খুরশীদ শাম্মী : টানটান মনোহারিতা অনেকটাই অন্তর্হিত হয়েছে মসলিনের। দিনদিন কেমন ঢিলে হয়ে পড়ছে তার গঠন। হয়তো দাঁড়াতে পারবে না সে আর কখনো। একদণ্ড দাঁড়ালেই যেন তার বিলাসী অঙ্গ ঝরে পড়বে মাটিতে। মিলেমিশে যাবে ধুলোমাটির সাথে। তবুও মিলা খুব যতেœ আগলে রাখে তাকে। প্রায়ই আদর করে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়; মাঝেমাঝে জড়িয়ে ধরে কাঁদেও, আবার কোমল স্পর্শে মায়া বিলিয়ে দেয়, ফিসফিস কথা বলে, গন্ধ শুঁকে। স্বাভাবিক নিয়মে জীবনের ইতি টেনে প্রকৃতির সাথে বিলীন হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তেও মিলার মতো এক ধনী সুন্দরী রমণীর মাত্রাতিরিক্ত কদরে তার দেমাক উড়িউড়ি।
তার অহমিকার চাপে ঘরের অন্যান্যরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। সভা বসে। গবেষণার সিদ্ধান্ত হয়। আলোচনা চলে দীর্ঘক্ষণ। মসলিনের প্রতি মিলার এত অনুরাগের কারণ ক্রমশঃ গহীন রহস্য হয়ে ওঠে সবার কাছে। তাদের মধ্যে একপ্রকার চাপা সন্তাপ জন্ম নেয়। বেনারসি রুষ্ট হয়ে বলেই ফেলে, ‘হাঁক ডেকে কোথাও যেতে হলে ম্যাডামের প্রয়োজন হয় আমাকে, আর প্রেমটুকু তুলে রাখা সব ওই তুলতুলির জন্য, যত্তসব আদেখলে পনা।’
বেনারসির অনুযোগে সুর মেলায় কাঞ্চিপুরম, ‘কথা একদম ভুল বলিসনি, চাচাতো বোন। সকল নামীদামি পার্টিতে মিলা ম্যাডামের প্রয়োজন হয় সোনা-রূপার কিংখাবযুক্ত জরি ও সুক্ষ্ণ রেশম সুতার চোখ জুড়ানো জটিল নকশায় সজ্জিত তোকে কিংবা খাঁটি তুঁত সিল্কের আমাকে, কিন্তু আদর সবটুকু ওই বুড়ো তুলতুলির জন্যই।’
তসর তোতলিয়ে বলে, ‘গু..গুউৃগুটিপোকার সুতোয় বোনা আ..আ..আমিও কি কম ব্যবহৃত হই?’
সবার কথা শুনে জরজেট ফিক করে হেসে বলে, ‘এত্ত হিংসা কেন তোদের পেটে?’
গরদ ভারী কণ্ঠে বলে, ‘তুই হিংসার কী দেখলিরে জরজেট? আর এতে তোর অমন করে হাসির কী হলো?’
জরজেট হাই তুলে আকাশ পানে তাকায়। একগুচ্ছ মেঘ টেনে নিজ আননে জড়িয়ে বলে, ‘এই যে মেঘ লেপ্টে নিলাম চেহারায়। এবার বল, তোদের আলাপ শুনে হাসবে না কে? গবেষণা তো নয়, করছিস তো সব পিত্তি-জ্বলা আলাপ।’
বেনারসি খপ করে ধরে জরজেটের মুখ থেকে নির্গত বাক্যের লেজ, ‘পিত্তি-জ্বলা নয় রে জরজেট। বল, পিত্তি-রক্ষা আলাপ। বন্ধুদের সাথে মনের সুখ-দুঃখের আলাপে পিত্তি জ্বলে না, বরং পিত্তি রক্ষা পায়, কষ্টগুলো দূর হয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হয়।’
নাক বোঁচা জামদানি গলা খেঁকে বলে, ‘আমি নাকি মসলিনের উত্তরসূরি! মানুষ কথায় কথায় মসলিনের সাথে করে আমার তুলনা। মসলিনের সাথে আমার তুলনা করতে দেখলেই মেজাজ হয়ে যায় ঠিক থার্মোমিটারের পারদ, যখন তা তাপমাত্রার প্রভাবে আয়তন পরিবর্তন হয়ে শরীরের জ্বর ঘোষণা করে।’
সিল্ক সহজ করে নিজের তেলতেলে স্বভাব প্রকাশ করে, ‘যদিও মিলা ম্যাডাম মসলিনকে একটু বেশিই স্নেহ করে, করুক না! পাশাপাশি আমাদেরও তো কম মর্যাদা দেয় না।’
সিল্কের মন্তব্যে নীরব সকলে। সত্যকে উপেক্ষা করার সাহস নেই কারো। সকলেই মনে মনে ভাবে, “সামান্য বিষয় নিয়ে মসলিনকে এত হিংসা করার কী হলো আমাদের?”
নাছোড় বেনারসি। তার অহমিকা বিবেচনাকে উপেক্ষা করে রূঢ় কণ্ঠে জ্বলে ওঠে, ‘হিংসা, হিংসা বলে মাথা খারাপ করছিস তোরা। হিংসার কথা এলো কোথা থেকে? মসলিনের প্রতি ম্যাডামের এত আসক্তির কারণ বুঝতে চেষ্টা করেও আমরা ফেল করছি, এই যা। এমন অমিল প্রেম আমি জীবনেও দেখিনি। প্রেম সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া শোভনীয়!’
হ-য-ব-র-ল সমবেত কণ্ঠ উচ্চারিত হয়, “অন্ধ না হলে প্রেমিক হওয়া যায় না। অন্ধত্ব থাকে বলেই তো প্রেম এত প্রখর হতে পারে।”
হতাশ বেনারসি। চাপা পড়ে আলোচনা। ছাইচাপা আগুন তবুও জ্বালায় বেনারসির অন্তর। কয়েকদিনের বিরতি শেষে বৃষ্টিভেজা এক সন্ধ্যায় পুনরায় তাদের সভা বসে। মসলিনের প্রতি মিলা ম্যাডামের অন্ধ প্রেমের রহস্য উদঘাটন হয়নি তখনও। রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা নয়, বরং দলবদ্ধভাবে মসলিনকে হিংসা করাই যেন তাদের সভার উদ্দেশ্য। তাদের দলবদ্ধ হিংসা ধীরি-ধীরি হিংস্র হতে থাকে, একপর্যায়ে তারা মসলিনকে আক্রমণ করে বলে, ‘এই তুলতুল আদুরি, তোর রহস্য কী? বল্।’
মসলিন ঠোঁটের কোণে এক ফালি হাসি ছাপিয়ে দেয়। অলসতা ছড়িয়ে দেয় কণ্ঠে, ‘রোষানলে ভস্ম হয় শান্তি। ক্রোধ অকল্যাণের হেতু। স্বাস্থ্য ও মন উভয়কে অসুস্থ করে। আমার রহস্য অবশ্যই জানবে। আগে তোমরা বলো তবে, ভর্তসনা করে আদুরি, তুলতুলি, বিভিন্ন নামে ডাকো কেন গো আমায়?’
‘ইস্, ন্যাকামি! ছেঁচড়ের ন্যাকামি দেখো।’ – ফোড়ন কাটে বেনারসি।
‘আমাদের ইচ্ছে হয়েছে তাই তোকে ওইসব নামে ডাকি’।- যোগ করে কাঞ্চিপুরম।
হিংসা খতরনাক এক রোগ। ধরেছে তোমাদের সেই রোগে। ইতিবাচক ভাবতে ব্যর্থ হয়ে রয়েছ পড়ে দিনরাত আমার পিছনে। নিজেদের শান্তি নষ্ট করছ, ছিল যা’ বাকি; বোঝো না কি তা’ একদমই? বয়সে আমি বড়-ই হবো। তোমাদের জন্য মায়া হচ্ছে, হচ্ছে করুণাও। এবার বলি, গল্পটা শুরু এভাবেই :
মিথিলা নামের একজন বাঙালি রমণী, যে জন্মেছিল আঠেরো শতকের শুরুর দিকে পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও অঞ্চলের এক তাঁতি পরিবারে। তখন তাঁত শিল্প কিছুটা চাপের মুখোমুখি হলেও ঢাকাই মসলিনের প্রসিদ্ধি ছিল গোটা বিশ্ব জুড়ে। অত্যন্ত মেধাবী ছিল মিথিলা। পিতার সাথে সমান তালে সে ফুটি কার্পাস তুলা ধুনা, সুতা কাটা ও কাপড় বুননের কাজ করত অতি অল্প বয়স থেকেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তার, ছিল বুদ্ধি ও মননশীল ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য মসলিনের ইতিহাস জানত সে পুঙ্খানুপুঙ্খ। নওয়াব, সম্রাট ও উজিরদের পাইক-পেয়াদা কিংবা বিদেশী বণিকেরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এলে, মিথিলা প্রতিটি কাপড়ের নাম, বিবরণ এতো সূ²ভাবে উল্লেখ করত যে তাদের সকলেই সন্তুষ্ট হয়ে ক্রয় করত। মসলিন কাপড় ও নিজ পরিবার সম্পর্কে সে প্রায়ই বলত, “তন্তু বয়ন আমাদের জাতি ব্যবসা। বংশ পরম্পরায় আমরা তাঁতি। কাচের মতো স্বচ্ছ এই মসলিন পরে দেহশ্রী প্রদর্শন করতে ভালোবাসতেন রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের রোমান রমণীরা। তখন থেকেই মসলিন কাপড় বয়ন করতেন আমার পূর্বপুরুষেরা।”
আঠারো শতকের মাঝামাঝি। তখন মিথিলার ভরা যৌবন। কেবলমাত্র ইচ্ছেতুলিতেই সে স্বপ্ন আঁকত রাতদিন। কিন্তু অস্থির পারিপার্শ্বিকতা তার গতিরোধ করত যখন-তখন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্যে অন্যান্য কোম্পানির বাণিজ্যে ভাটা পড়তে লাগল খুব করে। এর প্রভাব পড়ল তাঁতশিল্পেও। আমদানিকৃত পোশাকের চাহিদা সৃষ্টির লক্ষ্যে তখন আমদানিকৃত পোশাকের তুলনায় স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত পোশাকের উপর অধিক কর আরোপ করা হলো। ফলে ক্রেতা সাধারণের জন্য স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত বস্ত্র ক্রয় করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ল। এরপরও মসলিনের কদর কমাতে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটিশ শাসকগণ মসলিন উত্পাদনে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। প্রথমদিকে তাঁতিরা সকল নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই চালিয়ে যাচ্ছিল মসলিন উত্পাদন। একপর্যায়ে ব্রিটিশ শাসক চড়াও হয়ে মসলিন কারিগরদের হাতের আঙুল কেটে দেয়া শুরু করল। অভিমানে তাঁতিরা বন্ধ করল মসলিন বয়ন। তা’তেও ক্ষান্ত হলো না তাদের জ্বলন্ত অন্তর। কেউ কেউ নিজেই কেটেছিল নিজের বুড়ো আঙুল। মিথিলার বাবা ছিল তাদেরই একজন।
মিথিলার বাবা তার বোনা সর্বশেষ শাড়ি কন্যাকে উপহার দিয়ে বলল, “একজন পিতা তার কন্যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটাই দেওয়ার চেষ্টা করে। দরিদ্রতা আমাদের আগলে ধরেছে, এর থেকে উত্কৃষ্ট উপহার অবশিষ্ট নেই আর আমার কাছে। যত্ন করে রাখিস, মা।”
সে’দিন থেকে আমি মূল্যবান থেকে মহামূল্যবান হয়ে গেলাম। শত অভাবেও পিতার দেওয়া শেষ উপহার আমাকে খুব যত্নে আগলে রাখল মিথিলা। পরিধান করেনি একদিনও। মৃত্যুর পূর্বে সে আমাকে তার কন্যা সরলা বেগমের হাতে তুলে দিয়ে অনুরোধ করল, “আমার বাবার দেওয়া মূল্যবান উপহার তোকে দিলাম, যত্নে রাখিস। সম্ভব হলে এটা একদিন তোর সন্তানকে দিস এবং তাকেও যত্নে রাখার অনুরোধ করিস।”
সরলা বেগম ছিল নিতান্তই সরল একজন নারী। মায়ের অনুরোধ রক্ষার্থে সে আমাকে ট্র্যাঙ্কেই রাখত। তবে মাঝেমাঝে রোদে মেলে পুরাতন ভাঁজ পাল্টে নতুন ভাঁজে গুছিয়ে রাখত। তার প্রথম কন্যা সন্তান গুলনাহারের বিয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে সে নির্বাচন করেছিল আমাকে। কিন্তু তার স্বামী বংশের মান মর্যাদা বিবেচনা করে তা মেনে নেয়নি। স্বর্ণ ও রৌপ্য মেপে দিতে হয়েছিল কন্যার সাথে। অভিমানে সরলা বেগম হঠাত অসুস্থ হয়ে পড়লে গুলনাহার মাকে খুশি করতে নিজেই ট্রাঙ্ক খুলে আমাকে নিয়ে আসে তার ঘরে।
গুলনাহার চাকুরিজীবী একজন নারী। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা থাকলেও সে আমাকেই তার আলমারির সর্বশ্রেষ্ঠ শাড়ি হিসেবে বিবেচনা করত। তার মতে আমি ছিলাম তার সৌভাগ্যের বাহক। আমাকে পাওয়ার পরই তার ঘরে একমাত্র সন্তানের আগমন ঘটেছিল। চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছিল। বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিল তার স্বামী।
গুলনাহার তনয়া মিলা প্রবাসে বেড়ে ওঠা একজন আধুনিক নারী। টপস্?, স্ক্যার্ট তার প্রধান পোশাক। শুধুমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোতে সে শাড়ি পরত কালেভদ্রে। পিতামাতা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দেশে ফিরে গেলেও এক অস্ট্রেলিয়ান যুবক বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া থেকে গেলো সে। তখন শাড়ি পরা হতো না তার একদমই। এক দশক সংসার করার পর একদিন তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছে আলাদা হওয়ার। এর ঠিক এক বছরের মাথায় মারা গেলো তার বাবা। মা গুলনাহারকে সে নিয়ে এলো নিজের কাছে। বিত্ত ও বৈভবের মাঝেও মিলার জীবন বেশ মন্থর গতিতে চলছিল তখন। বিষাদ তাকে আগলে ধরেছিল। গুলনাহার আবেগ আপ্লæত হয়ে এক বিকেলে আমার জীবনের গল্প বলতে বলতে মিলার হাতে তুলে দিলো আমাকে। সেই থেকে মিলা আমাকে আগলে আছে। আমাকে পাওয়ার পর তার নতুন সংসার হয়েছে। সন্তান পেয়েছে। মাত্র একুশ বছরের সন্তান নিজ সংসারের মোহে গৃহত্যাগ করলে, নতুন করে বিষাদ ঘিরে ধরে তাকে। বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সে ঘুরে বেড়ায়, পার্টি করে। কিন্তু যখনই তার মা’কে মনে পড়ে, সে আমাকে জড়িয়ে চুমু খায়; যখন একমাত্র সন্তানকে মনে পড়ে, তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আক্ষেপ করে, “আমার তো কন্যা সন্তান নেই। আমার মৃত্যুর পর কে তোমার যত্ন করবে? তবে কি আমার সাথে সাথে তোমার জীবনও সমাপ্ত হবে?”
kjshammi@yahoo.com