হিমাদ্রী রয় : পৌরাণিক কাহিনি, এক বনে এক সাধু মৃদঙ্গ বাজিয়ে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতেন। মৃদঙ্গ শব্দের সাথে ম ধ্বনির আগমে মৃদঙ্গম শব্দ তৈরি হয়েছে। প্রাচীন ভারতে এই যন্ত্রটির দেহ কাঠামো তৈরি হতো মাটি দিয়ে এই কারণে একে মৃদঙ্গম বলা হতো। বর্তমানে এর দেহ কাঠামো কাঠের হয়ে থাকে এবং একে খোল কিংবা ঢোল নামে জানি। যা হউক এবার গল্পে ফিরি। মৃদঙ্গের বোল শোনার জন্য সেখানে প্রতিদিন একটি হরিণ শাবক এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। একদিন সাধু হরিণীর বাচ্চাকে প্রশ্ন করলেন, হে হরিণ শাবক তুমি কি আমার সুর, তাল, লয় খুব উপভোগ কর? উত্তরে হরিণ শাবক বললো, সুর, তাল, লয় নিয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই তবে এটুকু জানি তোমার মৃদঙ্গের দুই মুখে যে চামড়ার আচ্ছাদন সেটি আমার মায়ের শরীরের চামড়া দিয়ে তৈরি। যখন তোমার হাতের আঘাতে নানা রকম ধ্বনি উৎপ্নন হয়, আমার হৃদয়ে এক বেদনা কম্পন ধরায়, দাঁড়িয়ে আমার মায়ের আর্তনাদ শুনি। এটি একি সঙ্গে হরিণ শাবকের ভালোবাসা এবং প্রতিবাদের ও প্রকাশ। বাংলা বর্ণমালায় যে রস, যে সুধা আর কোন ভাষায় বোধকরি নাই। ম এক অক্ষর, একটা গুনগুন করা সুর ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’।
মা এক শব্দ এক এহেসাস, স্নেহের ইমারতে ভরসার আশ্রয় মা- ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। একদা অসুরদের দ্বারা দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন আর আমরা মদনের প্ররোচণায়। মদন পৌরাণিক কামদেবের অনেকগুলো নামের একটি যার অর্থ নেশা সৃষ্টিকারী রিপু। উন্নত জীবনের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আমরা অভিবাসী। অবশাদে, অনীদ্রায় আসেন কোজাগরী লক্ষী, করুণা করে খোঁজ নিতে,
‘নিজ গৃহে ধন তব তবে কি কারণে
ভিখারী তুমি হে আজি কহ ধন-পতি?
কেন নিরানন্দ তুমি আনন্দ সদনে?’
উন্নত জীবন, অবাধ স্বাধীনতা ঠিক যেমনটি চাইতাম, তাই করবো যা করতে মন চায় এবং আজ তাই করতে পারি তবে কেন উদাসী আসে? অনেক কিছু থেকে রুখার জন্য কেউ কি নেই? আছেতো জীবন সঙ্গিনী আছে। তবে সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে, মায়ের দরজায় টোকা’টা নেই।
যতদিন বাড়িতে ছিলাম আমার শোবার জায়গা ছিলো দোতালায়, আমাদের কাঠের দোতালা এবং সিঁড়িটি ছিলো ঠিক বাবার বিছানার পাশ ঘেঁষে। আটটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছি জেনে বাবার প্রহারেন ধনঞ্জয় এড়ানোর জন্য, উপরে না উঠে নিচ থেকে লম্বা কাঠ দিয়ে সিলিং এ টোকা দিতেন মা। আজ ঘুমের স্বাধীনতা আছে শুধু জাগানোর জন্য মায়ের টোকা নেই ভাবলেই মেঘ হয়ে আসে হৃদয় আকাশে। দুঃখ এ নয় যে এই আধুনিক জীবনের জাগতিক সব সুখ বাটার জন্য মা নেই, দেশে থেকেও মায়ের সবি ছিলো। দুঃখ এই যে গলদ কাজের জন্য ধমকের দেয়ার আদুরে শাসনটি নেই।
‘প্রবাসে দৈবের বসে’ জীবনের হিসেবে কষে কতবার যে,
ফিরতে মন চায় মায়ের আঁচল বিছানো সবুজ শ্যামলীমায়। একুশ আমাকে ফেরায় দাওয়ায় বসে ডালের বড়ি শুকানো মা’য়ের দিকে, মায়ের ভাষার দিকে, শিউলি শৈশবের দিকে, ভাষার সংগ্রামী ইতিহাসের দিকে, শহীদ মিনারের দিকে। লাখো কন্ঠ ধ্বনিত হয়ে নগ্ন পায়ে খুঁজে বেড়ায় মায়ের সুশীতল স্পর্শ। আমিও সেই মিছিলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি, রমনার মাঠে কৃষ্ণচূড়ার তলায় মা বসে পাঠ দিচ্ছেন সালাম, বরকত, রফিক আর জব্বারকে।
‘শীতল বাতাস বয়, জুড়ায় শরীর/
পাতায় পাতায় পড়ে নিশির শিশির’।
এই কলতানে যোগ দেয় শিলচরের কমলা, কানাই, চণ্ডীচরণ, হীতেস, সত্যেন্দ্র, কুমোদ, সুনিল, শচীন্দ্র, তরণী, সুকোমল, বীরেন্দ্র। কল কন্ঠের কাকলিতে মুখরিত চারিধার, এরা এসেছে মা’য়ের মুখে প্রভাতের বর্ণনা শুনতে।
‘পাখি-সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’।
দেখে আমার বুকে ১৯৫২টি খুশির পায়রা ঝাপটে উঠে। তবে দুঃখ এই যে, মা’গো আমাদের সন্তানেরা আছে দুধে ভাতে কিন্তু তাদের সকালে পাখির ডাক নেই, এরা এখন রিং টোনে জাগে।
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’।
ইতিবাচক দিনের শুরুর মন্ত্রটি হারিয়ে গেছে, না মা হারায়নি কারা যেন মুছে দিতে চাইছে। তবু ভয় নেই মা, বাঙালিই পারে আমরাই পারি মায়ের জন্য ভাষার জন্য সানন্দে বুকের রক্ত ঢেলে দিতে।
এবার আবার আমার ফেরার পালা প্রথম আসা ছিলো মদন রিপুর নেশায় আর এখন যে আসতে হয় মায়ায়। ঘুম ভাঙলো দরজাতে টোকায়। এই টোকা বাবার বকুনি থেকে বাঁচাবার নয় এটি দায়িত্বের টোকা। বৌ আগেই ঘুম থেকে উঠে জশের নাসাতা আর স্কুল ব্যাগ রেডি করে দরজায় দেয় টোকা। বৌ’কে কাজে বের হয়ে যেতে হয় তাই জশকে স্কুলে ড্রপ করার পালা আমার। সি,পি,-২৪ দেখাচ্ছে মাইনাস ১৪ ছাদের উপর ঝিংগাফুলা রবি। অগত্যা শাবল হাতে হিম সকাল বেলা বরফ ঠেলা। আর বলি এই কি উন্নত জীবনের স্বাধীনতা? তবে ‘এ আজাদী ঝুটা হে’। আজকাল হাওয়ার সাথেই কথা বলা হয় বেশি বাইরে উইন্ডচিল, ভিতরে ভ্যেকুম। মনে হলো কিচেন থেকে কে যেনো আওয়াজ দিল, চেনা মমতার চেনা ডাক, চা টা খেয়ে যা বাপ, পেছন ফিরে দেখি শুধুই নিরবতা।