সাজ্জাদ আলী : গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার্স সিটে উঠে বসলো মিতু। আবার সাথে সাথেই নেমে পড়লো। আধা প্যাচ ঘুরে ড্রাইভার্স সিটের জানালায় এসে বললো, আমি চালাচ্ছি। তুমি গিয়ে আরাম করে ওই সিটে বসো।

তার কথা বলবার ধরন আর দশজনের থেকে আলাদা। মমতা আর আদেশ মেশানো। তা মানতেই মন চায়। পরিচয় অনেক বছরের, তবে দেখা হলো এই মাত্রই। সে কি আমার বন্ধু? বা বন্ধুস্থানীয়? নাকি শুধুই অনেক দিনের পরিচিত এক মানুষ? আজ মুখোমুখি কথা বলার পর হয়তো জবাব মিলবে।

সিটে বসতে বসতে বললাম, একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারকে হটিয়ে দিলে? আমার ড্রাইভিংয়ের ওপর তুমি আস্থা রাখতেই পারতে।

আরো না না, মোটেই তা না। তোমাকে দিয়ে একটা কাজ করাবো। সে জন্যেই এত বছর বাদে আজ দেখা করতে চেয়েছি। সেই কাজটি আর গাড়ি চালানো, একসাথে করা নিরাপদ না। তবে ভেবো না, ড্রাইভিংয়ে আমারও ১৯ বছরের এক্সপেরিয়েন্স। এমনকি আমার সাবেক স্বামীও আমার গাড়ি চালানোর ওপর ভরসা রাখতেন।

কুশল জিজ্ঞাসার পরে বললাম, কোথায় যাবে? আর কেনই-বা দেখা করতে চাইলে, কিছুইতো বলোনি?

নায়াগ্রা ফল্স পর্যন্ত যাবো, আবার ফিরে আসবো। তবে সেখানে নামবো না। অনেক দেখা কোনো কিছু আবারো দেখতে একঘেঁয়ে লাগে। যেতে আসতে ঘণ্টাতিনেক সময়, কথা বলে কাটাবো আমরা। বড়জোর কফিশপে থামবো একবার, বললো মিতু।

চলতে শুরু করেই ওর হাতব্যাগ থেকে বড়সড় একখানা ইনভেলপ বের করে আমায় দিলো। বললো, এরমধ্যে আমার একখানা ছবি আছে। ছবিটা তুমি দেখবে। আর “কেমন দেখছো”, তা হুবহু বলবে। মনের কথা অদল-বদল করবে না কিন্তু। আমি যে তোমার পাশে আছি, তা ভুলে যাও। একটা রেকর্ডিং ডিভাইস এনেছি। কথাগুলো রেকর্ড হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে মিতু, তোমার ছবি দেখে না হয় মনের কথাগুলো বললাম। কিন্তু সে সব কথা রেকর্ড করবে কেন? এ কেমন পাগলামি তোমার?

মোটেই পাগলামি না। ওই রেকর্ডিং শুনে শুনে পরে তুমি গুছিয়ে একটা আর্টিকেল লিখবে। মিলিয়ে দেখবো, তোমার লেখায় “মনের কথা” কতটা আসে। কতটা সৎ লেখক তুমি!
জগৎ সংসারে মানুষের কত বিচিত্র চাওয়া/পাওয়া। কীসে যে কে আনন্দ পায় তা বোঝা দায়। কারো রূপের প্রশংসা বা নিন্দা কি তার সামনে বলা যায়? মিতু সুন্দরী, মুখখানাতো আরো মনকাড়া। তার ছবি দেখে প্রশংসাসূচক কথাই বলতে হয়। তবে তাতেও বিপদ আছে। সে হয়তো ভেবে বসবে, আমি নারী পটানো ডায়লগ বলছি। এক মহা সংকটে পড়া গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হাইওয়ের উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ি গুনতে থাকলাম। মিতু তাড়া দিলো, কই ইনভেলপ খোলো, ছবি বের করো-

ছবিটি হাতে নিয়ে তা পরখ করে দেখছিলাম। ওর মুখের ক্লোজ ছবি সেটি। চোখের কাছে আনি, আবার তা দূরে ঠেলে দেখি। বহুক্ষণ দেখার পরে বলতে শুরু করলাম, এ ছবিতে তোমার চোখজোড়া দেখতে মাঝারি। কিন্তু চাউনিটা দুর্দান্ত। মন বলছে যেন তুমি আমাকে দেখবার জন্যই চোখ মেলেছো। কী জানো মিতু, এমন ড্যাব ড্যাব করে কেউ কখনও আমাকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। আবার তাকানোর ঢংয়ে তোমার ভ্রুজোড়া একটু বাঁ দিকে বেকেছে। ওটুকু না বেঁকে যদি সোজা থাকতো, তাহলে আমি বলবো, অমন ভ্রু চেছে ফেলাই উচিত কাজ।

ছবিখানা আরো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছি। তা পনেরো বিশ মিনিট তো হবেই। কিছু বলছি না আমি। মিতু দক্ষ হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আছে, চোখ রাস্তায়। কিন্তু কান খাড়া, আমি কখন তার রূপের বিবরণী বলবো, সেই অপেক্ষায় সে। আরো খানিক বাদে বললাম, তোমার কপালটা অন্যদের তুলনায় বেশ বড়সড়। অথচ তা তুমি খালি রেখেছো, টিপ পরোনি। ছবি তুলবার আগে স্নো-পাউডার মাখোনি বলে বয়সের রেখাগুলো কপালে দেখা যাচ্ছে। তাতে তোমার রূপের কোনো লোকসান হয়নি, বরং গাম্ভীর্য বেড়েছে। জীবনে যদি সুযোগ আসে তো নিজের হাতে তোমার কপালে টিপ পরিয়ে দিতে চাই। একটা নয়, দুটো। কালো রঙের বড় টিপটির ঠিক নিচেই রক্তরাঙা ছোট্ট আরেকটি বসিয়ে দেবো। তখন বেশ লাগবে তোমায়।
গালের দুপাশে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটি ব্রণের দাগ আছে। চাইলেই ওগুলো তুমি হালকা প্রসাধনী দিয়ে ঢেকে দিতে পারতে। কিন্তু তা করোনি। কী জানো মিতু, চাঁদের কলঙ্কগুলো তার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে। তুমি তা জানো বলেই ওই দাগ ঢাকার চেষ্টা করোনি। যে সৌভাগ্যবান তোমার অন্তরের সাম্রাজ্য দখল করে আছে, সে নিশ্চয়ই ওই দাগ গুলোতে আঙ্গুল ছোঁয়ায়?

আপাতত সাম্রাজ্য খালি আছে, কারো আঙ্গুলের ছোঁয়াও পড়ছে না, বলতে বলতে মিতু কফিশপে গাড়ি পার্ক করলো। বললো, নামো, ছবির বর্ণনা এখন মুলতবি রাখো, খিদা লাগছে, খেয়ে নিই চলো।

আমি বললাম, চল যাই। তবে তোমার কাজ করে দিচ্ছি, খাওয়ার বিল কিন্তু তুমি দেবে।
পটেটো ওয়েজ, চিকেন স্যান্ডুইচ, ডোনাট, কফি, আইচক্রিম ইত্যাদি একগাদা খাবার নিয়ে এলো মিতু। খেতে খেতে সে জানতে চাইলো, আচ্ছা বলতো, আমার পারসোনালিটিটা তোমার কেমন লাগে?

বললাম, তোমার সাথে যে আমি ফোনে কথা বলি, টেক্সট লিখি, আজ গাড়িতে একসাথে চলেছি; এর থেকে প্রশ্নের জবাব খুঁজে নাও। আলাদা করে কিছু বলতে চাই না। চুপচাপ রইলো মিতু। জবাব খুঁজবে কিনা তা বোঝা গেল না।

খাওয়া শেষ হতেই তাড়া দিলো সে। বললো, উঠে পড়ো। ছবিটির আরো বর্ণনা শুনবো।
গাড়িতে বসে আবার সেই ছবিখানা হাতে নিলাম। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি। যেন আগে কখনও দেখিনি। অনেকক্ষণ পরে বললাম, মিতু তোমার নাকের ডগাটি খুব যে খাড়া, তা না।

সোচালুও না। তবে তা তোমার মুখখানায় ভীষণ রকম মানিয়েছে। নাকটি অন্য কোনো রকম হলে তোমাকে বিশ্রী দেখাতো। যখন তুমি কথা বলো, তখন ডগাটি একটু একটু ফুলে ওঠে। তা দেখতে যে কী ভাল লাগে! মন চায় নাকটা একটু টিপে দিই। এখন গাড়ি চালাচ্ছো বলে রক্ষা পেলে।

হো হো করে হেসে উঠলো মিতু। হাসি থামার পরেও মুখে সে কিছুই বললো না।
নায়াগ্রা পৌঁছুতে বেশি দেরি নেই। ছবির দিকে তাকিয়ে আমি আবার বললাম, তোমার ডান দিকের ওপরের পাটির একটি দাঁত আরেকটির ওপরে উঠে আছে। তুমি হেসে কথা বললে ওই দাঁতটি যে শোভা ছড়ায়, তা অতুলনীয়। অথচ তুমি ওপরের ঠোঁটটি দিয়ে ওই দাঁতটিকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করো। এ তোমার ভারি অন্যায় কাজ। ওটি তোমার ঐশ্বর্য, ওকে তুমি আড়াল করোনা, প্লিজ।

আমি অন্তরের চোখ দিয়ে ছবিখানা দেখছিলাম। আর মুখে তা বলছিলাম। সে বিররণী মিতুর যে কেমন লাগছিলো, তা ঠিক বলতে পারবো না। কারণ সে একটিবারও আমার কথায় সায় দেয়নি, আবার বিরক্তিও বলেনি। আমরা, বক্তা এবং শ্রোতা, দুজনেই বলা-শোনায় এতটাই মগ্ন যে নায়াগ্রা ফলসের শোভাও আমাদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি। ফলসের লাগোয় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে মিতু বেশ আগেই টরন্টো ফেরার পথ ধরেছে।

ছবির দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলাম, মিতু তোমার পুরু ঠোঁটজোড়া মুখের ভরাট আদলের সাথে মিলেমিশে একাকার। ওই ওষ্ঠযুগল ছাড়া তো তুমি রীতিমতো কাঙাল। শুধু মাত্র ওই ঠোঁট দিয়েই তুমি অনবরত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আর্কষণ করে চলেছো। কিন্তু কজন পেয়েছে তার ছোঁয়া? জগতের সব সুধা লুকিয়ে আছে ওই ঠোঁটে। সে সুধারস যার ভাগ্যে জোটেনি, তার জন্ম নিয়ে কী লাভ হলো বলো তো, মিতু?

কখন যেন পৌঁছে গেছি মিতুর বাড়িতে। বললো, তোমাকে এখন আর খাতির করতে পারছি না। অন-লাইনে দুঘন্টার একটা ক্লাশে পড়াতে হবে এখন। কিন্তু মিনতি করছি, আসছে ১৮ তারিখে তুমি আসবে আমার ফ্লাটে। বাকি বর্ণনা শুনবো সেদিন। তবে সেদিন তোমার সামনে কোনো ছবি থাকবে না। নিরাভরণা আমি বসে থাকবো!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)