মণিজিঞ্জির সান্যাল : বৃষ্টিকে সঙ্গী করে আমি তখন সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি চেরাপুঞ্জির পথে প্রান্তরে। বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়, আরো ভাল লাগে বৃষ্টিতে প্রাণভরে ভিজতে। আরো একটা মজার ব্যাপার, বৃষ্টি মানেই আমার হৃদয় জুড়ে কবিগুরু, শুধুই কবিগুরু। ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়ি রাস্তা আর কবিগুরুর ‘শেষের কবিতা’।

নিজেকে লাবন্য ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারি না যে, তাই তো অমিতকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেই এই পাহাড়ি পথে আসা। চোখ বন্ধ করে ভাবা এক জিনিস আর পথে প্রান্তরে সেই অনুভূতির সূক্ষ্ম জাল বিছানো আরো এক জিনিস। তাই তো বহুদিনের স্বপ্ন ছিল কবিগুরুর সৃষ্ট চরিত্রদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করা।

স্বপ্ন যখন একটা একটা করে পূরণ হয়, তখন স্বপ্ন দেখার চাহিদাও যেন একটু একটু করে বাড়তে থাকে। প্রথমবারের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল কালিম্পংয়ের মংপুতে গিয়ে, তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি শিলং-এর কারণ এই শহরটাতেই তো লাবণ্য আর অমিতের সাক্ষাৎ। তাই তো সত্যিই একদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার শহর শিলং-এ। প্রতিটি পর্বত-প্রেমীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে শিলং। প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলে যার পরিচিতি। কেউ কেউ বলেন দার্জিলিং যদি হয় রূপের রানি, তাহলে শিলং হল রাজা। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শিলং বাঙালির নস্টালজিয়ায় অনন্য।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে গৌহাটি স্টেশানে কাঞ্চনজঙ্ঘা গিয়ে পৌঁছল ভোর চারটেয়।ওখান থেকে গাড়ি করে শিলং পৌঁছলাম সকাল সাড়ে সাতটায়। তারপর ফ্রেশ হয়েই রওনা দিলাম কবিগুরুর অন্বেষণে।

কবিগুরু মোট তিনবার শিলং এসেছিলেন। ১৯১৯, ১৯২৩, ১৯২৭। আমরা প্রথমে একবার গেলাম শিলং শহরের রিলবং বলে একটি অঞ্চলে। রিলবং-এর জিগজ্যাগ রোড-এর ব্রæকসাইড বলে একটি বাংলো যেটি কিনা কে.সি. দের বাংলো বলেই পরিচিত । এখানে মোট ১৮টি ঘর আছে। ১৯১৯ এর ১১ই অক্টোবর শনিবার দুপুরে কবি এখানে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে অবশ্যই পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, ভৃত্য সাধুচরণ। ১৯১৮ সালে কবির অতি আদরের মেয়ে মাধুরীলতাকে হারিয়ে কবি উন্মত্ত সেই সময়। সমস্ত সঞ্চিত ব্যথাকে সঙ্গে করে কবি এখানে এলেন, তখন কবির বয়স ৫৭ বছর।

কে.সি.দের স্ত্রী মিসেস দে ছিলেন কবির অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী। কে.সি. দে ছিলেন ব্রাহ্ম, তাঁর স্ত্রীর সাথে ঠাকুর পরিবারের ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কবির মানসিক অবস্থা অবলোকন করে মিসেস দে’র পরামর্শে মিস্টার দে ব্যবস্থা করে দিলেন কবির মনোরঞ্জনের সবকিছু, কবি যাতে সমস্ত শোক কাটিয়ে উঠে নিজের সৃষ্টিসাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। সেই সময় গৌহাটি থেকে শিলং-এর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত অনুন্নত। বৈদ্যুতিক আলো -ও ছিল না। কবি এই বাংলোতে ২০ দিন ছিলেন। তারপর চলে গেলেন গৌহাটি। সেখানে তিনদিন থাকার পর চলে গেলেন সিলেট। তারপর গেলেন আগরতলায়। কবি সাতবার আগরতলায় এসেছিলেন।

১৯১৯ ‘ব্রæকসাইট’ থাকাকালীন কবি তেমন কিছু লেখেননি। শুধুমাত্র দুটো অনুগল্প লিখেছিলেন। তবে ‘শেষের কবিতা’র প্লট আঁকলেন শিলং-এ এসেই, কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে বসে কবি ‘শেষের কবিতা’ লিখেছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন বারে বারে। মনে মনে কল্পনা করে নিচ্ছিলাম কবিগুরুর প্রতিটি পদক্ষেপ। আহা এমন মনোরম পরিবেশ!
এরপর আমরা পৌঁছলাম ‘জিৎভূমি’ নামক বাংলোটিতে। যেখানে কবি এসেছিলেন ১৯২৩ সালে। দু’মাস কবি এখানে ছিলেন। আর এই ‘জিৎভূমি’তে থাকাকালীন কবি লিখলেন তাঁর বিখ্যাত নাটক “রক্তকরবী”। এছাড়াও কবি লিখলেন ‘শিলং-এর চিঠি’ এবং ‘প্রাচী’ কবিতাটি।

কবির ভাই হেমেন্দ্রনাথের মেয়ের স্বামী ডক্টর দেবেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ছিলেন এই বাড়ির মালিক। ‘জিৎভূমি’তে প্রবেশ করতেই লক্ষ্য করলাম শ্বেতপাথরের দুটো ফলক। একটি ফলকে “ভারততীর্থ” কবিতাটি উৎকীর্ণ আছে, আর অন্যটিতে লেখা আছে “His famous drama Raktakarabi and Poems.”

চেরাপুঞ্জিতে লেখিকা

তৃতীয়বার কবি এসেছিলেন ১৯২৭ সালে আপল্যান্ড অঞ্চলের একটি বাড়িতে। এটি ছিল সিডলীর রাজপরিবারের গ্রীষ্মাবাস। সিডলীর রাজা অজিত নারায়ণের স্ত্রী মঞ্জুলাদেবী ছিলেন সাউথের পৃথাপুরমের রাজকন্যা। মঞ্জুলাদেবী তখন খুব ছোট কবি তাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন, কবি ছিলেন পারিবারিক বন্ধুসম। খুব স্নেহ করতেন কবি। পরোবর্তীতে মঞ্জুলাদেবীর অনুরোধে রাজা অজিত নারায়ণ কবির থাকার সবরকম ব্যবস্থা করে দিলেন।
এরপর বিগত কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডোনার’ মন্ত্রী ভিনসেন্ট পালা সেটি কিনে নেন এবং সকল ধরনের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে বাড়িটি ভেঙে ফেলেন। কবিগুরুকে আমি যেন স্পষ্ট উপলব্ধি করছিলাম এই বাংলোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কি অসাধারণ উন্মুক্ত বাতাবরণ। এমন পরিবেশে শুধু কবিকেই মানায়। ঝলমলে রোদ্দুরেও কবির জন্যে মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল।
এর পরের দিনগুলো বেড়ালাম কবিকে সঙ্গে করেই। প্রকৃতির অপরূপ সব শোভা হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম। শিলংকে ঘিরে আছে গলফ কোর্স, ওয়ার্ডস লেক, লেভী হায়দরী পার্ক, উমিয়াম লেক, শিলং পিক, আর অতি আশ্চর্য এলিফ্যান্ট ফলস্। আহা! ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

পরদিন খুব ভোরে রওনা দিলাম চেরাপুঞ্জী। সেখানে গিয়ে মনে হচ্ছিল জীবনধন্য। পৃথিবীর আশ্চর্য সব জলপ্রপাত। সেভেন সিস্টার ফলস, মকটক ভিউ পয়েন্ট, মোসমাই প্রাকৃতিক গুহা, ইকো পার্ক, খাংখারাং পার্ক, নাহকালিকাই ফলস।

নাহকালিকাই ফলসের একটি ভয়ংকর ইতিহাস আছে, যা শুনলে শিহরিত হতে হয়। এই ইতিহাসের কাহিনী সঙ্গে নিয়ে সবশেষে গেলাম রামকৃষ্ণ মিশন। মনটা শান্ত হয়ে গেল।
তারপরের দিন প্রবল বৃষ্টি। সমস্ত বৃষ্টিকে সঙ্গী করে সেদিনও খুব ভোরে রওনা দিলাম ডাউকি। চারদিকে প্রথমে তুলো তুলো মেঘ। কিছুক্ষণ পরে ঘন কুয়াশা, তারপর অঝরে বৃষ্টি। একটু পরেই বৃষ্টি নেই, কিন্তু কিছুক্ষণ কাটতে না কাটতেই আবার বৃষ্টি। এর-ই মধ্যে কখন যে পৌঁছে গেলাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম ‘গ্রীণ ভ্যালি ভিলেজ’। চোখ জুড়িয়ে গেল পরিচ্ছন্ন গ্রামটিকে দেখে। সমস্ত দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে কি সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রাম। একটা পাতা বা কাগজের টুকরো বা কোনো কিছুর টুকরো অংশ কিচ্ছু পড়ে নেই। অবাক হয়ে শুধু দু’চোখ ভরে শুধু দেখতে লাগলাম।

এরপর গেলাম “লিভিং রুট ব্রিজে”। ৪৫০ মিটার গভীর এই ব্রিজটি দুটো গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি। প্রচন্ড দুর্গম এই ব্রিজটি ওপর থেকে নিচে গিয়ে পৌঁছাতে যে কোনো সময়ে পা পিছলে যেতে পারে। একটু পরেই শুনতে পেলাম ঢং ঢং ঢং , কাসরের ঘন্টা, ভাবলাম নিশ্চয়ই কাছে কোনো মন্দির আছে , তাহলে কি এখানে ঈশ্বরের দর্শন পাব! কিন্তু অবাক হলাম, মন্দিরের দেখা নেই। অদ্ভুত এক ধরনের পোকার আওয়াজ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হিমালয় ভ্রমণের’ কিছু শব্দমালা মনে পড়ে গেল সেই মুহূর্তে।

শিলং মানেই স্মৃতিমধুর কিছু মুহূর্ত। মেঘালয় ভ্রমণ এক কথায় অসাধারণ। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই এক একদিন এক একটা নতুন নতুন জায়গা পরিদর্শন।
এমনই একটি দিনে এক অদ্ভুত চমক নিজের কাছে নিজেই উপলব্ধি করলাম।
হঠাৎ বৃষ্টি এলো তুমুল বেগে এবং ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমার থেকে আমাকে, স্মৃতিতে ভেসে উঠল অমিতো রয় (অমিত রায়)।
লাবণ্য যেন ভর করেছে তখন আমার মধ্যে।
“অমিত রয়কে আমি পছন্দ করি, ব্যারিস্টর। অবশ্য রায় পদবী থেকে ইংরেজি ছাঁদে ‘রয়’ ও ‘রে’ তে রূপান্তর ধীরে ধীরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি, এ -র কোঠায় পা দেবার আগেই অমিত অক্সফোর্ডে ভর্তি হয়; সেখানে পরীক্ষা দিতে দিতে এবং না দিতে দিতে ওর সাত বছর কেটে গেল। বুদ্ধি বেশি থাকাতে পড়াশোনা বেশি করেনি, অথচ বিদ্যেতে কমতি আছে বলে তো মনে হয় না ।

অমিতের সাথে একটা ব্যাপারে আমি একদম একমত “ফ্যাশন হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী।” অমিতের নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য- বাছাই কাজে নয়, বেশ ভূষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে, পাঁচজনের মধ্যে ও যে কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম; অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে …”
হঠাৎ চমক ফিরল, লাবণ্য কোথায়!
চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিতে তখন আমি ভিজে স্নান। হ্যাঁ আবার যাব, বহুবার যাব।
আহা শিলং! আর শিলং মানেই তো কতো কি! কবিগুরুর “শেষের কবিতা”

“রক্ত করবী” আরো আরো অনেক কিছু। লাবণ্য! আহা হৃদয় জুড়ে লাবণ্য! আসলে বৃষ্টি এলে আমার মনটা একেবারে পালটে যায় যে। চলছিলাম আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা ধরে, ডান দিকে জঙ্গলে ঢাকা খাদ। চোখের সামনে ভেসে উঠল কিছু ছবি…

“রাস্তায় কোনো যাত্রী নেই, তাই কোনো আওয়াজ না করে অসতর্ক ভাবে অমিত নিজস্ব স্টাইলে আপন মর্জিতে গাড়ি চালাচ্ছে। এমন সময় বাঁকের মুখে এসেই দেখে নিচ থেকে একটি গাড়ি উপরে উঠে আসছে কিন্তু পাশ কাটাবার জায়গা নেই । ব্রেক কষতে কষতে গিয়ে পড়ল তার উপরে, পরস্পর আঘাত লাগল এবং অন্য গাড়িটা খানিকটা গড়িয়ে পাহাড়ের গায়ে আটকে থেমে গেল।

একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সদ্য মৃত্যুর হাত থেকে একটুর জন্য বেঁচে যাওয়া এক রমণীর ছবি, যাকে অমিত দেখল দুর্লভ অবসরে। পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।
অমিত গাড়িতে টুপিটা খুলে রেখে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। যেন একটা পাওনা শাস্তির অপেক্ষায় …”
লাবণ্য আর অমিত আমার হৃদয় জুড়ে। কিছু কিছু দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
“হে অচেনা,
দিন যায়, সন্ধ্যা হয়, সময় রবে না—–
তীব্র আকস্মিক
বাধা বন্ধ ছিন্ন করি দিক;
তোমারে চেনার অগ্নি দীপ্তশিখা উঠুক উজ্জ্বলি,
দিব তাহে জীবন অঞ্জলি।”

চমকের ওপর চমক। মেঘালয়ের মেঘপুঞ্জ আমাকে সঙ্গে নিয়েই তখন ভেসে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু শেষের আগের দিন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ উমা পুরকায়স্থের সঙ্গে আলাপ আর সারাটা দিন তাঁর বাড়িতে কবিগুরুকে নিয়ে আলোচনা, সত্যি এক কথায় চোখে জল আসার মতো। এমন অভ্যর্থনা, এমন আন্তরিকতা ভাবা যায় না। মনে হচ্ছিল কখনো আমি আমার মায়ের সাথে কথা বলছি; কখনো বা মৈত্রেয়ী দেবীর সামনে বসে আছি। শ্রীমতী উমা পুরকায়স্থ একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করছেন, কখনো আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছি। কখনো তিনি কবিগুরুর শেষের শেষ দিনের গল্প শোনাচ্ছেন। কখনো কবির কর্ম জীবনের কথা বলছেন। কখনো আমার চোখে জল, কখনো তিনি ঝরঝর করে কাঁদছেন। সে এক অদ্ভুত বাতাবরণ যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।

“যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।”
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শ্রীমতী উমা পুরকায়স্থের অগাধ জ্ঞানের ভান্ডার। জীবনে কিছু মুহূর্ত আছে যা কোনোদিন ভোলার নয়; এমন কিছু মানুষ-ও জীবনে দেখা মেলে যাঁকে হাজার চেষ্টা করলেও স্মৃতি থেকে সরানো যায় না। এমন-ই একজন বন্ধু মেঘালয়ের শিলং-এ বসবাসকারী রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শ্রীমতী উমা পুরকায়স্থ। আমার মাতৃসম।

শিলং এ বেড়াতে গিয়ে ঈশ্বর আমার কাছে তাঁকে কিভাবে মিলিয়ে দিলেন যেন। শিলং-এ যে গেস্ট হাউসটিতে উঠেছিলাম সেই গেস্ট হাউসের মালিক নিজেই উপযাজক হয়ে শ্রীমতী পুরকায়স্থের সাথে দেখা করার কথা বললেন এবং তাঁর ঠিকানা দিলেন। আমি ঠিক পৌঁছে গেলাম তাঁর দেওয়া নির্দিষ্ট ঠিকানায়। এমন ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা খুব কম দেখেছি, এমন উদাত্ত কণ্ঠস্বর আমি খুব কম শুনেছি।

সেদিন যে সময়টুকু কাটিয়ে ছিলাম তা আমার জীবনের চরম পাওয়া। কবিগুরুর আলোচনার মুহূর্তেই তিনি চোখ বন্ধ করলেন। তারপর একনাগাড়ে বলতে শুরু করলেন কবিগুরুর জীবনের মর্মস্পর্শী দিনগুলোর কথা। একের পর এক ঘটনা আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠছিল। কখনো গান, কখনো কবিতা, কখনো মৃত্যুর শেষ দৃশ্য।
কতো করুণ স্বরে, কখনো চোখের জলে সেই স্বর আমার হৃদয়ের দ্বার খুলে দিচ্ছিল ক্রমাগত। আমি যেন পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি কবিগুরুর শেষের শেষদিনের দৃশ্য। সেকি যন্ত্রণার, সেকি কষ্টের। আমার চোখের জল কখন আমার চিবুক স্পর্শ করেছে আমি জানি না। এক অসাধারণ মায়া জড়ানো ব্যক্তিত্বময়ী মহিলার হাত তখন আমার মাথার ওপর, পিঠের ওপর এক স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে চলেছে ক্রমাগত। তাঁর বেশ কিছু বই-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় “TAGORE AND PINELAND SHILLONG”.

কিভাবে কেটে গেল মুহূর্তগুলো। ফিরে আসার সময় মনটা কেঁপে উঠল। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে ফিরতে ফিরতে আমার শুধু একটা কথাই মনে পড়ছিল, লাবণ্যকে ঠিক কোন জায়গায় আবিষ্কার করেছিল অমিত?
কবিগুরুর শেষের কবিতার ‘লাবণ্য ‘ না রক্ত করবী’র নন্দিনী কার আভিজাত্য একটু বেশি? ব্যক্তিত্বে ভরপুরে কে একটু বেশি এগিয়ে? নন্দিনী? নাকি লাবণ্য? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে অনেকটা পথ শিলংকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি , তা খেয়াল-ই করিনি …
মণিজিঞ্জির সান্যাল, কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত