অনলাইন ডেস্ক : এক যুগ ধরে কঠিন চ্যালেঞ্জের বেড়াজালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর আরও চাপে পড়ে দলটি। যা প্রতিষ্ঠার পর আগে কখনও এমনটি দেখা যায়নি। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি মামলা ও গ্রেফতারে নেতাকর্মীদের নাজেহাল অবস্থা। তাছাড়া দলটির শীর্ষ দুই কাণ্ডারি- চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সরাসরি পাশেও পাচ্ছেন না নেতাকর্মীরা।
সব মিলিয়ে এখন কঠিন সংকটের সম্মুখীন দলটি। এ অবস্থায় বর্তমান সংকট কাটিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে ঘুরে দাঁড়ানোই বিএনপির এখন মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতেই আজ উদযাপিত হচ্ছে বিএনপির ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৭৮ সালের এই দিনে দলটি আত্মপ্রকাশ করে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান দুঃসময়ে জনগণকে সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে হয়রানির খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার শিকার। কারণ তিনিই গণতন্ত্রের প্রতীক এবং জনগণের নাগরিক ও বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে প্রধান কণ্ঠস্বর। পাশাপাশি দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে দেশবাসীকে বিএনপির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
এদিকে বিশ্লেষকদের মতে, জনপ্রিয়তা থাকার পরও ভুল রাজনীতির কারণে এখনও ‘চোরাগলিতে’ আটকে আছে বিএনপি। দলের ভেতর বিভিন্ন ধরনের সংকটের মধ্যে করোনার ধাক্কায় আরও টালমাটাল দলটি। সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। এ থেকে উত্তরণে দলটির সামনে রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দলের ৭ম কাউন্সিল, পুরনো ও নতুন জোটের রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ, দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব কাটিয়ে পুনর্গঠন, সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বপ্রথম নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা ও মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতিতে সঠিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনতে হবে।
দলটির নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন, প্রতিষ্ঠার পর বিএনপি বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয়ে পড়লেও বারবারই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবারও দলটি ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ এ দেশের লাখ লাখ তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থক জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে রয়েছে।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, বিএনপিতে সংকটের বড় কারণ নেতৃত্বে ব্যর্থতা, বিশেষ করে সিনিয়র নেতারা দল পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তারেক রহমান লন্ডনে থাকেন। সেখান থেকে যোগাযোগটা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এতে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। উপরন্তু তাকে উপদেশ দেয়ার মতো কোনো থিঙ্কট্যাঙ্ক বিএনপি তৈরি করেনি। সবচেয়ে বড় কথা হল অসুস্থ হলেও এখনও বিএনপির কাণ্ডারি হলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু নানা কারণে দলের নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হচ্ছে না- এটাও একটা বড় কারণ।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করা কিছুটা হলেও একটা ভাবমূর্তি সংকটে বিএনপি পড়েছে। আবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই জোট গঠন করাও একটা বড় ভুল ছিল। ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে বিএনপি যে লাভটা ঘরে তুলতে চেয়েছিল তাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিত ভালো হতো।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে যৌথ নেতৃত্বে চলছে বিএনপি। গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া ৬ মাসের মুক্তি পেলেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করছেন না। আর তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করলেও তা সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। তার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিনিয়র নেতারাসহ তৃণমূলও এক প্রকার অন্ধকারে।
আবার সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, জনসমর্থন তুঙ্গে থাকলেও টানা বিপর্যয় এবং নানামুখী সাংগঠনিক দুর্বলতায় ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। সবমিলে আন্দোলনে ব্যর্থতা ও মামলার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক রকম হতাশা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সংকট তো আছেই। কিন্তু তা শুধু বিএনপির নয়, সংকট দেশের। একদিকে আওয়ামী লীগ সৃষ্ট সংকট, অন্যদিকে করোনা সৃষ্ট সংকট। বিরোধী দলকে দাবিয়ে রাখতে মামলা-হামলা-গুম-খুন কোনো কিছু বাকি নেই। এত নির্যাতন-অত্যাচার করেও বিএনপির নেতাকর্মীরা যেভাবে আগের অবস্থায় ছিল সেভাবেই আছে। নেতাকর্মীরা এখন পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বিএনপির মূল চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জনগণের রাষ্ট্র তাদের মালিকানায় ফিরিয়ে দেয়া। এই কাজগুলো করতে হলে প্রথমে গণতন্ত্রের জন্য যিনি আজীবন লড়াই করছেন সেই নেত্রী খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি প্রয়োজন। তাকে আবারও রাজনীতিতে আগের মতো ফিরে আসার পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে দেশে ফিরিয়া আনার পরিবেশ সৃষ্টি করাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, স্বাধীনতার পক্ষের এ দলটি যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করায় রাজনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। যে কোনো বিষয়ে প্রতিপক্ষ বারবার জামায়াতকে সামনে এনে বিএনপিকে ধরাশায়ী করছে। দেশের জনগণের বড় একটি অংশও বিএনপির এই কৌশল পছন্দ করছে না। তাই এখন সময় এসেছে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ত্যাগ করে বিএনপিকে আপন শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। তাহলে দেশের সুশীল সমাজসহ বড় একটি অংশের সমর্থন বিএনপি পাবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, টানা তিন দফায় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। স্বাভাবিকভাবে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিএনপির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু তাদের নেতাকর্মীরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। অবশ্য মামলা-হামলার কারণে নেতাকর্মীরা বেকায়দায় রয়েছেন। তিনি বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যা যা প্রয়োজন, তা চেষ্টা করছে বিএনপি।
দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দলটির জন্য ভালো তো বটেই, দেশের জন্যও ভালো। তবে এ সময়টা কবে আসবে, বলা কঠিন। এটাও ঠিক, জামায়াতকে ত্যাগ করতে পারলে বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না।
কর্মসূচি : করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দলের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ ভোর ৬টায় কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১১টায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ, সাড়ে ১১টায় মহানগর দক্ষিণ ও দুপুর ১২টায় উত্তরের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এছাড়া বিকাল সাড়ে ৩টায় বিএনপির উদ্যোগে হবে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা।