ডঃ বাহারুল হক : অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণে বোনের বাসায় দীর্ঘদিন কাটিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী ফিরে এলাম সিডনি। সিডনি এসে উঠলাম স্ত্রীর বোনের বাসায়। এক সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত নিলাম- না, ক্যানবেরায় ভাইয়ের বাসায় কয়দিন থেকে আসি, যদিও ইতিপুর্বে আমি আর আমার স্ত্রী গিয়ে এক সপ্তাহ থেকে এসেছি তার বাসায়। আরো সিদ্ধান্ত নিলাম স্ত্রী সিডনি থাকবে তার বোনের বাসায়; ক্যানবেরা আমি এবার একাই যাব। ক্যানবেরার উদ্দেশ্যে একদিন ট্রেনে উঠলাম। সিডনি থেকে ক্যানবেরা চার ঘন্টার পথ। ট্রেন ছাড়ার সময় এগিয়ে আসছে। আমার পাশের সিটটা খালি। ট্রেন ছাড়তে যাচ্ছে ঠিক সে মুহুর্তে ছুটে এসে বসলো এক ভদ্র মহিলা সেই সিটে।
আমি একটু গুটিয়ে গেলাম। সে কালের জনপ্রিয় আমেরিকান গল্পকার এডগার এলান পোর একটা বই পড়া শুরু করবো বলে হাতে রাখলাম। ভদ্র মহিলা সিটে বসে প্রথমেই চোখ ফেললেন আমার হাতের বইটির উপর। হেসে বললেন_ “এলান পো আমারও ফেভারিট রাইটার”। ট্রেন চলছে; প্রায় আধা ঘন্টা পর আমি ফুড কারে গেলাম কিছু খাবার কিনতে। ফিরে এসে তাকে বললাম- তুমি জানালার পাশে আমার সিটে বসে তোমার সিটটা আমাকে দিলে আমি খুশি হবো। সে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। তারপর কিভাবে যেন কথা শুরু হয়ে গেল। জানলাম তার নাম এনিয়া। সে গোলব্যার্ন যাচ্ছে। গোলব্যার্ন সিডনি থেকে আড়াই ঘন্টার পথ। গোলব্যার্ন একটা ছোট টাউন। এনিয়া সেখানে শিক্ষকতা করে। সাইকোলজি তার সাবজেক্ট। ১৯৬৭ সনে এনিয়ার মা বাবা ইউরোপ থেকে এসে এদেশে বসবাস শুরু করে। আসার তিন বছর পর ১৯৭০ সনে এনিয়ার জন্ম হয়। এনিয়ার জন্ম সন জেনে চট করে হিসেব করে দেখলাম এনিয়ার বয়স ৫২ বছর অর্থাত এনিয়া পঞ্চাশোর্ধ এক নারী। কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয়না সে পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। এক অভুতপুর্ণ লাবন্য তার শরীরে আর তার অবয়বে আছে আভিজাত্যের সুস্পস্ট ছাপ। পোশাক নির্বাচনেও এনিয়া সুরুচির পরিচয় দিয়েছে। গয়না গাটির প্রতি এনিয়ার কোন মোহ আছে বলে মনে হলো না। তার ডান হাতের আঙ্গুলে কিছু নাই কিন্তু বাঁ হাতের তর্জনীতে আছে একটি মোটা আংটি। চুড়ি জাতিয় কিছু নাই তার হাতে, তবে ডান হাতের কব্জিতে চুড়ি হয়ে ঝুলছে একটা অতি চিকন চেইন। বাঁ হাতে আছে আয়তক্ষেত্রাকৃতির একটা ঘড়ি যেটি একটি কালো চিকন বেল্ট দিয়ে হাতের কব্জিতে বাঁধা। অস্ট্রেলিয়ায় এখন সামার। এনিয়ার পায়ে সাদা রঙের এক জোড়া সামার সু। সু’য়ের পেছনের ‘কাউন্টার’ আর সামনের ‘টোবক্সের’ দুরত্ব বেশি বলে তার পায়ের উপরিভাগের বড় অংশ অনাবৃত। সু’য়ের হিল উঁচু হওয়ায় এনিয়াকে লম্বা লাগে। তবে হিলের টপ পিস দুইটি রাবার পিস দিয়ে আবৃত থাকাতে এনিয়া হাঁটলে শ্রæতি কটু বা বিরক্তিকর কোন শব্দ হয় না।
কারো সাথে কথা বলতে বা কারো কথা শুনতে শ্রোতা এবং বক্তার ‘আই টু আই’ ‘কন্ট্যাক্ট’ অনিবার্য। এর ব্যাত্যয়ে পরস্পর পরস্পরের প্রতি অমনোযোগিতা প্রকাশ পায়, যা এক কথায় অভদ্রতা। এ ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে আমার পক্ষে রেল লাইনের বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। এনিয়া আর আমার মধ্যে বিরামহীন কথাবার্তাই এর কারণ। এনিয়া কথা না বলে পারে না। তার কথায় কোন কপটতা নাই। গলার স্বরে মমতা তুলে ধরা ছাড়াও এনিয়া বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যাবহার করে তার কথাবার্তাকে আকর্ষনীয় করে তোলে। তার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে। কথা হয়েছে তার পরিবার নিয়ে। এনিয়ার জার্মান মা আর স্কটিশ বাবা কিভাবে পরিচিত হলেন, কিভাবে সে পরিচয় ভালোবাসার পথ অতিক্রম করে বিবাহের মঞ্চে থিতু হলো তা সব এনিয়া খুব সুন্দর করে বললো আমাকে। গোলব্যার্নের গাছ লতা ফুল পাখি সাপ ব্যাঙও তার কথায় উঠে এসেছে। একবার আমি বললাম তুমি যখন প্রথম গোলব্যার্ন বললে আমি ভেবে ছিলাম গোল্ডেন। আমার কথা শুনে এনি একটা অট্টহাসি দিল, তারপর বললো- হাঁ, গোল্ডেনই তো। আমার টাউনটি একটি গোল্ডেন টাউনই বটে। তার মন্তব্য শুনে হঠাৎ মনে পড়ে গেল অমর কথা শিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে বর্ণিত আবদুর রহমানের কথা। নিজের জন্মভুমির প্রতি তার অপরিসীম মায়া প্রকাশ করতে গিয়ে আবদুর রহমান একবার বলে ছিল- ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম’। যার অর্থ হলো এইতো আমার জন্মভুমি। ব্যাক্তি, গোলব্যার্ন ছাড়িয়ে কথা শুরু করলাম বৃহত্তর অঙ্গন নিয়ে; অস্ট্রেলিয়া ডে, থার্টিফার্স্ট নাইটের ফায়ারওয়ার্কস, অস্ট্রেলিয়ার বুশ ফায়ার, অস্ট্রেলিয়ার “জলে হাঙ্গর ডাঙ্গায় সাপ”, এসব নিয়ে এনিয়ার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছে। ফায়ার ওয়ার্কস বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি অপেক্ষাকৃত একটু বেশি। বার মিনিটের একেবারে লেটেস্ট যে ফায়ার ওয়ার্কসটি হলো গেলো ৩১ ডিসেম্বর রাতে তাতে খরচ হয়েছে ছয় মিলিয়ন ডলার। এ বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। রেল গাড়িতে চড়ে সিডনি থেকে মেলবোর্ণ যাওয়ার সময় রেল লাইনের দুই পাশে ঘর বাড়ির যে দৈন্যতা দেখেছি সে বিষয় ও আমাদের কথা বার্তায় উঠে এসেছে। সেসব ঘর বাড়ি এবং সেসব ঘর বাড়িতে বসবাসকারীদের বিষয়ে এনিয়া কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে; কারণ ভিক্টোরিয়া প্রভিন্সে বেড়ানোর তেমন সুযোগ তার জীবনে আসেনি। সে বসবাস করে নিউ সাউথ ওয়েলস প্রভিন্সে। অপর দিকে মেলবোর্ণ ভিক্টোরিয়া প্রভিন্সের একটা শহর। যে কয়েকবার সে মেলবোর্ণ গেছে তাও যাওয়া আসা করেছে বিমানে। অস্ট্রেলিয়ার বুশ ফায়ার নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে। এনিয়ার কথায় উঠে এসেছে অস্ট্রেলিয়ার বুশ ফায়ার সম্বন্ধে অনেক তথ্য। অস্ট্রেলিয়ায় বুশ-ফায়ার একটা নিয়মিত ঘটনা। পুর্ব অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের সবচেয়ে অগ্নিপ্রবণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি, এবং এর প্রধান ইউক্যালিপটাস বনগুলি বুশফায়ারের ঘটনাকে সমৃদ্ধ করার জন্য বিবর্তিত হয়েছে। সা¤প্রতিক সময়ে শুষ্ক বজ্রপাতের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবচেয়ে বড় বুশ ফায়ার শুরু হয়েছে। কিছু রিপোর্ট ইঙ্গিত করে যে পরিবর্তিত জলবায়ু দাবানলের হিংস্রতায় অবদান রাখতে পারে যাতে গরম, শুষ্ক অবস্থা দেশের আগুনের মৌসুমকে দীর্ঘতর এবং আরও বিপজ্জনক করে তোলে। শক্তিশালী বাতাস বাতাসে জ্বলন্ত অঙ্গার তুলে আগুনের দ্রæত বিস্তারকে উৎসাহিত করে। এটি স্পটিং নামে পরিচিত এবং স্পটিং আগুনের সামনে থেকে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত একটি নতুন আগুন শুরু করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার বুশফায়ার গুলোকে অনিয়ন্ত্রিত, অ-কাঠামোগত আগুন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আগুনের প্রকৃতি নির্ভর করে স্থানীয় ভূ-সংস্থানের উপর। বুশের আগুন সরাসরি প্রাণীদের হত্যা করে এবং স্থানীয় আবাসস্থল গুলোকে ধ্বংস করে, এমনকি আগুন কেটে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের ঝুঁকিপূর্ণ করে।বুশফায়ারে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বের যে কোন অঞ্চলের প্রজাতির ক্ষতির হার সবচেয়ে বেশি। মানুষের উপর সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রভাব হল যে মানুষের জীবনহানি ছাড়াও, দাবানলে বাড়িঘর, সম্পত্তি এবং পশুসম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ এবং কিছু ক্ষেত্রে পানীয় জলের সরবরাহ ব্যাহত হয়।
এনিয়ার বক্তব্য হলো সে স্বভাবগতভাবে একটা ঘরকুনো মানুষ। নেহায়েত ঠেকা না পড়লে সে ঘরের বাহিরে খুব একটা যায়না। আমি কি করি বা করতাম তা এনিয়া জানতে চায়নি। শুধু একবার জানতে চেয়েছিল আমি এখনও কাজ করি কিনা। আমি রিটায়ার্ড বললে এনিয়া পট করে আমার বয়স কত তা জিজ্ঞাসা করে বসলো। আমি বললাম – আমার বয়স ৭০ বছর। বয়স ৭০ বছর শুনে এনিয়া যে ভাবে উচ্চস্বরে ‘রিয়েলি’ বললো তাতে আশে পাশের যাত্রীরা তার দিকে না তাকিয়ে পারলোনা। শুধু ‘রিয়েলি’ নয় কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে কিছু শব্দ এনিয়া উচ্চস্বরে উচ্চারন করতো আর কথায় কথায় অতি সামান্য হাসির বিষয়েও সে উচ্চ হাসি দিত। তার হাসিতে আশে পাশের যাত্রীরা কতবার যে আমাদের দিকে তাকিয়াছে তার কোন হিসেব নাই। এনিয়ার হাসি যে শুধু মন খোলা তা নয় তার কথা বার্তা ও দিল খোলা। সে কথা বলে নিজের প্রতি সুদৃঢ় আস্থা রেখে। কথা বার্তা বলে সে চমকে দিতে না চাইলেও শ্রোতার চমকে উঠার বেশ অবকাশ থাকে। সে খেই না হারালেও ঘন ঘন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তাতে পরম্পরা রক্ষা হয়না, কিন্তু কথার ছন্দ পতন হয়না। দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা বলতে গেলে সে-ই কথা বলেছে, আমাকে আর বলতে দিল কই? আমি কানাডা থেকে এসেছি এটা বলেছি। আমার স্ত্রী সন্তানের খবর সে জানতে চায়নি; আমিও বলিনি। মিষ্টি জাতিয় খাদ্য মনে হয় এনিয়ার খুব প্রিয়। ক্যান্ডির একটা প্যাকেট এনিয়ার হাতে। সেখান থেকে একটা একটা একটা করে ক্যান্ডি খাচ্ছে অনবরত। আমাকে সেধেছিল। কিন্তু মিষ্টি বলে আমি ক্যান্ডি খাওয়া থেকে বিরত থেকেছি। কথার মালা গাথতে গাথতে এনিয়া কাটিয়ে দিল দীর্ঘ আড়াই ঘন্টা। গোলব্যার্ন আর বেশি দুরে নয়। এনিয়া নামার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলো। তার বাসা স্টেশন থেকে কত দুরে, কিভাবে সে যাবে জানতে চাইলে সে বললো তার প্রিয় কুকুরটা নিয়ে তার স্বামী স্টেশনে আসবে তাকে নিয়ে যেতে। নিঃসন্তান নারী এনিয়ার স্বামী এনিয়ার কত প্রিয় জানলাম না কিন্তু কুকুরটা যে তার অনেক প্রিয় তা জেনে গেলাম। এবার আচমকা একটা ঘটানা ঘটে গেল যেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এ রকম একটা কিছু করবে সে তা আমি কিছুতেই ভাবি নি। এনিয়া তার ছোট হ্যান্ডব্যাগটা খুললো। ব্যাগ থেকে ১০ ডলারের একটা নোট বের করলো। তারপর সেই নোটটা আমার সামনে ধরে আমাকে সহাস্যে বললো- “এটা তুমি রাখ। তুমিতো আরো দেড় ঘন্টা ট্রেনে আছ, কিছু কিনে খেয়ে নিও”। আমি একেবারে নার্ভাস হয়ে গেলাম। আমার ওয়ালেটটা খুলে তার সামনে ধরে বললাম- “এই যে দেখ আমার কাছে টাকা আছে”। এনিয়া বললো- “আমি কি পাগল যে ভাববো তোমার কাছে টাকা নাই। তোমার টাকা তোমার, এটা আমার টাকা। আমি তোমাকে দিচ্ছি, তুমি রাখ”। তারপর ও আমি ইতস্তত করতে থাকলাম। এবার সে জোর দিয়ে বললো- “তুমি এটা রাখ। এটা তুমি রাখলে আমি খুব খুশি হব”। এর অর্থ হলো তুমি না রাখলে আমি খুব অখুশি হবো। এনিয়াকে অখুশি করে কি লাভ হবে! এনিয়ার এ সামান্য ত্যাগটাকে এখন আমিইতো পারি অসামান্য করে তুলতে। মুহুর্তের মধ্যে স্বাভাবিক হলাম। এনিয়ার হাত থেকে ১০ ডলারের নোটটা সযতেœ আমার নিজের হাতে তুলে নিলাম। ট্রেন গোলব্যার্ন স্টেশনে প্রবেশ করলো। এনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে। আমিও তার পিছু পিছুগেলাম দরজা পর্যন্ত। ফিরে এসে আমার সিটে বসলাম। ট্রেন আবার চলছে। দেড় ঘন্টা পর আমি পৌঁছে যাব ক্যানবেরা। একা একা বসে বসে ভাবছি। আমার ভাবনায় এখন শুধু এনিয়া। ভাবছি এটা কি হয়ে গেল! আমার দীর্ঘ জীবনে কত ঘটনাইতো ঘটলো, কিন্তু এমন ঘটনা আগে কোন দিন ঘটেনি। একটি দশ ডলারের নোট; এখন আমার স্মৃতিভান্ডারে সবচেয়ে উজ্জল, সবচেয়ে আকর্ষনীয় সাবজেক্ট।