মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

আটান্ন.
আমার প্রথমবারের মত এমপি হওয়ার একেবারে শুরুর দিকে কানাডার রাজনৈতিক দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। ২০০৮ এর অক্টোবর নির্বাচনের ছয় সপ্তাহের মধ্যেই বিরোধী দলগুলো সংখ্যালঘিষ্ঠ কনজারভেটিভ পার্টির বিরুদ্ধে সরকারের বাজেট সম্পর্কে যথার্থ দিক নির্দেশনা না থাকায় অনাস্থা প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা লিবারেল’রা ৭৭ আসন নিয়ে এবং নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ৩৭ আসন নিয়ে একটি কোয়ালিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। দ্য ব্লক কুইবেইকস আমাদের সমর্থনের কথা জানায়। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্তটা বাস্তবায়নের আগেই প্রধানমন্ত্রী গভর্নর জেনারেল মিশায়েল জ্য’র কাছে ২০০৯ এর জানুয়ারী পর্যন্ত পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত করার জন্য অনুরোধ করেন, এর ফলে ঐ সময়ে আর অনাস্থাসূচক ভোটের আর সম্ভাবনাটা থাকলো না।

কাগজে কলমে যদিও এই প্রস্তাবিত কোয়ালিশনটা নতুন বছরেও ঠিক থাকবে, কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে কোয়ালিশনটা গঠন করা হয়েছিল, সেটা আর তখন সম্ভব হলো না।
আমাদের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় হাউস অব কমন্স এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে সরকার গঠিত হয়, এইসব সদস্য এক দল বা একাধিক দলের সদস্য মিলে হতে পারে। নাগরিকরা তাদের ভোটে এই হাউস অব কমন্স এর সদস্যদের নির্বাচিত করে এবং এই হাউস’ই সিদ্ধান্ত নেয় কে ক্ষমতায় যাবে আর কে যাবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার এ একটি দল হাউস এর মোট সদস্যের অর্ধেকের বেশি ভোট পেয়ে থাকে, আর এতেই সেই দল বিজয়ী হয় এবং এককভাবে সরকার গঠনের ক্ষমতা পেয়ে থাকে। কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকারে কোন দলই এককভাবে সরকার গঠনের অধিকার পায় না, কিন্তু যে দল বেশি ভোট পেয়ে থাকে তাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানো হয় এক শর্তে যাতে অন্য দলের সহযোগিতায় সেই দল মোট সদস্যের অর্ধেকের বেশি সদস্যের ভোট বা সম্মতি নিতে পারে। সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকার তার শাসন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যদি সহযোগী কোন দল মূল দলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে ফেলে অথবা অন্য কয়েকটি দল মিলে যদি বেশি সংখ্যক আসনের একটি গ্রুপ তৈরী করে।

কনজারভেটিভরা তখন তাদের অস্তিস্তের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, এবং তারা তাদের টিকে থাকার জন্য গণ সমর্থনের বিষয়টি উপেক্ষা করার জন্য দুটি পথ অবলম্বন করতে থাকে।

কানাডার ২২তম প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার। কানাডা কনজারভেটিভ দলের নেতা হার্পার ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন

তারা প্রচারে খুবই পারদর্শী ছিল এবং জানতো কিভাবে সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয়া যায়। তারা ভুলভাবে প্রচার করতে থাকে কিভাবে সংসদীয় সরকার কাজ করে এবং এর মধ্যে কি কি নিয়ম নীতি আছে। এটা কিন্তু সত্যিই সহজ এবং অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে যদি বলা হয়, ‘স্টিফেন হার্পার এর দল নির্বাচনে জিতেছে, বেশি ভোট পেয়েছে, কিন্তু এখন পরাজিত পক্ষ সরকারের দায়িত্ব নিতে চাই।’ এটার বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে দাঁড়ানো কিন্তু খুবই কঠিন যে কিভাবে হাউস অব কমন্স এর ছোট ছোট দল এক হয়ে কোয়ালিশন গঠন করে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দলকে ক্ষমতার বাইরে রাখবে। এই ধরনের ছোট ছোট কথা আর প্রচার প্রতি দিন আর প্রতি সপ্তাহে সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছলে ব্যাপারটা নিয়ে সাধারণের মধ্যে একটু ভাবনা চিন্তা আসবে এটাই স্বাভাবিক।

দ্বিতীয়ত্ব, তারা জোর করে বলতে থাকে কোয়ালিশন সরকারের ক্ষমতায় আসতে হলে সার্বভৌমত্ববাদীদের সমর্থনের প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তারা যে প্রচার চালাতো বা সার্বভৌমত্ববাদীদের যে বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন করেছিল, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তারাও ব্লক কুইবেইকস এর ভোট বা সমর্থন নিতে দ্বিধাবোধ করেনি। তাদের যখন প্রয়োজন, তখন তারা যে কারো সহযোগিতা নেয়ার জন্য উন্মুক্ত থাকে, কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে, তার বিরুদ্ধে কথা বলতে তারা ছাড়ে না। এখন তারা অবলীলায় বলে, সার্বভৌমত্ববাদীরাই কানাডার রক্ষাকর্তা হবে। প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার পার্লামেন্ট এ বসে এমনও উক্তি করেন, যেদিন এই কোয়ালিশন এর চুক্তি হবে, সেদিন কানাডার কোন পতাকা থাকবে না, যেটা ছিল একটা ঢাহা মিথ্যা কথা। (চলবে)