ভজন সরকার : আমার বন্ধু ভাগ্যটি খুব খারাপ না। প্রাক্তন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারণেই হোক কিংবা নিজের সহজ এবং মিশুক স্বভাবের জন্যই হোক বন্ধুর সংখ্যা বেশ বিস্তৃতই ছিল আমার। আমি তো গর্ব নিয়েই বলি, চোর-ডাকাত-পকেটমার থেকে শুরু করে আমলা-কামলা-কবি-সাহিত্যিক- জ্ঞানী-গুনী-নির্গুনী সব প্রজাতির মানুষই আমার বন্ধু বা পরিচিতির তালিকায় ছিল একসময়। তাই বলে এই নয় যে, নিজে ওসব পেশায় ছিলাম সবখানে। চোর-ডাকাতের কথা পরে বলা যাবে, পকেটমার কী করে আমার বন্ধু বা পরিচিতজন হয়ে উঠলো সে কথাটি আগে বলি।

তখন আমার কর্মসূত্রের আওতায় ছিল শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ের ভেদরগঞ্জ মানেই এক দুর্গম এলাকা। শরীয়তপুর থেকে ইট-বিছানো পথে রিক্সা নিয়ে যেতে হতো কয়েক ঘন্টা শরীরকে চরম দুর্ভোগ দিয়ে। আর একটি পথ ছিল ঢাকার সদর ঘাট থেকে সারা রাত লঞ্চে ভেদরগঞ্জ। জানি না এখন কী অবস্থা। সে সময়ে লঞ্চের কেবিনগুলোর অবস্থা এতো খারাপ ছিল যে, বিছানার চাদর, কম্বল এবং বালিশের কভার সাথে নিলেও প্রচন্ড দুর্গন্ধে সারা রাত নাক বেঁধে শুয়ে থাকতে হতো। আর শৌচাগারের কথা নাই বা বললাম।

নতুন বিয়ে করেছি। স্ত্রী পড়াশোনার জন্য ঢাকায় থাকে। তাই মাদারীপুর কর্মস্থল হলেও মাঝেমধ্যেই প্রকল্প পরিদর্শনে আমাকে ঢাকা থেকে লঞ্চেই ভেদরগঞ্জ যেতে হতো। সে এক ভয়াবহ অবস্থা!

যা হোক, ভেদরগঞ্জের এক নামকরা রাজনৈতিক নেতা আমার অধীনে ঠিকাদারি করতেন। বিভিন্ন সময় কথাবার্তা এবং গল্প হতো অফিসে কিংবা কন্সট্রাকশন সাইটে। ভদ্রলোক জেল খেটেছেন অসংখ্যবার। সে কথা আবার গর্ব ভরে বলে বেড়াতেন। জেলের কথা উঠলেই তিনি প্রায়শঃ বলতেন, “বঙ্গবন্ধু জীবনের অধিকাংশই সময় জেল খেটেছেন।” আমি মনে মনে বলতাম, “কোথায় আগরতলা আর কোথায় জুতার তলা”। সাথে তলা থাকলেই কি আগরতলা আর জুতার তলা এক হয়?

ভদ্রলোক রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপুটে অনেকের সাথে বেয়াদবি করলেও আমার সাথে কখনো করেননি। আমার সাথে সম্পর্কটা প্রোফেশনালই ছিল। প্রথমদিকে মাঝেমধ্যে গল্পের ছলে যে ভয়ভীতি দেখাতেন না সেটা নয়। ভয় আমি পাই না সে কথা প্রথম রাতেই বেড়াল মারার মতো করে ভদ্রলোককে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তাই সম্পর্কটা আন্তরিকই ছিল। আমিও তার মতো বিচিত্র মানুষের কাছে থেকে অনেক কিছু জানতাম, যা আমাকে সমৃদ্ধ করতো।
একবার কথায় কথায় বললেন, “জানেন তো ঢাকা সদরঘাটের প্রায় সব পকেটমার ভেদরগঞ্জের। আপনি তো বরিশাল থেকে লঞ্চে প্রায়ই ঢাকা যান। আবার ভেদরগঞ্জ যেদিন আসেন সেদিন আমি আগেই জানতে পারি। সোর্স এই পকেটমারেরা। আপনার পকেটমার হলে আমাকে ফোন দিয়েন আমি মুহুর্তে উদ্ধার করে দেবো।”

ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। পকেটমারের সর্দার এই রাজনীতিবিদ- আমি একটু আঁৎেকই উঠলাম। কিন্তু নিজের পকেট অনেকবার কাটা গেলেও আমি কোনোদিন পকেটমার দেখিনি। তাই দেখার লোভও হলো।
আমার আগ্রহের কথা বলতেই গম্ভীর গলায় ডাক দিলেন, “এই কায়েস, ব্যাটা এদিকে আয়। স্যার তোকে দেখবো”।
আমার মাথায় হাত। কায়েস তো এই সাইটের সুপারভাইজার! কতদিন কায়েস আমার অফিসে এসেছে। আমি বললাম, “কায়েসকে কেন? কায়েসকে তো আগেই দেখেছি।”
ভদ্রলোক বললেন, “আপনি পকেটমার দেখতে চাইলেন। কায়েস তো এক সময় সদরঘাটের পকেটমার গ্রুপের নেতা ছিল।”

কায়েস সামনে এলো। কায়েসকে দেখে আমার হাতটা অজান্তেই পকেটে রাখা মানিব্যাগের উপর চলে এলো। কায়েস দু’পাটি দাঁত বের করে বললো, “স্যার, আপনাকে সদরঘাটের অনেক পোলাপ্যানকেই দেখিয়ে দিয়েছি। আপনাকে বলি নাই, হে হে। আপনার পকেট মারের সম্ভাবনা নাই, যদি চেহারা ভুল না করে।”
যতদিন ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা করেছি, পকেটটি অন্তত অক্ষত ছিল আমার। ধন্যবাদ কায়েস, কথা রাখার জন্য।
যদিও ট্রেনের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের বাসায় অনেকবার জামালপুর গিয়েছি। ফেরার পথে জামালপুরে ট্রেনে উঠার সময় আমার মানিব্যাগটি লাপাত্তা হয়েছে প্রতিবারই। শেষবার সবাইকে বলেই খালি মানিব্যাগটা জিন্সের পকেটে রাখলাম। বেশ ক’জন আমাকে উঠিয়ে দিতে এসেছে। ওদের বললাম, “এবার সাবধান আছি। দেখি কী করে পকেটমার হয়।”

জামালপুর-ঢাকা ট্রেনে এতো ভীড় থাকে যে, কখন জনস্রোতে গেইট থেকে ট্রেনের ভিতরে ঢুকে গেলাম টেরই পেলাম না। নম্বর দেখে সিটে বসেই বেশ আত্মতৃপ্তি নিয়ে পকেটে হাত দিয়েই দেখলাম- পকেট খালি, মানিব্যাগ নেই। সাথে থাকা সবাই মুচকে হাসছে। আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। শেষমেষ ভানুর কৌতুকের মতো করে বললাম, “পকেটমার এটা বুঝেছে আর যাই হোক আমি নিতান্ত ফেলনা কেউ না।”
সত্যি সেদিন ভেদরগঞ্জের কায়েসের কথা মনে পড়েছিল। আজ জামালপুরের ট্রেন স্টেশনে কায়েস থাকলে আমার পকেটটা বেঁচে যেতো।
যে কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, আমার বন্ধু ভাগ্য এক সময় বেশ বিচিত্র রকমের ছিল। অনেক বছর টিএসসি, শাহবাগ, চারুকলা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ঘুরেছি। কবিতার নেশায় পেয়ে বসেছিল। সেই সাথে কিছু গুনীজনের সাথে প্রাত্যহিক সান্ধ্যআড্ডা। সে সময়ে বেশ কিছু বন্ধু ছিল যাদের আক্ষরিক অর্থেই রাত্রিযাপনের জায়গা ছিল চারুকলা কিংবা পিজি অথবা পাবলিক লাইব্রেরির বারান্দা। সময়ের পরিবর্তনে সেই বাস্তুহীন-চালচুলোহীন বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু খামখেয়ালি এবং বাস্তব জ্ঞানবুদ্ধিহীন সেই বন্ধুগুলো যে সমাজের তথাকথিত সফল মানুষদের চেয়ে অনেক অনেক ভালো মানুষ এখন সেটি হলফ করেই বলা যায়।

আমার বিচিত্র সব বন্ধুদের মধ্যে চোর-ডাকাতের সংখ্যাও কম নয়। অনেকেই জাতীয়ভাবে, অনেকে আবার আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত বা কুখ্যাত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের প্রতিষ্ঠানে পড়াকালীন অনেক বন্ধু আজ বাংলাদেশের নামকরা চোর-ডাকাত। আমার অনেক বন্ধু আছেন বাংলাদেশে যাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তি। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রপীড়িত একটি দেশে টাকা তো আর বাতাসে ওড়ে না যে, প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা কিংবা কোন ব্যবসায়ী রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক ব’নে যাবেন?
ভেদরগঞ্জের কায়েসরা পকেট মেরে পেটভাত জুটিয়ে খায়। আমার শিক্ষিত বন্ধুরা প্রকল্পের টাকা নিজের পকেটে মেরে দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে; দেশে এবং বিদেশে বাড়ি বানায়; অনেকে আবার ব্যাংক থেকে গরীব মানুষের সঞ্চিত এবং গচ্ছিত টাকা মেরে দিয়ে বিলাসিতায় আয়েসী জীবন কাটায়। পেটের দায়ে পকেটমারা মানুষের সাথে এই সব তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সভ্য মানুষের পার্থক্য এখানেই।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)