ভজন সরকার : দাদুকে কিছুতেই বিশ্বাস করানো যায় না যে, যোগেন মন্ডল আর এ দেশে নেই। এমন কি বেঁচেও নেই!

আমি একটু আগ বাড়িয়ে দাদুর কানের কাছে গিয়ে বলি, “দাদু, তোমার যোগেন মন্ডল ভারত-পাকিস্তান ভাগের পাঁচ বছর পরেই ভারতে চলে গেছে। মারা গেছেন আরও চল্লিশ বছর আগে।”

দাদু কেনো যোগেন মন্ডলকে এতোটা বিশ্বাস করতেন, আমি সেটা দাদুর কাছ থেকে সরাসরি জানতে পারিনি। আমি যখন বুঝতে শিখেছি, তার আগেই দাদু স্মৃতিভ্রম হয়ে অবুঝ হয়ে গেছেন।

দাদুর স্মৃতি এখন সেই সময়ে স্থির হয়ে আছে যখন যোগেন মন্ডল অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী। দাদু যোগেন মন্ডলের হয়ে দেশ ভাগের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। বর্ণ হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের পায়ের তলায় পিষে মারতে চায় বলেই অবিভক্ত ভারত চায়। দাদু এলাকায় এলাকায় তপশিলী হিন্দুদের পক্ষে যোগেন মন্ডলের কথা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

দাদু গ্রামে গ্রামে ঘুরেঘুরে প্রচার করছে, “দেশ ভাগ হয় হয়ে যাক। বর্ণ হিন্দুরা হিন্দুর দেশ ভারতে ইচ্ছে হলে যাক, কিন্তু নিম্ন-বর্ণের মানুষেরা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে কিছুতেই যাবে না। আমাদের নেতা যোগেন মন্ডলের সাথে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর কথা হয়েছে । আমরা মুসলমানদের সাথে বাস করবো কিন্তু বর্ণ হিন্দুদের সাথে ভারতে যাব না।”

“নিম্নবর্ণের হিন্দুদের যথাযোগ্য মর্যাদায় সদ্য-গঠিত পাকিস্তানে রাখব’- জিন্নাহ সাহেব যোগেন মন্ডলকে কথা দিয়েছেন। সেই কথার বরখেলাপ যেন না হয়, তাই জিন্নাহ মুসলমানের পাকিস্তানে হিন্দু যোগেন মন্ডলকে মন্ত্রীর বড় পদ দিয়েছেন। যোগেন মন্ডলের এ কথা দাদু আন্তরিকতার সাথেই বিশ্বাস করতেন এবং প্রচারও করতেন ক্লান্তিহীনভাবেই।

দাদু এখন অপ্রকৃতস্থ এবং অনেকটাই স্মৃতিভ্রম। কিন্তু কাউকে কাছে পেলেই বিরামহীন বলে যায়, “জিন্নাহ সাব ভালোবাসেন নিম্ন-বর্ণের হিন্দুদের । দেখো না, যোগেন’দাকে পাকিস্তানের মন্ত্রী বানালো। একি যেই সেই মন্ত্রী? একেবারে আইনমন্ত্রী। যোগেনদা না বলা পর্যন্ত কেউ দেশ ছেড়ে যাবা না।”

এমন ভাবে কথা বলে যে মনে হতেই পারে যে, দাদু এখনো ১৯৪৮ কিংবা ১৯৫০ সালে বাস করছেন। কলকাতার হিন্দু মুসলমান দাংগা পূর্ব্বংগেও ছড়িয়ে পড়েছে তখন। দলে দলে দেশত্যাগ করছে মানুষ। ওপার বাংলা অর্থাৎ ভারত থেকেও মুসলমান আসছে। কিন্তু সংখ্যায় কম। গান্ধীজি দাংগা থামাতে নোয়াখালি এসেছেন। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে ‘অমুক ‘গ্রাম থেকে অনেক হিন্দু পরিবার রাতের অন্ধকারে দেশ ছাড়ছে।

দাদু গ্রামের মানুষকে বোঝাচ্ছে, “কায়েত-বামুন দেশ ছেড়ে যাচ্ছে যাক। কিন্তু আমাদের মতো নমঃশূদ্রদের তো কায়েত-বামুনরা মুসলমানের সমান চোখেই দেখে। তাই ওদেশে গিয়ে কায়েত-বামুনের হাতে পুনরায় লাথি-গুতো খেতে কেন হিন্দু স্থানে যাব?”

যখন ছোট ছিলাম, দাদুর মুখে এ সব কথা শুনে ভাবতাম পাগলের প্রলাপ। দাদু বিড়বিড় করে এসব কথাই বলতো সারাদিন। এর আদৌ মাথামুন্ডু কিছু আছে কিনা সে নিয়েও ভাবি নি কোনোদিন।

বুঝতে শেখার সময় থেকেই আমরা জানি দাদুর স্মৃতিভ্রম। কিভাবে এমন হলো? দাদু কি আগে স্বাভাবিক ছিলো? বড়দের কাছে জিজ্ঞেস করেছি । শুনেছি, হঠাৎ করে বাথরুমে পা পিছলে দাদুর মাথায় আঘাত লাগে। অনেকদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দাদু সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু দাদুর স্মৃতি ওই নির্দিষ্ট সময়েই পড়ে থাকে। দেশের নামকরা বিশেষজ্ঞ নিউরো-সার্জনও বলতে পারেননি, দাদু সুস্থ হয়ে বর্তমানের স্মৃতি ফিরে পাবে কিনা।

এক ডাক্তার নাকি বলেছিলেন যে, একদিন হঠাৎ করেই দাদুর স্মৃতিশক্তি ফিরে আসবে। বাড়ির সবাই সে আশাতেই বসে আছে। আমিও জানতাম দাদু একদিন সুস্থ হয়ে উঠবেন।

তবে কি মৃত্যুর সময়ে মানুষ স্মৃতি ফিরে পায়? প্রদীপের সলতে শেষবার নিভে যাওয়ার আগে যেমন দপ্ করে জ্বলে ওঠে, দাদুর স্মৃতি কি তেমনি হঠাৎ করে ফিরে আসবে মৃত্যুর আগে একদিন?

এসব ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়ে যায়। দিনের পর দিন সূর্য উদয় হয়। আবার ডুবেও যায়। দাদুর স্মৃতিশক্তি আর ফিরে আসে না। দাদ্রু এখন প্রায় ছিয়াশি বছর বয়স। দাদু এখনো সেই ‘যোগেন’দা, যোগেন’দা’ করতে থাকে বিরতিহীন।

দাদুর মুখে শুনে শুনে ‘যোগেন’দা’ যেন আমাদের কাছে এক অতি পরিচিত চরিত্র হয়ে উঠেছে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তির অবসর। এই অবসর সময়ে বই পড়ার অফুরন্ত সময়। পাড়ার পাবলিক লাইব্রেরি থেকে একটি বই আনলাম , নাম “বরিশালের যোগেন মন্ডল’; লেখক দেবেশ রায়। যোগেন মন্ডল সম্বন্ধে সেই আমার প্রথম অনুসন্ধান।

আমি যতবার যোগ্নে মন্ডল সম্বন্ধে জানি ততবার দাদুর মুখখানি ভেসে উঠে। দাদু বিড়বিড় করে বলছে,” যোগেনদা না বলা পর্যন্ত কেউ দেশ ছেড়ে যাবা না।”

১৯৩৭ সাল। সারা ভারতে আইন সভার নির্বাচন। বরিশালের বাখরগঞ্জের এক তরুণ উকিল নাম যোগেন্দ্র চন্দ্র মন্ডল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করার জন্য দাঁড়ালেন। নিম্ন-বর্ণের নমঃশূদ্র তথা তপশিলী জাতির প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নির্বাচনে জয় লাভ করে সারা ভারতে হইচই ফেলে দিলেন। তার পরের বছরই নমঃশূদ্র সদস্যদের নিয়ে গঠন করলেন “ইনডিপেনডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্টি”। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীও হলেন।
দেশভাগের ডামাডোল চারিদিকে। হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা দেশ। হিন্দুদের দেশের নাম ভারত আর মুসলমানের দেশ পাকিস্তান। পূর্ববংগে প্রায় ৭০ ভাগ মুসলমান। সুতরাং পূর্ববংগ পাকিস্তানের ভাগে পড়ল। নাম হবে পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু ৩০ শতাংশ হিন্দু জনগোষ্ঠী কোথায় যাবে? তাদের তো ভারতেই চলে যেতে হবে।

ভারত ভাগের এই ক্যাচালে প্রতিবেশী হিন্দু মুসলমান রাতারাতি নিজেদের শত্রু ভাবতে শুরু করলো। কলকাতায় শুরু হলো সা¤প্রদায়িক দাংগা। পূর্ববংগ থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করতে শুরু করলো। কলকাতা উচ্চবর্ণের শিক্ষিত হিন্দুদের কাছে অপরিচিত নয়। তাই বাস্তুচ্যুতিতে তাদের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের। শিক্ষা এবং আর্থিক অবস্থা দুটোই এই তপশিলী জনগোষ্ঠীভুক্ত মানুষের খুব খারাপ।

“ইনডিপেনডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্টি”-র নেতা যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল। যোগেন মন্ডল নামেই পরিচিত। যোগেন মন্ডল ভাবলেন ভারতে গেলে কংগ্রেসের কাছে হয়ত যোগ্য সমাদর নাও পেতে পারেন। তাই মোহাম্মদ র আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগের সাথে চুক্তি করলেন।

পূর্ববংগের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংগঠিত করতে লাগলেন। তারা যেন কিছুতেই দেশ ত্যাগ না করেন। জিন্নাহ যোগেন মন্ডলকে মন্ত্রীত্ব দিলেন। পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী হলেন যোগেন মন্ডল।
মাত্র তিন বছরেই যোগেন মন্ডলের ভুল ভেঙ্গে গেল। মুসলিম লীগ ও (বাকি অংশ ৩২-এর পাতায় ধ)

ইনডিপেনডেন্ট সিডিউলড কাস্ট পার্টির মধ্যে যে সাধারণ চুক্তি হয়েছিল পাকিস্তানের নবগঠিত সরকার সেটা বেমালুম ভুলে গেল। বিশেষকরে পূর্ব-পাকিস্তানে থেকে যাওয়া হিন্দুদের ন্যায্য অধিকার থেকেও পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার বঞ্চিত করছে। ফলশ্রুতিতে যোগেন মন্ডল ততকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে সরাসরি ভারতে চলে গেলেন।

পূর্ববংগের যে বিশাল সংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দু, যারা যোগেন মন্ডলের কথায় দেশত্যাগ করে নি, তারা মুসলমানের পূর্ব পাকিস্তানেই রয়ে গেল। যোগেন মন্ডল অনেকটা নিভৃতেই ১৯৬৮ সালে নিজ বাড়িতে মারা গেলেন। আমার দাদুর মতো অসংখ্য মানুষ যারা যোগেন মন্ডলের পক্ষে গ্রামেগঞ্জে প্রচার করেছিল, তারা ক্ষুণাক্ষরেও জানতে পারলো না যে, নেতা তাদের পেছনে ফেলে রেখে হিন্দুদের বাসস্থান ভারতে চলে গেছে।

দাদুকে সব কিছু খুলে বলতে চেষ্টা করাই বৃথা। দাদুর স্মৃতিভ্রম। কোনো কথাই আর দাদুর কাছে পৌঁছুবে না। দাদু তার ‘যোগেন’দা’-র কথাতে আজো বিশ্বাস করে সেই দেশভাগের সময়েই পড়ে আছে। অথচ দেশভাগের পরে পাকিস্তান ভাগ হয়ে নতুন বাংলাদেশ হয়েছে।

দেশভাগের ক্ষত চিহ্ন মুছে দিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছর পরেই আবার পাকিস্তানী ভাবধারার দল ক্ষমতায় এসে আবার সেই তিমিরেই হিন্দুদের ঠেলে দিলো। স্বাধীনতার স্থপতি বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলো।

আবার পাকিস্তানী আদর্শের সামরিক সরকার। পরে কিছুদিন গনতন্ত্রের ক্ষীণ হাওয়া। ধর্মনিরপেক্ষ সরকার কিছুদিনের জন্য ক্ষমতায়। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে আবার সা¤প্রদায়িক সরকার ক্ষমতা নিলো । তখন ২০০১ সাল।
নির্বাচন মানেই ভোটাধিকার।গনতন্ত্রে এটাই নিয়ম। কিন্তু আইনের অধিকার আর আইনের প্রয়োগ না থাকলে গনতন্ত্রও মাঝে মাঝে স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে খারাপ হয়ে দেখা দেয়। ভোটাধিকারকে ক্ষমতাশালীরা নিজেদের পক্ষে নিয়ে নেয়।
২০০১ সালে হলো সেটাই। স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতাসীন হয়েই চিরুণী বাছাই করতে লাগলো; কে কার পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। অথচ ভোটাধিকার প্রয়োগ একান্তই ব্যক্তিগত গোপন বিষয়। এবারেও শিখন্ডী হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু আর স্বাধীনতার পক্ষের ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান।
সারাদেশে অত্যাচ্রা-লুট- ধর্ষণ চলতে লাগলো সরকারী মদদেই। প্রশাসন নিস্ক্রিয়। হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়াবার কেউ নেই। প্রগতিশীল মানুষেরা নিজেরাই বিপন্ন।

আমাদের গ্রাম থেকে কাউকে না বলে রাতের অন্ধকারে চলে গেছে অনেক পরিবার। আমাদের পরিবারেও দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচার উদ্যোগের কথা ভাবছে। বাঁধ সাধলো দাদুর প্রলাপ।

দাদু তো বলেই যাচ্ছে, “যোগেন’দা না বলা পর্যন্ত কেউ দেশ ছেড়ে যাবা না।”
সবাই বলাবলি করতে লাগলো, “এ বুড়া না মরা পর্যন্ত দেশ ছাড়া যাবে না। দেখা গেল বর্ডারে গিয়েও বুড়া যোগেন’দা যোগেন’দা করছে।”
বাড়ির মহিলারা বলছে, “এই যোগেন’দাটাই গত পঞ্চাশ বছর জ্বালাচ্ছে। যোগেন’দাকে ডেকে এনে বুড়াকে বোঝালেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।”
আমি এসব কথার কোনো উত্তর দিই না। শুধু ভাবি, দাদুকে তো বটেই,আমাদেরও আচ্ছন্ন করে আছে যোগেন মন্ডল এখনও!

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)