কামাল কাদের : পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে মোর্শেদ সংবাদপত্র পড়ছিলো। বন্ধু সালাম ঝড়ের বেগে লাইব্রেরিতে ঢুকেই মোর্শেদকে বললো, “বাইরে আয়, কথা আছে। তোর জন্য একটা সুখবর রয়েছে। মকবুল সাহেবের সাথে পাকাপাকি কথা হয়েছে। খাওয়া-থাকা ফ্রি।
না, তার রেস্টুরেন্টে কাজ করতে হবে না, শুধু উনার বড় ভায়ের তিনটি ছেলে-মেয়েকে পড়াতে হবে। ঘন্টা দেড়েক পড়ালেই চলবে। বাকি সময়টা তোর ব্যারিস্টারির বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে পারবি।”
মোর্শেদের মনের ভিতরে একটা খুশীর হাওয়া বয়ে গেলো। বললো, “সালাম, তুই আমার জন্য এক বিরাট উপকার করলি ভাই। বিলেতে ফুল-টাইম ক্লাস করতে যে কি পরিমাণ টাকা-পয়সা লাগে তা তো জানিস। আগে যাও পার্ট-টাইম কাজ করা যেত, আজকাল হোম অফিসের ধাধানিতে সেও প্রায় বন্ধ।” আরে সেই জন্যেই তো যখন মকবুল সাহেবের সাথে দেখা হলো এবং কথাটা আমাকে পারলো, তখন তোর কথাটায় মনে পরে গেলো। আমার সময় হবে না বলে তোর কথাটা বললাম। তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। তুই রাজি আছিস তো?” সালাম প্রশ্নটি করে মোর্শেদের উত্তরের অপেক্ষায় রইলো। “কি যে বলিস, অরে রাজি না হয়ে যাই কোথায়।” মোর্শেদের তড়িত জবাব।
পরদিনই মোর্শেদ এবং সালাম বেড়িয়ে পড়লো মকবুল সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। টিউব স্টেশন থেকে কয়েক মিনিট পথ হাঁটলেই, চোখে পড়লো, “আলেয়া ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট”। মোর্শেদের কাছে নামটা বেশ মিষ্টি মনে হলো, তার সাথে জড়িত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লাহর শেষ জীবনের কথাও মনে পরে গেল। সদর দরজা দিয়ে দুজনে ঢুকে পড়লো রেস্টুরেন্টের ভিতর। কাস্টমার ছিলো না। শুধু দেখল এক কোণে একজন ভদ্রলোক, কাঁচা-পাকা চুল, বয়স পঞ্চাশের উপরে হবে ঢোক ঢোক করে বিয়ার গিলে যাচ্ছেন। উনিই হলেন মকবুল সাহেব। এবার পরিচয় করার পালা। সালাম মকবুল সাহেবকে লক্ষ্য করে বললো, “মকবুল সাহেব, এ হলো আমার বন্ধু মোর্শেদ, যার কথা আপনাকে বলেছিলাম। আর মোর্শেদ, ইনি হলেন মকবুল মিয়া। সাহেবরা ডাকে মিস্টার মিয়া। একটু রসিকতা করে সালাম বললো, সাহেবরা মকবুল সাহেবের ভাইঝিকে ডাকে “মিস মিয়া।” মোর্শেদ অবাক হয়ে বলে, “দেখুন সাহেবদের কান্ড! মিয়া মানেই তো পুরুষের নাম। কিন্তু বাবা বা চাচার শেষ নাম “মিয়া” থাকার ফলে ভাইজির নাম “মিয়া” হয়ে গেছে। “এ কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর মকবুল সাহেব, আসল কথায় আসলেন। তিনি বললেন, “মোর্শেদ সাহেব, আপনার সমন্ধে সালাম সাহেবের কাছ থেকে সব জেনেছি। আমার ভাইয়ের তিনজন ছেলে-মেয়ে আছে। বয়স ছয় থেকে দশ বছরের মধ্যে। ওদের আপনি বাংলা পড়াবেন, লেখা শিখাবেন। রেস্টুরেন্টের উপর তলায় আপনার থাকার ব্যবস্থা। ছেলেমেয়েরাও ওখানে লেখাপড়া করবে। আপনার ক্ষিধে পেলে নীচে এসে খেয়ে যাবেন, সব কিছুই রেডী থাকবে। তা কবে থেকে আসছেন?” “যদি বলেন, তাহলে কাল থেকেই আসতে পারি।” মোর্শেদ উত্তর দিলো। “ঠিক আছে, তবে কালই চলে আসুন।” মকবুল সাহেব জানালেন।
আস্তে আস্তে মোর্শেদ, মকবুল সাহেব এবং তার পরিবারের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলো। আর মকবুল সাহেব ও মুর্শেদের যত্নের দিকে সব সময়ে সজাগ দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগলো। অবসর সময়ে, দুজনেই নানা বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে। মকবুল সাহেব বলেন, “জীবনে অনেক পয়সা দেখলাম, কিন্তু দুঃখ যে, লেখাপড়াটা হলো না। তাই শিক্ষিত লোক দেখলেই মনে হয় তাদের জীবনটা ধন্য। যেমন ধরুন, আপনার কথা। এখন আপনি ছাত্র মানুষ, বর্তমানে বিশেষ কোনো টাকা-পয়সা নেই। তবে ভবিষ্যতে আপনি চেষ্টা করলে অগাধ রোজগার করতে পারবেন। আজ আমি চেষ্টা করলেও আপনার মতো ডিগ্রী নিতে পারবো না। সেজন্যই আপনাদের মতো লোক দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা জাগে।”
মোর্শেদ বলে, “শুধু শিক্ষত হলেই তো আর পেট ভরে না, বউকে সামলানো যায় না। তারজন্য দরকার টাকার।”
“তা কিছুটা সত্যি। বেঁচে থাকার জন্য টাকার প্রয়জোন, এতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে সেটাই জীবনের পরম পাওয়া নয়। শুধু টাকা-পয়সার মাঝে একটা শুন্যতা থেকে যায়, আর সে শুন্যতাটি হলো নিবিড় প্রাণের সুখ-শান্তি,” মকবুল সাহেব হতাশার সুরে বললেন। “হয়তোবা,” মোর্শেদের হাল্কা উক্তি।
মোর্শেদ একদিন সুযোগ বুঝে মকবুল সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলো, “যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করবো?”
“হ্যাঁ, স্বচ্ছন্দে করতে পারেন,” মকবুল সাহেব অনুমতি দিলেন।
“প্রায়ই দেখি আপনার হাতে গ্লাস ভর্তি মদ। আপনি এত মদ খান, এটা তো শরীরের জন্য ভালো নয়।”
“সেটা জানি এবং বুঝি, তবুও খাই। একটা বিপর্যস্ত অতীত কিংবা একটা চলমান জীবন থেকে নিজেকে ভুলে থাকতে চাই বা চেষ্টা করি।”
“আপনাকে দেখলেতো তা মনে হয় না।”
“অবশ্য বাইরে থেকে তা হয়তোবা মনে হয় না। আমার মনের গহীনে সব সময়ে দুঃখের আগুন জ্বলে-পুড়ে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলছে। যদি ইচ্ছে হয়, আমার মনের কথা, আমার অতিত জীবনের কথা আপনাকে শোনাতে পারি।”
“বলুন, শুনি” এই বলে, মকবুল সাহেবের অজানা জীবনের গল্প শুনার জন্য মোর্শেদ উদগ্রীব হয়ে রইলো।
মকবুল সাহেব শুরু করলেন, “বাপ্-মায়ের সাথে খুব কম বয়সে বিলেতে এসেছিলাম। লেখাপড়ার দিকে মন ছিলো না। বাপ্-মাও সে ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। তাই ষোলো বছর পার হবার সাথে সাথে কাজে নেমে পড়ি। কাঁচা বয়সে হাতে টাকা-পয়সা থাকলে যা হয়। জুয়া, মদ, মেয়েবাজি, যত রকম ব্যভিচার আর উচ্ছশৃংক্ষলায় মেতে উঠলাম। এসবের পরিণাম সবই বুঝতাম, মনে মনে ভাবতাম এক সময়ে একটি দেশী মেয়ে বিয়ে করে নিলে সবই ঠিক হয়ে যাবে। ঘটনাক্রমে এক সাদা মেয়ের প্রেমের ফাঁদে পড়ে গেলাম। আমি সত্যি মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেললাম। নাম ছিল ক্যাথেরিন। আমি তাকে ক্যাথি বলে ডাকতাম। একটা কুকুর যদি আপনি ঘরে পুষে রাখেন তাহলে দেখবেন তার প্রতিও কেমন একটা মায়া হয়ে গেছে। আর, ক্যাথি তো হলো একটা জল-জ্যান্ত মানুষ। আমি ক্যাথিকে বিয়ে করলাম। তাছাড়া জীবনের প্রথম থেকেই আমার সাদা চামড়ার প্রতি একটা দুর্বলতা যে ছিল। তাই আগে পিছে না ভেবে বিয়েটা করে ফেলেছিলাম।
সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো। আর পাঁচজনের মতো আমাদের সংসার জীবন চলে যাচ্ছিলো। ঝগড়া, মান-অভীমান, সবই হতো।
আমাদের প্রথম মেয়ে হলো, একটা বাঙালি নাম দিলাম, “ঝর্ণা।” ওর মা ওকে ডাকতো “জিনা” বলে। তারপর হলো একটা ছেলে। নাম রাখলাম, “জনি”। জিনার যখন সাত বছর তখন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলো। কোর্টের রায়ে ক্যাথি ছেলে-মেয়েদের তদারকী করার অনুমতি পেয়ে গেলো, আর আমি শূন্য সাগরে ভেসে গেলাম।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চারিদিকে থম থেমে ভাব। বীয়ারের গ্লাসে আরো কয়েকটা চুমুক দিয়ে আবার তিনি শুরু করলেন তার অসমাপ্ত কাহিনী। “বাচ্চাদের মধ্যে জিনা আমার সাথে মাঝে মধ্যে দেখা করতে আসতো। কিন্তু জনি একেবারেই নয়। সে বড় দেমাকী ছেলে। আমাকে বলতো, আন কালচারড ব্লাকমান, চাষা কালো লোক কিছুতেই আমার বাবা হতে পারে না। ছেলের কথা শুনে রাগে থর থর করে গাঁ কাঁপতো। আমার ছেলে আমকেই বলে কিনা চাষা, কালো। জুতো পিটা করতে ইচ্ছে জাগতো। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, যে সমাজের লোক আমরা, মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো কিছুই করার ছিল না। মেয়েটার জন্য স্বভাবতই আমার অফুরন্ত মায়া ছিল। ভাবতাম ওকে একটা ভদ্র, শিক্ষত বাঙালি ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবো। আমার ভাবা ওই পর্যন্তই। একদিন জিনা সাথে করে এক সাদা ছেলেকে নিয়ে এসে বললো, “ড্যাডি, এ হলো নিকি, আমার হাসব্যান্ড। আজ সকালেই আমরা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেছি।” জিনা ওর কথায় ক্ষান্ত হলে, নিকিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
“তা নিকি তুমি করো কি?” “লোকাল কাউন্সিলে বিন কালেকটিং করতাম, এখন চাকরি নেই।” নিকির জবাব।
মোর্শেদ সাহেব তখন আমার অবস্থাটা কি, তা তো বুঝতেই পারছেন।”
“জি,” মুর্শেদ সংক্ষেপে উত্তর দেয়।
“মোর্শেদ সাহেব, সময় চলে যায়। একদিন শুনলাম, ক্যাথি আবার বিয়ে করেছে এক গোরা সাহেবকে। আমার ছেলে জনির যখন নয় বছর ছিল, তখন ওকে শেষ দেখা দেখেছি। তাছাড়া ওকে আর দেখার ইচ্ছা কখনো জাগে না। আগেই বলেছি মেয়েটার জন্য সব সময়ে মায়া হয়। এক সময়ে জিনার কোলে এক ফুট ফুটে ছেলের জন্ম হলো। অর্থাত আমার নাতি। নিজেকে গ্রান্ডফাদার ভাবার সুযোগ পেয়ে গর্ববোধ করলাম। হাজার হলেও আমারই তো বংশধর। পরে কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, সত্যিই কি বাচ্চাটি আমার বংশধর? মনে কোনো সদুত্তর পাইনি।”
কিছুক্ষণ আবার নীরব থেকে হতাশার সুরে বললেন, “একদিন জিনা আমার রেস্টুরেন্টে এসে হাজির। ও বললো, ওর স্বামীর সাথে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ভাবলাম সবই আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত।
তা না হলে আমার জীবনে এতো দুঃখ হবে কেন? জিনা এখন পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। লোকদের কাছ থেকে হাত পেতে পয়সা চায়। পাড়ার বখাটে ছেলেদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মদ খায় আর সিগারেট ফুকে। তাই মোর্শেদ সাহেব মদ খেয়ে জীবনের দুঃখ কষ্টটাকে ভুলতে চাই। খেলে মনে হয় কিছুটা বুঝি শান্তি পেলাম। আদতে কি তাই? মনে হয় না। আসল কথাটা কি মুর্শেদ সাহেব, জীবনের এই যে ঘটনা গুলি ঘটে চলছে এগুলি হলো, নিজের ভুলের মাসুল। এখন খুব দেরী হয়ে গেছে। সংশোধন করার আর কোনো সুযোগ নেই।” এই বলে মকবুল সাহেব খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন। মুর্শেদ লক্ষ্য করলো, মকবুল সাহেবের চোখ দুটি জলে ছল ছল করছে। সেই সাথে মকবুল সাহেবের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের তপ্ত হাওয়া যেন মোর্শেদকে ছুঁয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেলো ক্ষণিকের জন্য। শেষ
লেখক : কামাল কাদের।
ই-মেইল : quadersheikh@gmail,com
ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড