ভজন সরকার : ধর্ম বিশ্বাস মানেই যুক্তিহীন বিশ্বাস। ধর্মীয় বিশ্বাস একেবারেই অলৌকিক এবং প্রমাণহীন, যাকে অনেকেই অন্ধ বিশ্বাস বলেই অভিহিত করেছেন। যার পেছনে কোনোরূপ প্রমান খাঁড়া করা যাবে না, তা ধর্ম হোক কিংবা হোক না বিজ্ঞান বা দর্শন, তা নিয়ে তর্ক করা কিংবা তাকে প্রমান করার চেষ্টা করা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়। অথচ যুগযুগ ধরে এই প্রমাণহীন-যুক্তিহীন বিশ্বাস নিয়ে চলছে ধুন্ধুমার কান্ড। ধর্ম বিশ্বাসীরা মুক্তকচ্ছ হয়ে প্রমাণহীন কাল্পনিক মনোজগতের বিষয়কে অকাট্য প্রমাণ করতে কী বিবাদ-বিসম্বাদটাই না করছেন।

কার বিশ্বাস শ্রেষ্ঠ সেটি প্রমান করতে অন্যকে করা হচ্ছে হেয়। অন্যের বিশ্বাসের প্রতি হানা হচ্ছে আঘাত। বিশ্বাস তো কোনো বস্তু নয়, এটা অনুভূতি বা বোধের ব্যাপার। তাই বিশ্বাসকে অর্থাৎ অনুভূতিকে আঘাত করা সম্ভব নয়। আঘাত করা হয় প্রকারান্তরে মানুষকে যারা অন্য বিশ্বাসে বিশ্বাসী। তাই যুগযুগ ধরে নিজনিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে তৈরী করা হয়েছে প্রায় দুর্ভেদ্য বাতাবরণ। অথচ আমরা কেউ-ই মানতে রাজি নই যে, আমাদের সবার বিশ্বাসই অলৌকিক; আমাদের সবার বিশ্বাসই প্রমানহীন অন্ধ বিশ্বাস।

কানাডাতে আরেকবার উচ্চশিক্ষা শেষ করে চাকুরী পেলাম নিভৃত এক জনপদে। চার-সাড়ে চার হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত সোনার খনির শহর। খনি এবং বিলুপ্তপ্রায় কাগজের মন্ড উৎপাদন শিল্পকে ভিত্তি করেই বিংশ শতকের প্রথম দিকে গড়ে উঠেছিল এ জনপদ। পাঁচ-দশ মাইল বেষ্ঠনীতে বেশ কিছু আদিবাসী বা ফার্স্টনেশন্স ওজেবয়দের বাস। নিকটবর্তী বড় শহর দু’টোর দূরত্ব একদিকে ৩০০ কিলোমিটার , অন্যদিকে ৪০০ কিলোমিটার। পৃথিবীর সর্বোবৃহৎ মিষ্টি জলাধার লেক সুপিরিয়রের প্রায় ৪ কিলোমিটার পেটের ভিতরে গড়ে ওঠা এই ছোট্ট শহরটি। আর সব খনি শহরে যা হয়, এখানেও মানুষের স্বাচ্ছ্যলতা চোখে পড়ার মতো। ঝা চকচকে আধুনিক মডেলের গাড়ি। ছোট পরিসরে হলেও অত্যাধুনিক নামকরা ব্র্যান্ডের কিছু দোকান। লেক ঘেঁষেই আন্তঃকানাডা মহাসড়ক ১৭-এর পাশে গড়ে ওঠা আবাসিক হোটেল। ছিমছাম একটি ছোট বিমানবন্দর, যেখানে নোঙর করা কিছু সীমিত সিটের বিমান। আর উল্লেখ করার মতো কয়েকটা অপূর্ব স্থাপত্যকৌশলের গির্জা, যদিও এই মাত্র ১০০ বছরেই প্রায় সবগুলো উপাসনালয়ের প্রতিই মানুষের এক ধরণের উদাসীনতার সুস্পষ্ট লক্ষণ।

কানাডায় চাকুরীর অভিজ্ঞতা তখন একেবারেই নেই আমার। বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে কিছু বছরের অভিজ্ঞতা আর কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’দুটি ডিগ্রি সম্বল করেই প্রায় অসম্ভব এবং দুঃসাহসিক এক কর্মজীবন শুরু করলাম। শহরের প্রায় সব পরিসেবা যে বিভাগের অধীনে সেই পাবলিক ওয়ার্কস বিভাগের প্রধান। এই চ্যালেঞ্জিং কাজটা করার জন্য আমার উপর যিনি আস্থা রেখেছিলেন, তিনি প্রায় সত্তর-উর্ধ্ব এক ভদ্রমহিলা। যিনি সদ্য একটি নামকরা সরকারী কর্পোরেটের প্রধান হিসেবে অবসর নিয়েও শহরের মেয়রের অনুরোধে আর্থিক ঋণে ডুবতে বসা এই শহরটির প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়েছেন।

বিশ্বাস নিয়ে বলতে গিয়ে এতো সব গৌরচন্দ্রিকার মূলেও সেই ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলার ছেলে-মেয়েরা সব প্রতিষ্ঠিত, যে যার মতো নানা জায়গায় কর্মস্থলে। বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে থাকেন অফিসের পাশেই এক আবাসিক এলাকায়। আমিও সেখানেই থাকি। অফিস থেকে বেরোলেই আমাদের আবাসস্থল। তাই অফিস শেষে ম্যানেজমেন্টের সবাই বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিই। আড্ডার বিষয় বড় বিচিত্র। অধিকাংশই সময়ই খেলাধুলা, হকি, বাস্কেটবল, টেনিস, গলফ আর আমি থাকাতে যুক্ত হলো ক্রিকেট। সৌভাগ্যক্রমে দু’একজন ক্রিকেট বিষয়ে পরিচিত। ফুটবল নিয়েও আলোচনা হতো এক ইটালিয়ান বংশোদ্ভুত এক ভদ্রলোক থাকাতে।

আড্ডাতে দু’টো জিনিস নিয়ে কথা বলা বারণ ছিল। এক, ধর্ম এবং দুই, রাজনীতি। আমার বস সেই ভদ্রমহিলার খুব সহজ সরল যুক্তি ধর্ম এবং ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে , যা আমাকে আপ্লুত করতো। ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলতেন, এ এক অলৌকিক অন্ধ বিশ্বাস। প্রায় সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গোড়া খুঁড়তে গেলে দেখা যাবে সব কিছুর ভিত্তিই মনগড়া। কিছু কাল্পনিক কাহিনি এবং কাল্পনিক চরিত্রের উপর ভিত্তি করে প্রচলিত ধর্মগুলোর গড়ে ওঠা। অথচ এই চরিত্রগুলো আদৌ ছিল কিনা, সেটারও নৃতাত্ত্বিক কোনো প্রমান নেই। সবই মুখে মুখে। কিছু আঞ্চলিক কল্পকাহিনিকে পরবর্তীতে শাসন এবং শোষণের জন্য কাজে লাগানো হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে গোষ্ঠীগত শক্তি বৃদ্ধির জন্য। অথচ সব ধর্মেরই মূল চরিত্র আদৌ ছিল কিনা সেটির বস্তুনিষ্ঠ কোনো অকাট্য প্রমাণই নেই। যার ভিত্তি নেই, সেই ভিত্তিহীন বাতাসে ভেসে বেড়ানো জিনিস নিয়ে তর্ক করা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

সুদীর্ঘ কর্মজীবনে অনেকবার “দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল উইমেন’ জাতীয় খেতাবপ্রাপ্ত এই ভদ্রমহিলার কথাগুলো আজো কানে বাজে। আসলেই তো যতদিন যাচ্ছে, অসার ধর্ম বিশ্বাস ক্রমশ আরো ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ে যা মনে করা হতো অলৌকিক কোনো শক্তির কাজ, এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান সে শক্তির পেছনে যুক্তি-ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমান করছে আসলে কিছুই অলৌকিক নয়।

অজ্ঞানতা থেকেই বিশ্বাসের জন্ম। আর অধিকাংশ মানুষের এই অজ্ঞানতাকে কিছু মানুষ ব্যবহার করে এসেছে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। একদিন যে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে গোষ্ঠীবদ্ধ করা হতো, এখন সেই ধর্মই মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

মানুষের মধ্যে গড়ে তুলেছে বিভেদের দেয়াল। মানবিকতাকে করে ফেলেছে খন্ডিত।
আমরা অনেক সময় আস্থা আর বিশ্বাস শব্দ দু’টোকে গুলিয়ে ফেলি। আস্থা মানে পূর্বের অভিজ্ঞতা কিংবা প্রমানিত বিষয়কে মেনে নেওয়া। আস্থাশীল বিষয় সবার কাছেই এক ও অভিন্ন। কিন্ত বিশ্বাসের পেছনে যেহেতু কোনো প্রমান নেই, তাই প্রত্যেক মানুষের বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন।

এক সময় ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু এখন সেটিও নেই। শুরু হয়েছে বিশ্বাসে বিশ্বাসে দ্বন্দ-সংঘাত-হানাহানি-নৃশংসতা। কার বিশ্বাস শ্রেষ্ঠÑ এটা প্রমান করা কিংবা নিজের বিশ্বাসীদের দলভারী করার চেষ্টাই সর্বনাশের মূল কথা। অথচ ৫০০ বছর আগে মধ্যযুগের এক বাঙালি কবি বড়ু চন্ডীদাস বলে গেছেন, ‘শোন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )