিয়া পালাইতে চায়। কিন্তু, আমার কথা সে একবার ভাবিয়া দেখিল না? আমি কোথায় পালাইব! যে স্ত্রী হৃদয়ের মধ্যে নিয়ত অন্যকে ধ্যান করিতেছে, বিদেশে গিয়াও তাহাকে ভুলিতে সময় পাইব না। ‘… যাহার অন্তরের মধ্যে মৃতভার, তাহাকে বক্ষের কাছে ধরিয়া রাখা, সে আমি কতদিন পারিব।’ ভূপতি চারুকে আসিয়া কহিল, ‘না, সে আমি পারিব না।’
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চরিত্র সমূহকে চিত্রিত করেছেন,তাদের মধ্যে নি:সঙ্গতা, বিচ্ছন্নতা, একাকী অভিমানী মন। আবার কখনও নর-নারীর মনে দ্রোহ-বিদ্রোহের রূপ তুলে ধরেছেন। একই সালে লেখা ‘শান্তি’ (শ্রাবণ ১৩০০), গল্পের চন্দরা, ‘মধ্যবর্তিনী (জ্যৈষ্ঠ ১৩০০) গল্পের হরসন্দরী। এর এক বছর পরে ‘নষ্টনীড়’ (বৈশাখ ১৩২১) গল্পের চারু (কেন্দ্রীয় চরিত্র), তার স্বামী ভূপতি এবং চারু-ভূপতির নীড়ে আশ্রিত দেবর অমল। এই গল্পের কিছু অংশ উপর আমরা আলোকপাত করেছি।
একই বছরে ‘হৈমন্তী’(জ্যৈষ্ঠ ১৩২১) গল্পের হৈমন্তী-অপু, এই বছরের মধ্যে লেখা ‘ বোষ্টমী’ (আষাঢ় ১৩২১)।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বোষ্টমী’ গল্পে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন।এই গল্পের মূল কথা হলো- আনন্দী না¤œী এক বোষ্টমী পুত্র হারা এই বোষ্টমীকে তার স্বামী সান্তনা দেয়ার জন্য তার গুরুকে অনুরোধ করেন। এক সময় আনন্দী বোষ্টমীর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে হয়ে গুরুর ইন্দ্রিয়জ মোহ। ‘ভিজা কাপড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াতে লজ্জায় একটু পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় তিনি আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন। আমি জড়োসড়ো হইয়া মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইলাম। তিনি আমার মুখের পরে দৃষ্টি রাখিয়া বলিলেন, তোমার দেহখানি সুন্দর।’ আনন্দী স্বামী ধমকেই জীবনধম বিবেচনা করে গুরু ঠাকুরের সেবাযতেœ মনোনিবেশ করেছিল। স্বামীর প্রতি ভালোবাসার পবিত্রতার কথা চিন্তা করেই ঘর এবং স্বামী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় আনন্দী।’
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ গল্পে ভূপতি স্ত্রীর জন্যে সময় দিলে বৌঠান ও দেবরের মধ্যে পরকীয়া প্রেমের সৃষ্টি হত না। প্রথম দিকে চারু দেবর অমলকে খেলার সাথী হিসেবেই গ্রহণ করে।পরে ধীরে ধীরে তা পরকীয়া প্রেমের দিকে মোড় নেয়। যদিও এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরকীয়া প্রেমের যে আবহ তৈরী করেছেন, তার মধ্যে অশ্লীলতা নেই। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, স্বামীর অমনোযোগিতা বিচ্ছন্নতা, একাতিত্বের সৃষ্টি করে। দেবর অমল আসার পর বৌঠানের সাথে ধীরে ধীরে পরকীয়া প্রেমের সৃষ্টি হয়েছে। অমলের প্রতি চারুর কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হলেও সেটা স্বামী ভূপতির চেয়ে অনেক কম। যে কারণে অমল বিয়ে করে বিলেতে চলে যাওয়ার পর চারু তাকে ভুলতে পারেনি। নারী মনের গভীরে লালন করা প্রেম সেটা হতে দেয়নি। নিজের গহনা বন্ধক রেখে বিলেতে টেলিগ্রাফ করেছে। ভূপতির হাতে যখন সেই টেলিগ্রামটি ডাক হরকরা দিয়ে যায়, দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব পড়ে ভূপতি। অন্ত:পুর ফিরে নিজ গৃহকে সেও এক শূন্যতায় দেখে। কিন্তু এই বিষয় ভূপতির মনে আসেনি তার দীর্ঘ সময়ে বাইরে সময় দেওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। সন্দেহ দেখা দেয় স্ত্রীর উপর। মনে হয় সব দোষ চারুর। তার কোন দোষ নেই। মৈশুরে যাবার আগে একবার স্ত্রী চারুর মাথায় হাত রাখে বটে। কিন্তু তাকে সাথে নিয়ে যেতে অপারগতা প্রকাশ করে । কারণ ভূপতি স্ত্রী চারু প্রতি মনস্তাত্বিক চাপ ও প্রতিশোধ নিতে চায়।ভূপতি চেয়েছে, চারু এই ‘নীড়ে ছটফট করুক দাবানলগ্রস্ত হরিণীর মত।
বোষ্টমী গল্পে আনন্দী স্বামীর প্রতি ভালবাসার পবিত্রতার কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছে। সন্তান লাভের ধ্যান-ধারণায় স্বামীর ইচ্ছায় যে গুরুর সেবা যতেœর জন্যে ঘর ছেড়ে এসেছে, সেই গুরুর কাম-লালসার বিষয়টি বুঝতে পেরে আনন্দী তাতে ধরা দেয়নি। তবে নিজে গৃহত্যাগী হয়েছেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূপতি, চারু আর অমল (নষ্টনীড়) এবং আনন্দী ও তার গুরু (বোষ্টমী) চরিত্রগুলোকে নি:সঙ্গতা, একাকিত্ব, বিচ্ছন্নতা আর ভালবাসার মধ্যে ফেলে এক সার্থক রূপায়ণ করেছেন।
২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্ম বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: (সাহিত্যের সেবক, বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক রাইটার, অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, পাবনা, বাংলাদেশ)। ফ্লোরিডা, ইউএসএ প্রবাসী ।