হোসনে আরা জেমী : রায়না যখন কানাডা থেকে বাংলাদেশ আসে। রায়নার নানা মোকবুল হোসেনের সেদিন থেকেই বাসয় বন্দী হয়ে যান। রায়নার নানুবাড়ি বগুড় সদর থানার মালতীনগর। যে কনো কাজে বাহিরে যাওয়াও বন্ধ থাকে। কারণ, নানুভাই যে একটা গল্পের খনি। এই খনিতে গল্পের কোন শেষ নেই। ওটা রায়না জানে। আজকে রায়নার জানার বিষয় এই পুরোন এ্যালবামের ছবিগুলো নিয়ে। নানা ভাই বলল, এখানে যে সবচেয়ে খাটো দেখছো ওর নাম হাবলু। নামে হাবলু হলোও আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চঞ্চল। আর যাকে লম্বা দেখছো তার নাম আবুল। আবুল মানে কিন্তু বোকা না ও এমন কিছু কাজ করে যা আমাদের ধারা সম্ভব না। এই ছবিটার দুইজনের নাম আব্বাস ও জব্বার। হঠাৎ সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের জন্য জুন মাসে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। আবুল ভাই, সব সময় মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়ার কথা বলতো আমাদেরকে নিয়ে নিজের একটা বাহিনী তৈরি করতে চাইতো।

সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে না পারলে ১২/১৩ বছরের ছেলেদের নিয়ে নিজেই একটা মুক্তি বাহিনীর মত গঠন করবে। তার চিন্তা ছিলো পাক বাহিনীরা সাধারণত ছোটদের তেমন একটা সন্দেহ করবে না। হাবলু ছিলো চরম অভিনেতা ও বুদ্ধিমান, কার সাথে কিভাবে কথা বলে বোকা বানাবে তা বয়স্ক মানুষের বোঝা খুব কঠিন যদিও মানুষ তাকে বোকা মনে করে আর বাবলু সেই সুযোগটাই কাজে গালাতো। আব্বাস ও জব্বার এই দুইজনকে আমি দায়িত্ব দিলাম স্কুল ক্যাম্পে সেনাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার বেশ কিছু কৌশল শিখালাম। এমন একটা ভাব নিতে বললাম যেন, দেশে যে যুদ্ধো হচ্ছে বা তারা যে আমাদের শত্রæ তা যেন আমরা জানিই না। হাবলুর বুদ্ধিমত্তা আর অভিনয়টার জন্য ক্যাম্পের সব সেনারা আমাদের বোকা ভেবে আদর করতো। সেই সুযোগে আমরা পুরো ক্যাম্পে কোথায় কি আছে জেনে নিলাম সেইসাথে আমরা আমাদের কাজ চালিয়া যাই।

হঠাৎ হাবলু মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যাবার বেলা সবাইকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে বলে তোদের নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন, আমার দেখা সময়ের সবচেয়ে সাহস সৈনিক তোরাই। তোদের সাথে অনেক বছর বাঁচতে কিন্তু যদি আমার কিছু হয়ে যায়। তাহলে আমার জন্য কাঁদবি না, দেশটা পাকবাহিনী মুক্ত করিস। বেঁচে থাকলে আবারও আবারও দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ। কিছুদিন পর আমরা হাবলু ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পাই। সঙ্গিদের মধ্যে অনেকেই গ্রাম ও দেশ ত্যাগ করেছে। কিছুদিন সবাই থমকে থাকলেও নতুন করে আমি মানে তোমার নানা ভাই সবাইকে সাহস যোগাই। আমাদের গ্রামটা পুরো পাকসেনাদের নির্যাতনে ধরাশায়ী। আমরা চুপিচুপি মুক্তিবাহিনী খুঁজতে শুরু করি। আমরা পরিকল্পনা করি মুক্তিবাহিনীর সাথে দেখা হলেই তাদের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা হামলা করবো। কয়েকবার মৃত্যুর কাছ থেকে বেঁচে ফিরেছি। একবার আমরা তিনজন এক অপারেশনে গেলাম। কিন্তু শূন্য হাতে তো যুদ্ধ সম্ভব না।

কিছুদিন পর গ্রামে ওপারে মানে নদীর ওপারে মুক্তিবাহিনীর একটা দল এসেছে গোপনে জানতে পারে মোকবুল হোসেন। গভীর রাতে নদী পাড় হয়ে ওপারে গিয়ে খোজ করতে থাকে মুক্তিবাহিনীর দলটাকে। হাবলু যাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হয়েছিল এই দলটিই সেই দল মৃত্যুর আগে হাবলু মোকবুল হোসেনসহ অনেকের কথা বলে গিয়েছিল কমান্ডার মোসারফ, সহযোদ্ধা ফরিদকে। মোকবুলদের খুঁজে পেলে দোবাড়িয়াই যুদ্ধটা জয় করা সহজ হয়ে যাবে।

অপরিচিত মোকবুলকে এপারে ঘোরাঘুরি করতে দেখে একজন ছদ্মবেশি মুক্তিযোদ্ধা জিজ্ঞ্যেস করে তুমি কে আর এখানে এভাবে ঘোরাঘুরি করছো কেন? যে কোন সময় বিপদ হতে পারে। মোকবুলের সোজা সরল জবাব জয় বাংলার লোক খুঁজি। ছদ্মবেশের মুক্তিযোদ্ধা সামান্য হেসে বলে পুরো দেশটাই তো জয় বাংলার লোক। মোকবুল প্রতিবাদ করে না পুরো দেশ হলে আমাদের গ্রামে মিলিটারি ক্যাম্প কেন?

মোকবুলের কথা শুনে ছদ্মবেশি মুক্তিযোদ্ধা বুঝতে পারে ছেলেটা জয় বাংলার পক্ষে। তাই সিদ্ধান্ত নিলো কমান্ডারের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়। তবুও আরো শিউর হতে হবে। তাই নানাবিধ প্রশ্ন করে ছেলেটা কেন সে চরম ক্ষুব্ধ পাকবাহিনী উপর। তাই সিদ্ধান্ত নেয় কমান্ডার মোসারফের কাছে মোকবুল কে নিয়ে যাবে। মোসারফের কাছে মোকবুলকে নিয়ে যায় ফরিদ কমান্ডার তাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় স্থানটি নিরাপদ রাখতে বাহিরে কৃষক সেজে পাহারা দিতে। মোকবুলের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে কমান্ডার মোসারফ। দোবাড়িয়া যুদ্ধটা সহজ করে দিলো মোকবুল, কারণ পাকবাহিনীর ক্যাম্প সম্পর্কে তার আগেই ধারণা আছে নতুন করে রেকি করার প্রয়োজন নেই।

বেশ কিছুদিন ট্রেনিং নেয়ার পর মোকবুল তার সহপাঠীদের নিয়ে আসার অনুমতি চায় কমান্ডারের কাছে কমান্ডার অনুমতি দেয় একটি শর্তে মোকবুলের সাথে যাবে ফরিদ আর সময়টা গভীর রাতে। শর্তে রাজি হয় মোকবুল। মোকবুল আবুল, জব্বার ও আক্কাসকে গভীর রাতে চুপিচুপি ডেকে তুলে এবং বিস্তারিত বলে। তারা কেউ বাড়ি থেকে অনুমতি নেয়নি বা নিতে চায়নি, লোক জানাজানি হবার ভয়ে। গভীর রাতে সবাই ছুটে চলে মুক্তিযুদ্ধাদের অস্থায়ী ঠিকানায়। তিনজন কিশোরের কাছে বিস্তারিত শুনে আগামী সপ্তাহেই পাক বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করতে চায় কমান্ডার মোসারফ।

শুধু বৃষ্টির অপেক্ষায় আছে মুক্তিযোদ্ধারা পরের দিনই সকাল থেকে বৃষ্টি সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধার দলটি দোবাবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে তখন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। তারা অপেক্ষা করে রাত গভীর হবার জন্য। সময়ের সাথে সাথে রাত গভীর হয়। কমান্ডার আক্কাস ও জব্বারকে পাকবাহিনীর ক্যাপের পিছনে অবস্থান নিতে বলে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে কমান্ডার ও অন্যরা। প্রথম গুলির শব্দের সাথে সাথে আক্কাস ও জব্বার গ্রেনেড হামলা করবে একের পর এক সামনে থেকে যুদ্ধ করবে কমান্ডারের সাথে থাকা লোকজন। ক্যাম্পের উত্তর পাশ দিয়ে গ্রেনেড হামলা করবে মোকবুল। পাকবাহিনী কিছু বুঝতে উঠার আগেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেলো, মোকবুল, জব্বার ও আক্কাস গ্রেনেড হামলা শুরু করে দিশেহারা অবস্থা পাকবাহিনীর শত শত সৈনিক অত্যধিক এল এম জি মটার ভারী অস্ত্র দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছে। যুদ্ধ চলছে তুমুল যুদ্ধ। এক একসময় সকলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ কমান্ডার বুঝতে পারেনি দলটি সংখ্যায় বেশি এবং তাদের অস্ত্র এতো বেশি। এই মুহূর্তে আবুলই শেষ ভরসা সবাইকে বাঁচানোর শুধুমাত্র আবুলের কাছে কয়েক রাউন্ট গুলি আর কয়েকটি বোমা। আবুল কমান্ডারকে বলল, আপনারা দক্ষিণের ঝোপে চলে যান। ততক্ষণে আমি সামনেরটা সামলিয়ে চলে আসবো। বিষয়টা আবুলের জন্য বিপদ কিন্তু এটা না করলে দলের সবাই মারা যাবো। যুদ্ধটা এতোটাই ভয়াবহ ছিলো যে, সর্বশেষ আবুল চিল্লায়ে বলল আমি শহিদ হতে চাই কিন্তু তোমরা যদি এখানে থাকো তাহলে সকলের মৃত্যু হলে দেশ স্বাধীন হবে কী করে। দয়া করে নদী পার হয়ে চলে যাও। ততক্ষণে মোকবুল ঢুকে পড়ে পাকবাহিনীর অস্ত্র ঘরে। কারণ পাকিস্তানিরা যুদ্ধে ব্যস্ত। অস্ত্র রাখার ঘরে কেউ নেই। ঘরে ডুকে মোকবুল ভয় পেয়ে যায় কারণ ঘরে আরও দুইজন মানুষ। পরে বুঝতে পারে এরা আর কেউ নয় তারই বন্ধু আক্কাস ও জব্বার। গ্রেনেড নিয়ে তারা দ্রæত ঘর থেকে বের হয়ে যায়। একের পর এক গ্রেনেড হামলা শুরু করে কমান্ডার পিছু হটতে গিয়ে চিন্তায় পড়ে পাকবাহিনীর উপর এতো গ্রেনেড হামলা কে করছে? তবে কি অন্য কোন দল তাদের সাথে যোগ দিয়েছে?
আর তখনই হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে আবুলের বুকে। হঠাৎ করে পাকিস্তানের সেনারা গুলি ছুঁড়ছে না। কিন্তু গ্রেনেড হামলা চলছে বিরতিহীন। কিছুক্ষণ পর যুদ্ধ থেমে যায়। কমান্ডার এগিয়ে আসে। মোকবুল আবুলের কথা বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি ঝরে। রায়না চুপ কোন কথা বলে না।
হোসনে আরা জেমী : লেখক ও বাচিকশিল্পী, টরন্টো, কানাডা