হিমাদ্রী রয় : মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তথা মাষ্টার মশাই শ্রী রামকৃষ্ণের কথাকে ভাগবতের গোপী গীতের উদ্বৃতি দিয়ে পরিচয় করিয়েছেন আমাদের মাঝে।
‘তব কথামৃতং তপ্ত জীবনং কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং ভুবি গৃণন্তি যে ভুরিদা জনাঃ’।
তোমার কথা অমৃত সমান, সংসারে দগ্ধ মানুষের কাছে জলের মত, যা জীবনকে শিতল করে।
যা হউক এই লেখায় শ্লোকের পূর্ণাঙ্গ ব্যখ্যা দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে আজকের বিষয় কথা।
স্কুলের স্যার বলতেন চোখের জল, কামানের গুলা, মুখের কথা ফেরত নেয়া যায় না। এক বিদ্যে বুঝাই পন্ডিত প্রায়শই বেফাস কথা বলতেন। নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে কিংবা এটেনশান পাওয়ার জন্য অন্যকে ছোট করা অথবা উপহাস করে তিনি আনন্দ পেতেন। এক সময় তিনি বুঝতে পারলেন যে মানুষ তাকে এড়িয়ে চলছে। তিনি নিজেকে পরিবর্তনের জন্য সাধু বাবার কাছে গেলেন। সাধুবাবা তাকে উপায় হিসাবে তুলার বস্তা দিয়ে বললেন সামনের গাছতলায় ঢেলে রেখে আসো। যথারীতি সে রেখে আসলো সাধু এবার বললেন সব তুলা আবার বস্তায় ভরে নিয়ে আসো। সে দুঃখিত হয়ে ফিরে এসে জানালো সাধুবাবা অর্ধেক তুলা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। তখন সাধু শান্ত হয়ে বললেন কথাও সেই তুলার মত, একবার বের হলে আর জড়ো করে ফিরিয়ে আনা যায় না। তবে তুমি পরবর্তী সময়ে কথা বলার সময় সাবধানী হতে পারো। ধর্মশিক্ষা পড়াতে এসে পুলিন স্যার এই গল্পগুলো করতেন যদিও এর সাথে পাঠ্যক্রমের সম্পর্ক ছিলো না।
রান্না ঘরে মা-দিদিরা যখন যত্ন করে রান্না করেন নামানোর আগে অনেকেই একটু চেকে নেন নুন কিংবা ঝাল ঠিক আছে কিনা? কথা বলার আগে ভেবে নিলে ভালো, যে কথাটা বলবো তাতে কেউ আঘাত পাবেন কিনা। শব্দের যদিও দাঁত নেই তবে জিহবা যখন কাটে তখন প্রচন্ড ব্যাথা হয়।
সব মানুষের স্বরুপ আসলে জিহবার পেছনে লুকিয়ে থাকে। যখন আমরা কথা বলি, আমরা কিসে উপহাস করি, কোন বিষয়ে আমাদের কৌতুক অনুভূতি হয় একটু দৃষ্টি রাখলেই আমাদের ব্যাক্তিত্ব চিনে নেয়া যায়। যখন নিন্দা জানানোর মত কোন ঘটনা ঘটে সেখানে মন্তব্য করতে যেয়ে যারা পার্শ্ববর্তী দেশেও এমন হয় উদাহরণ টেনে আনেন তাদের ব্যাক্তিত্ব চিনতে আর অসুবিধা হয় না। সৎ মানুষের কাছে, গলদ সব সময়, সব জায়গায় গলদ। এটা হউক বাংলাদেশ বা ভারত, ইসরায়েল অথবা আমেরিকা।
জিহবার ওজন এত কম অথচ কতবার যে এই ওজন সামলাতে পারিনি এই ভেবে লজ্জা পাই। আমরা কি বলছি তার থেকে বড় বিষয় কিভাবে বলছি। অনেকেই বলি যে মা-বাবা আমাদের সাথে থাকেন। এই শহরে আমার পরিচিত এক দাদা আছেন (রানা’দা) তাকে বলতে শুনতাম আমরা মায়ের সাথে থাকি। মাসিমা তখনো বেঁচে ছিলেন। হাজার শব্দ চারপাশে, যদি তা হৃদয়কে ছুঁতে না পারে তবে অর্থহারা। মা-বাবার সাথে থাকি কথাটি তেমনি হৃদয় ছোঁয়া। অমৃত কি আর সহজে মেলে, মন্থন করতে হয়। মাঠায় পাঁক দিলে যেমন করে মাখন ওঠে সেই রকম।
আমাদের জীবন তপ্ত অতি সত্য কথা। সংসারের তাপে আমরা দগ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত। হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা পুষে এত নিচে নেমে এসেছি যদি কেউ প্রেমের কথা বলে, ভালোবাসার কথা বলে তাকেও সন্দেহ করে বসি, অনেকের আবার চোখেও লাগে।
আবার এও সত্য যে কথার বিপনন করে কেউ বাজার জমিয়ে রাখেন। বুদ্ধের মত কথা বলেন। বেশে বৈরাগ্য, বিবেক বৈরাগ্যের বালাই নেই, অন্তরে সংসার সার। মুখে ব্রম্ম কথা মনেতে নিজেকে প্রচারের আলোয় আনার প্রবণতা। হায়রে পাণ্ডিত্যের অপচয়! কথার গল্প ফেঁদে অন্যকে খাটো করে নিজেক মহৎ করার যজ্ঞ ঘটা করে। এতে ওম সোয়াহা বলে আহুতি দেয়ার লোকের অভাব হয় না। এদের মুখোশ খোলা অনেক সময় সাধ্যের মধ্যে পড়ে না। অপেক্ষা করতে হয় সময়ের জন্য আর সময়ের জবাব লা-জবাব হয়।
শুধু কথায় মানুষ চেনা যায় না কারণ কথা নিয়ন্ত্রণ হারায়, কথা চোখের উপর পর্দা ধরায়। ভালো মানুষের ব্যাক্তিত্ব চিনতে হয় তার বিচার, ব্যবহার, সমালোচনা গ্রহণ করার ক্ষমতা দিয়ে। আর ভালো ভালো কথা তো বাস, স্টিমার, ট্রেনের দেয়ালেও লেখা থাকে।
আফসোস যদি আমরা মানুষদের শুনতে যেয়ে তাদের নিয়তটা শুনতে পেতাম। কিন্তু নিয়ত কেবল উপরে যিনি বসে আছেন অসিম তিনিই জানেন। আর জানেন সেই বক্তা যিনি বিবেকের সাথে প্রতারণা করে চলেন। ধরিবাজ বক্তারা চান আপনি তাদের জানুন, শুনুন, প্রচার করুন তবেই আপনি ভালো, যেই নিয়ত খুঁজতে যাবেন তখনি অমৃতে অরুচি। মিলাবটের এই দুনিয়ায় যদি আপনি হাঁ এর সাথে হাঁ এর স্তুতি করতে পারেন সম্পর্ক ফুলে-ফেঁপে ওঠে।
হৃদয় দিয়ে অনুভব করে যিনি হৃদয় দিয়ে কথা বলেন তার কথাই কেবল তপ্ত জীবনে জলের তলের শীতলতা এনে দেয়। কথা দিয়ে কেউ মনের কোণে জায়গা করে নেয় আর কেউ কথার জন্য মন থেকে হয় বিতাড়িত।
এক সুফি সাধকের পঙক্তি মানুষ থেকে উৎপত্তি যা আমাদের জাহান্নামে ধাক্কা দিবে তা হলো জোবান মানে জিহবা, এবং এর থেকে উচ্চারিত শব্দ। জিহবায় উচ্চারিত শব্দ যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয় তা কখনই কবিতা হয় না। তাই কথায় লাগাম দিতে হয়, পিছে কেউ নিয়ত বুঝে লয়।
উপরের শ্লোকের কল্মষ কথার অর্থ হলো কালিমা। সমাজ-সংসারে আমাদের গায়ে কালি লাগবেই, আমাদের যত কলুষতা, অজ্ঞানতা দূর হয় কথা রুপ অমৃত শুনে। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের কথা, কবিতা গান প্রার্থনার শামিল, ইবাদতের শামিল। শেষ করছি পরমহংসদেবের কথা রুপ অমৃত গল্প দিয়ে।
এক নামাজী, নামাজ করতে করতে হো আল্লাহ হো আল্লাহ বলে চিৎকার করে ডাকছিল পাশ থেকে একজন বললো, তুই আল্লাহকে ডাকছিস তো চেঁচাচ্ছিস কেন? তিনিতো পিঁপড়ের পায়ের নুপুরও শুনতে পান।
‘যত বেশি নিরব হবে তত বেশি শুনতে পাবে’ -রুমী।
হিমাদ্রী।