ড: বাহারুল হক : দশ / এগার বছর বয়সী জনসন জিনিস-পত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিনিস-পত্র বিক্রি করবে। সে সব বিক্রি করে যা লাভ হবে তা সে তার স্কুলে দান করবে। ফেরি করতে করতে দুপুর। রোদেলা দুপুরে সে শুধু ক্লান্ত হলো না খুব ক্ষুধাও অনুভব করতে লাগলো। এ পর্যায়ে সে স্থির করলো এবার যে বাড়িতে সে যাবে সে বাড়িতে সে কিছু খাবার চেয়ে খেয়ে নিবে। সে একটা বাড়িতে গেল; কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে খুব সংকোচ বোধ করলো এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো। বাড়ির দরজা খুলে মিষ্টি চেহারার একটা যুবা মহিলা সামনে দাঁড়ালে সে তার কাছে কোন খাবার না চেয়ে শুধু এক গ্লাস পানি চাইলো। যুবা মহিলাটি কিন্তু জনসনের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলো জনসন খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। সে ভিতরে গেলো। তারপর ফিরে এল হাতে দুধ ভর্তি বড় একটা গ্লাস নিয়ে। যুবা মহিলা দুধ ভর্তি গ্লাসটা জনসনের হাতে তুলে দিয়ে বললো- “খাও”। ক্ষুধার্ত জনসন সবটুকু দুধ খেয়ে নিল।
গ্লাসটা যুবা মহিলাটার হাতে তুলে দিতে দিতে জনসন বললো- “তোমাকে কত দিতে হবে”? যুবা মহিলাটা হেসে বললো- “তোমাকে কোন মূল্য দিতে হবে না। আমি তোমার কাছে এ দুধ বিক্রি করি নাই। আমি তোমাকে ভালোবেসে এ দুধ দিয়েছি। আমার মা বলেছেন – কাউকে ভালোবেসে কিছু দিলে তার জন্য দাম নিতে হয় না”। জনসন তাকে অসংখ্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার রাস্তায়। জনসনের শরীরের ক্লান্তি ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকলো। জনসন প্রাণশক্তি ফিরে পেল এবং সেই সাথে হয়ে উঠলো ঈশ্বরের দয়ার প্রতি আরো আস্থাশীল।
বহু বছর পরের ঘটনা। মফস্বলের সেই মহিলাটি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। স্থানীয় ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেও তাকে সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ হলো। স্থানীয় ডাক্তারদের পরামর্শে তাকে একদিন বড় শহরের বিখ্যাত হাসপাতালে নেয়া হলো। জনসন এখন সে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কর্মরত। জনসন তার আরো কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে বসলো এবং ভালো করে মহিলার কেসটি পর্যালোচনা করলো। মহিলা যে ছোট্ট টাউন থেকে এসেছে সে টাউনের নাম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সে তখনি মহিলাটিকে দেখার জন্য মহিলাটির কক্ষে চলে গেলো। মহিলাটি জনসনকে চিনেনি, কিন্তু জনসন চিনে ফেলেছে এই সেই মহিলা যে সেদিন এক বড় গ্লাস ভর্তি দুধ তাকে খেতে দিয়েছিল এবং যা খেয়ে সে সেদিন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছিল। শুধু তাই না জনসনের আরো মনে পড়লো জনসন দুধের দাম দিতে চাইলে সে বলেছিল- “আমি তোমার কাছে এ দুধ বিক্রি করি নাই। আমি তোমাকে ভালোবেসে এ দুধ দিয়েছি। আমার মা বলেছেন – কাউকে ভালোবেসে কিছু দিলে তার জন্য দাম নিতে হয় না”।
জনসন কিছুক্ষণ তার সাথে তার রোগ ব্যাধি নিয়ে কথা বললো এবং আর কিছু না বলে ফিরে এলো। নিজ কক্ষে এসে জনসন সংকল্প করলো- এ মহিলাকে বাঁচাতেই হবে। সংকল্প বাস্তবায়নে জনসন কোন ত্রুটি করছে না। হাসপাতালে সবার সেবায় এবং জনসনের নিরলস প্রচেষ্টায় মহিলা সম্পূর্ণরূপে সুস্থ্য হয়ে উঠলো। শেষ দিন। মহিলা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাবে নিজের বাড়িতে নিজের ছোট্ট টাউনে। হাসপাতালে চিকিত্সা খরচ হিসেবে পরিশেষে মহিলাকে কি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে তা উল্লেখ করে হাসপাতালের অফিস মহিলাকে দেওয়ার জন্য একটি বিল তৈরী করলো। বিলটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ডাঃ বেন জনসনের কক্ষে প্রেরণ করা হলো। ডাঃ জনসন বিলটি দেখলেন- পরিশোধ করতে হবে সর্বমোট ২৮,৩৫০ ডলার। দেখা শেষ হলে ডাঃ জনসন একটি কলম হাতে তুলে নিলেন। তারপর বিলটির এক পাশে কি যেন লিখলেন এবং বিলটি একটি খামে ভরে অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। বিলসহ খামটি এবার পাঠিয়ে দেওয়া হলো মহিলার কক্ষে। মহিলা খামটি গ্রহণ করলেন; কিন্তু তার কিছুতেই সাহস হচ্ছে না খামটি খুলে বিলটি দেখার। সে বুঝেছে নিশ্চয় খুব বড় অংকের একটা বিল হবে এবং বাকি সারাটা জীবন তাকে কিস্তি টানতে হবে যেহেতু এখন সে কিছুই পরিশোধ করতে পারবে না। কিন্তু বসে বসে ভাবলেতো হবে না। বিলতো দেখতে হবে। মহিলা বিলটি দেখলেন। তাকে পরিশোধ করতে হবে সর্বমোট ২৮৩৫০ ডলার। এবার বিলটির এক পাশে হাতে লেখা ‘ফুটনোট’টি পড়ার জন্য মহিলা বিলটি চোখের সামনে ভালো করে মেলে ধরলেন এবং পড়লেন- “Paid in Full with one Glass of Milk. – Dr. Ben Johnson.”
মুহূর্তেই মহিলার মনে পড়ে গেল বহু বছর আগের সেই দিনটির কথা। মনে পড়ে গেল- রোদেলা দুপুর, ক্ষুধার্ত কিশোর, এক গ্লাস দুধ, দাম না নেয়া ইত্যাদি এবং এটাও বুঝলো এই ডাঃ বেন জনসন আর কেউ নয় সেদিনের ক্ষুধার্ত সেই কিশোর। মহিলা বিলের ‘ফুট নোট’টি বার বার পড়লেন। প্রতিবারই লেখায় চোখ ফেললে সেখানে সেই দিনের কিশোর জনসনের মুখচ্ছবি ভেসে উঠে। ভেসে উঠে দুধ পান শেষে জনসনের পরিতৃপ্ত মুখের মিষ্টি হাসি। বিস্ময়াভিভুত হয়ে মহিলা ভাবতে থাকেন- মানুষের মন এত বড় হয়, মানুষ এত উদার হয়, মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ এত প্রগাঢ় হয়, এত গভীর হয়! না, আমি ডাঃ জনসনকে একবার দেখতে চাই। দেখতে চাই আজকের ডাঃ জনসনের মুখে প্রায় দুই যুগ আগে দেখা কিশোর জনসনের সেই মুখ।
ডাঃ জনসন শুধু একজন ভালো ডাক্তার নয় সে অসম্ভব ভালো একজন মানুষও। ভালো মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে তার মধ্যে থাকবে প্রচন্ড কৃতজ্ঞতাবোধ। অথচ কৃতজ্ঞতাবোধ সম্পন্ন মানুষ কয়জন আছে? বেশির ভাগ মানুষ কার কাছ থেকে কি পেয়েছে তাতো মনে রাখেই না বরং কি পায়নি তা নিয়ে মনের মধ্যে খচখচ করে। যে মানুষটি পিতার মত যত্ন, স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছে, যে মানুষটি প্রয়োজনের সময় হাজির হয়ে তার ইচ্ছা-আকাঙ্খার সাথে একমত হয়ে তার জীবনে আশা ও গতি সঞ্চার করেছে, বড় হয়ে (ডিগ্রী ও টাকায়) সে সেই মানুষটাকেই ভুলে গেছে, এরকম উদাহরণও আছে। কৃতজ্ঞতাবোধ একটি অতি মানবিক কোয়ালিটি। কৃতজ্ঞতাবোধ বা কৃতজ্ঞ থাকার বিষয়ে মহান আল্লাহর নির্দেশও সুস্পষ্ট। পবিত্র কোরআনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন- “তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই আরো দেব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠিন”। (১৪:৭)