মুরশাদ সুবহানী : সহজ করে বললে, তাঁর পিতা ছিলেন কলকাতা আদালতের একজন নামকরা আইনজীবী। পিতার সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাইকেলের মনের কোণে জমা হওয়া পিতার আচরণ তাঁকে ব্যথিত করায় তিনিও ব্যারিস্টারি পড়েন। অথবা তাঁর উচুঁ শিক্ষার গ্রহণের জন্যেও ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নিতে পারেন। আমরা কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার রূপায়ণ আলোচনা করতে কিছুটা প্রাসিঙ্গতার মধ্যেও সামান্য অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করলাম। এটুকুর প্রয়োজন ছিল বলে আমরা মনে করি।আমরা ফিরে যাচ্ছি, বাংলা মায়ের প্রতিভাবান সেই সন্তান কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার রূপায়ণের দিকে।
তাঁর সব কবিতা আলোচনা করা সম্ভব নয় সল্প পরিসরে এই প্রবন্ধে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র জীবনকাল খুব লম্বা ছিল না। স্বল্পকালে তিনি তা যা দিয়েছেন, তা বাংলা সাহিত্য শুধু নয়, ইংরেজি সাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছে। মৃত্যু তাঁর দ্বারে কড়া নাড়ছে বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে লেখা কবিতাটি দিয়ে শুরু করা যাক- কলকাতার মল্লিক বাজারে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্থলে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা এই কবিতাটি দেখেছেন এবং ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁর সমাধির কাছে- “দাঁড়াও, পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে। তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এ সমাধিস্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম)
মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগর-দাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।”

কবির এই আহ্বান পড়ে কোন বঙ্গ সন্তান তাঁর সমাধির কাছে ক্ষণকাল দাঁড়াবে না?
কোন পটভূমিকায় কোনো সাহিত্যিকের কাব্য দৃষ্টি, নিজস্ব স্বকীয়তা এবং তাঁর সাহিত্য মূল্য-বিচার নিরুপণ করে নবরূপায়ণ নিয়ে আলোচনা করা খুব সহজসাধ্য নয়। আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত যিনি কাব্যধারাকে এক নুতন রূপ দিয়ে একটি স্বর্ণযুগের শুরু করে নিজেকে উর্ধে তুলে ধরেছেন, তাঁর কাব্যমূল্য বিচার করা কষ্টসাধ্য। তারপরও আমরা আমাদের ক্ষুদ্র প্রাজ্ঞতার উপর ভরসা করে সেদিকে এগিয়ে যেতে চাইছি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবি প্রতিভায় এক মহাবিপ্লবী। তিনি সনেটের জনক। অমিত্রাক্ষর ছন্দের দাতা। তিনি বাংলা কবিতায় এই ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা করেন এবং এক নব প্রেরণা নিয়েই বাংলা কবিতায় এই ছন্দের প্রয়োগ করেন এবং এই ছন্দের মূল কাঠামো ঠিক রেখে এর উপর নির্মাণ করেন নতুন ছন্দ। যদিও অমিত্রাক্ষর ছন্দ আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নয়; তারপরও নতুন ছন্দের দাতার এই ছন্দ’র উপর সামন্য আলোচনা করা প্রয়োজন।’ সাধারণ নিয়মে চৌদ্দ মাত্রা বিভক্ত হয় দু’ভাগে শ্বাসযতি দ্বারা। আটমাত্রার পর আসে অর্ধ শ্বাসযতি এবং প্রতি চরণে শেষ ছয় মাত্রার পরে একই সঙ্গে আসে পূর্ণ শ্বাসযতি ও অর্ধযতি। যেমন:
‘মহাভারতের কথা। অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে। শুনে পুণ্যবান।’
(।অর্ধ শ্বাসযতি;।। পূর্ণ শ্বাসযতি; =অর্ধযতি’

এই নিয়মে ভাব প্রকাশ ব্যাহত হচ্ছিল। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর অমিত্রাক্ষর ছন্দে এই যতি স্থাপনের নিয়ম ভেঙ্গে দিয়ে সৃষ্টি করলেন, ভাবের প্রবাহ।
তিনি লিখলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দে:
‘উঠিল গগনে রথ গম্ভীর নির্ঘোষে।
শুনিনু ভৈরব রব, দেখিনু সম্মুখে
সাগর নীলোর্ম্মময়। বহিছে কল্লোলে’
অতল, আক‚ল জল, অবিরাম গতি।’
তিনি যে কাব্য দৃষ্টি মেলে কবি মনের গভীরতা দিয়ে কবিতায় যে প্রবাহ নব প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন; সেটাই তাঁর কবিতার রূপায়ণ।
‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি বিরলে;
সতত( যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এক কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই কবিতায় প্রবাস জীবনকালে তাঁর নিজ গ্রাম সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ নদকে ভুলতে পারেননি। তাঁর তৃষ্ণা কপোতাক্ষ নদ-জলে যে ভাবে প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছে, প্রবাসের নদ-নদী জল তেমনটি হয়নি। এখানে কবি মনের মাতৃভূমির প্রতি টান প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। কবি চিন্তিত হন, মাতৃভূমির সাথে তাঁর আর কখনও দেখা হবে কিনা এ কথা ভেবে।
আমরা তাঁর আর এক কবিতায় দেখতে পাই:
হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন লোভে মত্ত, করিনূ ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
‘‘ ওরে বাছা মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী –দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি অজ্ঞান তুই , যা রে ফিরি ঘরে!’’
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি , পূর্ণ মণিজালে ।।’
চতুর্দশপদী এই কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদেশে নানা দুর্ভোগ, বন্ধুদের অবহেলার পর তার কবি মনে মাতৃভূমির অফুরন্ত রত্ন ভান্ডারের কথা মনে আসে। (চলবে)