স্বপন কুমার সিকদার : ঐতিহাসিক সময় থেকে লন্ডনের টেমস নদী লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বিদ্বান বা বিদ্যোত্সাহী এমনকি সাধারন মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছে, মুগ্ধ বা আন্দোলিত করেছে বিভিন্নভাবে। বিশিষ্ট ইংরেজ কবি টি. এস. ইলিয়টের মনের অভিব্যক্তি:
“Sweet Thames, run softly till I end my song,
Sweet Thames, run softly, for I speak not loud or long.
Against the bridal day, which is not long
Sweet Thames run softly, till I end my song.
Sweet Thames, run softly, for I speak not loud or long”

একসময় বৃটিশ সাম্রাজ্য এত বিস্তৃত ছিল যে, বলা হতো, ‘বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না’। এমন একটি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি বা রাজধানী বা এমন একটি সাম্রাজ্যের রাজন্যবর্গের বাসভূমি ছিল লন্ডন। লন্ডন ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের ব্যবসা-বানিজ্যেরও কেন্দ্রভূমি ছিল। কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, লন্ডন এবং ইহার প্রধান ঐতিহাসিক নদী টেমস সারা বিশ্বের লোককে আরও বিভিন্ন কারণে আকর্ষণ করেছে যুগ যুগ ধরে। টেমস ইংল্যান্ডের দীর্ঘতম নদী (৩৪৬ কি. মি.) এবং সমগ্র যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় দীর্ঘতম। ইহার পানির প্রবাহ টেডিংটন পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৫৩ কিউবিক মিটার থেকে শীতকালে বৃষ্টির পর প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৩০ কিউবিক মিটার পর্য্যন্ত উঠে। টেমস্ সমগ্র বৃহত্তর লন্ডনের পানি নিষ্কাশন করে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে টেমস আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন – সমগ্র লন্ডনের দুই-তৃতীয়াংশ পরিশোধনপূর্ব খাবার পানি টেমস থেকে সংগৃহীত হয়। ইহা অর্থনৈতিক, নৌ-চলাচল, সীমানা, মত্স্য সম্পদ ইত্যাদি এবং বর্তমানে অবকাশ যাপনের বিরাট এক মাধ্যম। লন্ডনে পর্য্যটন-নৌকায় করে নদীর উভয় তীরের অপরুপা প্রাকৃতিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। ঐতিহাসিক টেমস নদীতে নৌবিহারে লন্ডন ব্রীজ পয়েন্ট থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। লন্ডনে ঐতিহাসিক টেমস নদীতে নৌ-বিহারে গিয়ে তোলা কিছু ছবি সন্মানিত পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

ঐতিহাসিক টেমস্ নদী নিয়ে বিখ্যাত ইংরেজ কবিগণ মনোমুগ্ধকর কবিতা লিখে সাহিত্য ভান্ডারকে অনেক সমৃদ্ধ করেছেন। এই ধরনের আরো কবিতার কিছু অংশ সন্মানিত পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো –
“Twenty bridges from Tower to Kew
Wanted to know what the River knew
For they were young and the Thames was old,
And this is the tale that the river told.’ – Poet Rudzard Kipling
‘Glide gently, thus forever glide,
O Thames! That other bards may see,
As lovely visions by thy side
As now, fair river! Come to me.’ – Poet William Wordsworth

যখন টেমস নদীতে নৌবিহারে ছিলাম, আমাদের বিখ্যাত বা প্রসিদ্ধ কিছু গানের কলি মনের মাঝে উঁকি দেয়। যেমন –
“আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি”।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে”। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“আমি এক যাযাবর, আমি এক যাযাবর।
…. …. ….
আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বি অট্টালিকার সারি
তার ছায়াতেই দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী
আমি দেখেছি অনেক গোলাপ-বকুল, ফুটে আছে থরে থরে
আবার দেখেছি না ফোটা ফুলের কলিরা, ঝরে গেছে অনাদরে”। – ভূপেন হাজারিকা

বাংলাদেশে যখন বিএডিসিতে সুনামগজ্ঞে কর্মরত, একদিন সিলেট রিজিয়নের প্রাক্তন নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব ইসহাক আলী সুনামগজ্ঞ থেকে বিএডিসির লঞ্চে করে হাওর উপজিলা সমূহে সরেজমিনে অফিস ও গুদাম পরিদর্শনে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। বর্তমানের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভী বাজার জিলা তখন সিলেট রিজিয়ন বা সিলেট জিলার আওতাভুক্ত ছিল। তখন হাওর এলাকার উপজিলাসমূহে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌপথ। অবশ্য শুষ্ক মওসুমে কিছু নদীর নাব্যতা এত কমে যেত যে, তখন লঞ্চের স্থলে নৌকায় করে এমনকি ঘন্টার পর ঘন্টা পায়ে হেঁটেও যেতে হয়েছে। যাইহউক, আমি উক্ত পরিদর্শনে যাওয়ার সকল ব্যবস্থা করলাম। তখন ছিল রমজান মাস। যখন আমরা যাত্রা শুরু করি, জনাব ইসহাক আলী হেসে সুন্দর একটি প্রস্তাব দিলেন।

উনি বললেন, “এইটি হলো রমজান মাস। অতএব, আমি মনে করি লঞ্চে সবাই দিনের বেলায় কিছু খাবেন না বা উপবাস করবেন”। উপবাস শরীর ও মনকে শুদ্ধ করে। আমি দেখেছি, আমার মা প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতি ও রবিবার উপোস করেন এবং উনার কোন ধরনের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস নাই। তাই, আমিও হেসে সহজেই রাজী হয়ে গেলাম। উল্লেখ্য, মা পঁচানব্বই বত্সর অনেকটা রোগমুক্তভাবেই জীবিত ছিলেন। তিনি স্বল্পাহারী ও অনেকটাই নিরামিষ ভোজী ছিলেন।

লঞ্চটি মোটামুটিভাবে বেশ বড়ই ছিল: দুইটি পৃথক বিছানা যুক্ত একটি কক্ষ এবং অন্য দুইটি কক্ষ- একটি ওয়াশরুম ও একঠি রান্নাঘর। আমরা সুনামগজ্ঞ থেকে যাত্রা করি। হাওরের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে নদী। বেলা বয়ে যায় – সূর্য্য ঢলে পড়ে নদীর ওধারে দিগন্ত রেখায়। পেটের ক্ষুধা সেও যেন তৃপ্ত অমৃত সুধায়- আহা কি সুখ, অমন সঙ্গ সুখ আসে না জীবনে বারে বারে। রবি ঠাকুরের কবিতার কথাগুলো মনে বাজে এবং অনুরনিত হয় এইভাবে – সুরমার “তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি”। সুনামগজ্ঞের হাওর এলাকা মোটামুটিভাবে এক ফসল বিশিষ্ট এবং ধান ও মাছের জন্য প্রসিদ্ধ। বর্ষাকালে হাওর এলাকা অনেকটা সাগরের রুপ ধারন করে যার মনোলোভা সৌন্দর্য্য ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব। আমরা জামালগজ্ঞ, ধর্মপাশা, মধ্যনগর, তাহিরপুর, লাখাই, আজমিরীগজ্ঞ, শাল্লা, ও দিরাইতে উপজিলা অফিস ও গুদাম পরিদর্শন শেষে আবার নৌপথে সুনামগজ্ঞ ফিরে আসি। ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বলা যেতে পারে এই ভ্রমন ছিল প্রায় সপ্তাহব্যাপী সুরমা ও অন্যান্য নদীতে নৌভ্রমণও। ফিরে, স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম কিছুক্ষনের জন্য। “ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি” মনে হচ্ছিল অনবরত পেছনে ডেকেই চলেছে – হয়তো বলেই যাচ্ছিলো “যেতে দিতে ইচ্ছা নাহি” বা “ভাবেরও লীলায় না হয় ভরিতো আঁখি, আমারে না হয় আরো কাছে নিতে ডাকি”।

সুনামগঞ্জে কর্মকালীন সময়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রশাসনিক ক্যাডারের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে সুরমা নদীতে স্বপন কুমার সিকদার (সবার ডানে)

পুনরায় যখন আমি নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে বিএডিসি, চট্টগ্রাম রিজিয়নের দায়িত্বে ছিলাম; জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম, জেলার সকল জেলা পর্য্যায়ের কর্মকর্তাগনের একটি মাসিক সমন্বয় সভা স›দ্বীপ উপজিলা পরিষদ ভবনে আহ্বান করেন। উক্ত সমন্বয় সভার প্রধান লক্ষ্য ছিল, স্থানীয় জনগনের নিকট থেকে সরাসরি উক্ত উপজিলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সমস্যা ও উত্তরনের উপায় সম্পর্কে সম্যক ধারনা ও প্রস্তাব লাভ। সভাটি স›দ্বীপ উপজিলা পরিযদ ভবনে অনুষ্টিত হয় এবং উপজিলা প্রসাশন ছিল আমন্ত্রয়িতা। আমরা জিলা পর্য্যায়ের সকল কর্মকর্তাগন একটি সুন্দর জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যাত্রা করি। তাহা ছিল খুবই অসামান্য অভিজ্ঞতা এবং বলা যেতে পারে বিস্ময়কর এক সমুদ্র ভ্রমনও। আবহাওয়া ছিল খুবই মনোমুগ্ধকর। জাহাজটি ধীরে ধীরে সামনে এগুচ্ছিল ও সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে বা বাতাসে সামান্য দুলছিল বা নাচছিল যেন মনোহারিনী এক নটিনী। সমুদ্রের মৃদুমন্দ বাতাস শরীর ও মনকে সজ্ঞীবনে রত। সামনে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল সমুদ্র। ইহার সীমাহীন ও অবর্নণীয় সৌন্দর্য্য অবলোকন করে মন নিজের অজান্তেই বলে উঠে – “দিগন্ত মেশে যেথায় নীল সমুদ্রের বুকে, সেথায় হারাতে চাই”। ব্যাকুল মন চাইলো “সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া” সবার জন্য নিয়ে যেতে।
মনে অনুনাদিত হলো – “সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম, মাগো, তোমায় ভালোবেসে”।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে আসলো আন্দ্রে নিলনের কথাগুলো- “মানুষের ভালোবাসা হওয়া উচিত সমুদ্রের মতো যা কখনো শেষ হবেনা”।
মনে পড়লো মাইকেল জনসনকেও- “যেই ব্যাক্তি সমুদ্র দেখেনি, সে জীবনে দারুণ কিছু মুহূর্ত উপভোগ করতে পারেনি”।
একসময় আসলো বিদায়ের পালা। ঐ দিকে অসীম নীল সমুদ্র যেন নীরবে কানে বলেই চলেছে-
“কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে,
আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে
…. …. ….
এই মধুক্ষণ মধুময় হয়ে না হয় উঠিত ভরে”। – গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
ঐতিহাসিক টেমস নদীতে নৌবিহার, অন্যান্য মনোলোভা নৌভ্রমনের মতো স্মৃতির মনিকোঠায় জেগে থাকবে চিরকাল। ভাল থাকুন। ধন্যবাদ।