আমরা কোনো কিছুর বুৎপত্তি থেকে মধ্য গগনটাকে যদি অর্জনের চূড়ান্ত বা শেষ বলি তাহলে সেটা কবি জাহানারা বুলার বেলায় প্রযোজ্য হবে না! এবারের একুশের বইমেলায় কবির যে বইটি পাওয়া যাচ্ছে সেটির নাম: “ভালোবাসি” একটি অশুদ্ধ শব্দ! এবারে কবি তাঁর কবিতার যে সম্ভার আমাদের জন্যে সাজিয়েছেন, পরিবেশন করেছেন তা পড়ে পাঠকের মনে এই ধারণাটা বদ্ধমূল হবে নিশ্চিতভাবে যে তাঁর কবিতায় ঋজুতা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে! তাঁর প্রেম, ভালোবাসা, আর জগৎ ভাবনার পরিচিত পরিধিতে একটা পরিণত মন প্রশ্ন আর উত্তরের কথোপকথনে নিয়োজিত হয়েছে! তাই কবি জাহানারা বুলার কবিতায় এসেছে কখনো আটপৌরে, আর কখনো সাহসী শব্দাবলী! কখনো মিছিলে যাবার আহবান আবার কখনো ফিরে আসার এবং আবার প্রেমে নিমগ্ন হবার আমন্ত্রণ! কবি জাহানারা বুলা যে তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষের মধ্যগগনে অবস্থান করছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই! এবং এটা আমরা নিশ্চিতভাবে আশা করতে পারি যে আমরা তাঁর কাছ থেকে আমাদের ভালোলাগা কবিতাবলী পেতে থাকবো নিরন্তর!

কবি জাহানারা বুলার কবিতাবলী যেন একজন পটুয়ার আঁকা ছবি! কবি আমাদের মনের ভালোলাগা কিংবা বিসর্জনের ছবি আঁকায় সিদ্ধহস্ত!
“আমরা বরং অনাড়ম্বর থাকি
আনন্দগুলোকে চোখের তারায়
ঝিকিয়ে উঠতে না দিই জোনাকির আলোর মতো,
কষ্ট যদি থাকে তাকে ঘুমোতে দিই
নবজাতকের বন্ধ মুঠোয়।
প্রচলিত প্রচার-উন্মুখ প্রেমের ইতিবৃত্ত না হই আমরা
কবিতা এবং স্মৃতির পাতায় শ্বাসপ্রশ্বাস হয়ে রয়ে যাক
আমাদের ভালোবাসা।”
কবি কষ্টের ছবিও আঁকেন প্রচন্ড রকমের স্পষ্টতায়!
“মেঘময় আকাশ আর রোমাঞ্চিত করে না আমায়
ফুলের উপর প্রজাপতির চঞ্চলতা আমাকে স্থবির করে
বৃষ্টি যে সোনামুখ সুচ –
ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না আর
হৃদয় মচমচে নেই
তোমার মুঠোয় মড়মড় করে ভেঙে পড়ার
ন্যাতানো জীবন এখন ভালো থাকার অর্থ খুঁজে বেড়ায়।”
আমরা যারা কবি জাহানারা বুলার কবিতার ভক্ত তাদের জন্যে তাঁর এবারের কাব্য গ্রন্থ একটি সুখপাঠ্য প্রকাশনা এবং আয়নায় আমাদের নিজেদের মুখ দেখার তাগিদ সৃষ্টির সহায়ক!
কবি তার এবারের প্রকাশিত কবিতাবলীতে ব্যবচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হয়েছেন ভালোবাসাবাসির হৃদয়কে! প্রশ্ন ছুড়েছেন নিজের দিকে, প্রেম কিংবা ভালোবাসায় নিমগ্নদের প্রতি!
“পথের ধারে ঘুমিয়ে রাত কাটে যার
তার কাছে পেলব বিছানা অর্থহীন, অচেনা
আমাদের আকাক্সক্ষাও আজ স্মৃতির হরিণ।”
কোভিড কালীন অন্তরীণ সময়ে নিজের দিকে তাকানোর যে সময় পাওয়া গিয়েছিলো সেই সময়ের উপলব্ধিতে কবি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন:
“তোমার হৃদয় দেখতে চাই মৌনতায় আবৃত
দেখতে চাই তোমার ক্ষরণের রং
মনুষ্য রক্তের মতো লাল কিনা?
শুধুবুঝতে পারি না কতটা ধারালো ঘৃণা ছুড়ে দিলে
হৃদপিন্ড এফোঁড় ওফোঁড় হবে
অথবা,
কতটা ভালোবাসা দিলে
একটি বেগুনি পুকুর হবে কচুরী ফুলের।”
এরপর কবি হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা “ভালোবাসা”র দিকে আরেকবার তাকিয়ে পরখ করেন,
“জানা ছিল ‘ভালোবাসি’ একটি অশুদ্ধ শব্দ
প্রলুব্ধ করার প্রয়াসে পরীক্ষালন্ধ শব্দ এটি
মূলত এর কোনো মানে নেই অভিধানে।”
কবির এবারের কবিতাবলীর অধিকাংশতেই তার নারীসত্বার উন্মেচিত রূপ আমরা দেখি। যে নারীকে দেশ, মিছিল, ক্ষুধার্ত শিশু, অনাহার, নারীর অবমাননা, পুরুষের নারী-দেহ কেন্দ্রিক প্রমত্ততা কষ্ট দেয় এবং সেখানে তিনি সাহসী প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন!
“¯øাম ডগ প্রতিক্ষণেই এক উৎকৃষ্ট ডকুমেন্টারি
নারীরা উলঙ্গ শুয়ে থাকে, হাড্ডিসার শবদেহ
বাতাসবিহীন বেলুনের মতো
দুগ্ধশূন্য নেতিয়ে পড়া স্তন মুখে
লালা ঝরে অনাহারী শিশুর
উপরন্তু শিশুটিই হয়ে যায় চিল আর শকুনের খাদ্য।
প্রামাণ্য ছবির চিত্র প্রতিভা
আরো কিছুধাপ এগিয়ে যাক না কেন?
মনের হরষে এনাকন্ডা হয়ে ওঠা পুরুষ
নারীদের আপাদমস্তক গিলে খাওয়া
সৎ পুরুষদের জীবনবৃত্তান্ত কি প্রামাণ্য নয়?”

এমন একটা পৃথিবীর ছবি কবি জাহানারা বুলার কল্পনায়, স্বপ্নে এবং নিত্যদিনের আকাঙ্খায় চোখের সামনে সর্বদা ঝোলানো যেখানে,
“বীজ চাই পুষ্পিত কাব্যের আমার’ই মাতৃভূমে তার।
আমি তো মানুষ
রক্ত-মাংস-মেমব্রেনে গড়া সম্পূর্ণ রমণী আমি।”
কবি তাঁর বর্তমান পারিপাশ,পরিবেশ আর পরিচয়ের পরিধি সম্পর্কে সচেতনতার প্রেক্ষিতে প্রস্তাব রেখেছেন,
“আমরা বরং নতুন একটি খেলা খেলি
দুজনেই দুটি পথের বাঁকে দাঁড়াই,
অপেক্ষা করি অন্য কোনো ভালোবাসার এবং প্রেমের।”
কবি জাহানারা বুলার কবিতা প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ এবং নারীর ম?্য্যাদার জন্যে প্রতিবাদ মুখর! কিন্তু নিখাদ বন্ধুত্বও তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ!
“কাছে আসব না, বলিনি তো!
একদিন চায়ের কাপে ঝড় তুলব,
সিঙ্গাড়ার আলু-বাদাম খুটে খেতেখেতে
চোখ তুলে বারবার তোমাকেই দেখব,
হাতটাও ধরব
মুখোমুখি বসে থেকে এপারে ওপারে সেতুগড়ে তুলব
বন্ধুত্বে এটুকুই গভীরতা ভালো।”
কবির একান্ত আন্তরিক কামনা,
“তুমি ঘরের দাওয়ায় প্রজ্বলিত রোদে বসে স্পষ্ট হও আরো,
ক্ষেত পাথারের দোলায়িত চিত্তরথে চড়ে আমার শুভকামনারা
তোমাকে ছুঁয়ে আসুক।”

এবং সবশেষে, পরিণত কবি জাহানারা বুলার কবিতায় হৃদয়ের আবেগ আর অনুভূতির ছবি সম্মৃদ্ধ কবিতা আমরা পেতেই থাকেবো এই আশাবাদ আমরা নিঃসন্দেহে ব্যক্ত করতে পারি! কেননা কবি জানিয়েছেন,
“যদি সূর্য উদিত হয়
সে অপেক্ষায় বসে আছি আজও
ঘর ছেড়ে এই দাওয়ায়।”
চমৎকার দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদে মোড়ানো কবি জাহানারা বুলার কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছেন কবি আসাদ চৌধুরী।
আশরাফ আলী