জসিম মল্লিক :
১.
আমি টরন্টো থাকি। টরন্টো থেকে প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার বিমান বাংলাদেশের দুটো ফ্লাইট চলাচল। একসময় যা ছিল স্বপ্ন এখন তা বাস্তব। ভবিষ্যতে এই রুটে আরো বেশি ফ্লাইট চলাচল করবে এটা বলাই যায়। বিমান ঢাকা-টরন্টো-ঢাকা রুটকে উদাহরন হিসাবে দেখাচ্ছে কারণ এই রুট ক্রমশঃ লাভজনক হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ ফ্লাইট ফুল হচ্ছে। শুধু যে বাংলাদেশী যাত্রী যাচ্ছেন তা না, বিদেশী যাত্রীরাও যাচ্ছেন। আমি সবসময় এমিরেটস বা ইত্তেহাদে ভ্রমণ করতাম। প্রতিবছর এক দুইবার দেশে যাওয়া হয় আমার। কিন্তু যেদিন থেকে বিমান সরাসরি ফ্লাইট চালু করল আমি বিমানের নিয়মিত যাত্রী হয়ে গেলাম। শুধু আমি না আমার মতো অনেকেই। অপেক্ষাকৃত বয়ষ্কদের জন্য সরাসরি ফ্লাইট খুবই স্বাচ্ছন্দের হয়েছে। আমি সবসময় নিজ দেশের পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সেই ভ্রমণ করতে চাই। দেশে গিয়েও যেখানেই যাই বিমানে ভ্রমণ করি। টরন্টো পীয়ারসন এয়ারপোর্ট নেমে টার্মিনালের বাইরে যখন বিমান কথাটা লেখা দেখি তখন একটা ভাললাগার অনুভ‚তি কাজ করে। ভিতরে গিয়েও একই অনুভ‚তি হয়। অন্য সব নামকরা এয়ারলাইন্সের সাথে বিমানের নামও শোভা পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার দিয়ে দেশে যেতে পারছি এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না। বিমানের টরন্টোর স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তারা খুবই প্রফেশনালিজমের পরিচয় দিচ্ছেন। তাদের কাস্টমার সার্ভিসও খুবই ভাল। আকাশেও বিমানের আতিথেয়তা প্রশংসনীয়। টানা ১৮/২০ ঘন্টার জার্নি কখনও একঘেয়ে মনে হয় না। আকাশে শান্তির নীড়। তবে ক্যাটারিংএ আর একটু বৈচিত্র্য ও এন্টারটেনমেন্টের পরিসর বাড়ানোর অনুরোধ করব কর্তৃপক্ষকে।
এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত ও দূরদর্শীতার কারণে। হাসিনার সরকার পুরো বিশ্বকে এক সুতোয় বাঁধতে চাইছেন। ইতিমধ্যে জাপান, চেন্নাই বা চীনের সাথেও সরাসরি ফ্লাইট চালু হয়েছে। সিডনী, ইউরোপের আরো ডেস্টিনেশন ও নিউইয়র্কের সাথেও চেষ্টা চলছে। আরো অন্ততঃ দশটা এয়ারবাস বা বোয়িং কেনার কথাবার্তা হচ্ছে। শুধু এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রেই নয় দেশের মধ্যেও একটা সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেছেন শেখ হাসিনা। তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু যোগাযোগের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। ঢাকায় ম্ট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস, কর্নফুলি নদীর তলদেশে টানেল সবই স্বপ্নের মতো। আরো অনেক মেগা প্রজেক্ট অনগোয়িং। ঢাকায় তৃতীয় টার্মিনাল তার আর একটি অনন্য উদাহরন। কে না জানে যে একটা দেশের উন্নতি বা অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি অনেকটাই নির্ভর করে সে দেশের সুষ্ঠ যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর। তাইতো উন্নত দেশগুলোর প্রথম নজর থাকে যোগাযোগের উপর। আমেরিকা, কানাডার মতো দেশগুলো রাস্তাঘাট তৈরী করে পরবর্তী একশ বছরের চিন্তা মাথায় রেখে। কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কিন্তু মানুষ মাত্র তিন কোটি আশি লাখ। কিন্তু পুরো দেশ জুড়ে সুতোর মতো নেটওয়ার্ক। কথিত আছে কানাডায় যত রাস্তা আছে তা একত্র করলে চাঁদে যাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকার কয়েক দফায় ক্ষমতায় থাকার সুফল জনগন পাচ্ছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরন পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণেই পদ্মা সেতু আজ বাস্তবরূপ লাভ করেছে। সামনেই নির্বাচন। মানুষ অব্যাহত উন্নয়নের পক্ষেই থাকবে বলে আশা করি।
২.
একসময় বরিশাল যেতে কত ঝক্কি না পোহাতে হতো। একটা ঘটনা বলি। সেটা ১৯৯৪ সাল। একবার ঈদে আমার ছোট ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে বরিশাল রওয়ানা হয়েছি। সদরঘাট পর্যন্ত আসতেই অবস্থা কেরোসিন। টু স্ট্রোক অটো রিক্সা ছিল তখন। তার ভট ভট আওয়াজ আর বিকট ধোঁয়ায় অর্ক বমি টমি করে অস্থির। মহাখালি থেকে লঞ্চঘাট পৌছতেই সেদিন লেগেছিল তিন ঘন্টা। সদরঘাট পৌঁছে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। অর্কর বয়স তখন তিন বছর। মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এদিকে লঞ্চগুলো মানুষের চাপ এড়াতে নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে রেখেছে। সেখানে পৌঁছানোও বিরাট ঝুঁকি।
আমি বললাম, জেসমিন চলো ফিরে যাই।
জেসমিন বলল, এতো কষ্ট করে এসেছি ফিরে যাবো! বরিশালে ঈদ করা হবে না! দেখোনা কিছু করা যায় কিনা।
আমরা অবশেষে একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকায় উঠলাম। হুর হুর আরো কয়েকজন উঠে পড়লো। বুড়িগঙ্গার মাঝখানে গিয়ে নৌকা দুলছে মানুষের চাপে। যে কোনো সময় ডুবে যাবে! মনে হচ্ছিল আজই সলিল সমাধি ঘটবে। জেসমিন ভয়ে চিৎকার করছে। এদিকে ঘাটেই কুলিদের টানাটানিতে একটা বাক্স খুলে কাপড় চোপড় রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। সবকিছু ছয়লাব হয়ে গেছে। তার মধ্যে নৌকার বিপদ। নৌকা যখন ডুবে যায় অবস্থা এমন সময় আমাদের বিপদ দেখে কোষ্ট গার্ডের একজন তরুণ অফিসার ছুটে আসলো ইঞ্জিন বোট নিয়ে। সেদিন সে আমাদের রক্ষা করল এবং লঞ্চে উঠিয়ে দিল। সেই অফিসারের কথা আজও মনে পড়ে।
এরপর থেকে সবসময় রকেট স্টিমারে বরিশাল যাওয়া শুরু করলাম। এক সময় দিনে স্টিমার সার্ভিস ছিল। অপূর্ব ছিল সেই জার্নি। সকাল ১১টায় সদরঘাট থেকে ছাড়ত সন্ধ্যা ছয়টায় বরিশাল পৌঁছত। তারপর দিনের সার্ভিস হয়ে গেলো রাতে। কেনো হলো কে জানে। সন্ধ্যা ছয়টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে সকাল ছয়টায় বরিশাল পৌঁছে যায়। বারো ঘন্টার জর্নি। সদরঘাট পর্যন্ত পৌঁছানোর ঝক্কিতো আছেই। আবার বরিশাল থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় ছেড়ে সকাল ছয়টায় ঢাকা পৌঁছায়। ঢাকা বরিশাল যাওয়া যেনো এক যুদ্ধ এবং ব্যয়বহুল। শুধু তাই না, যারা প্রথম শ্রেনিতে জার্নি করতে চান তাদের জন্য টিকিট পাওয়া লোটো পাওয়ার সমান। মতিঝিলে ছিল বিআইডবিøউটিসির অফিস। সেখান থেকে ফার্ষ্টক্লাসের কিকিট কিনতে হতো।
একবারের একটা ঘটনা বলি. সেটা ১৯৯৬ সাল।
আলাউদ্দিন নামে একজন টিকিট ক্লার্ক ছিলেন তখন। তাকে গিয়ে একদিন বললাম ভাই, টিকিট লাগবে। একটা ডাবল কেবিন রিটার্ন সহ দেন।
টিকেটতো নাই ভাই।
কেনো নাই!
বোঝেনইতো ঈদের সময় ক্রাইসিস থাকে।
কিন্তু আমার টিকিট চাই।
দিতে পারব না।
আমি একটু জেদি এটা সবাই জানে। লিগ্যাল ব্যাপারে জেদি।
রোজার শুরুতে আসলাম তাও বলছেন টিকিট নাই!
জানেনই তো নানা কোটা। আর্মির কোটা, মন্ত্রী, এমপি, ডিসি সাহেবদের কোটা!
আমি রেগে বললাম, হ্যাং ইয়োর মন্ত্রী!
কি বললেন!
টিকিট দেন।
আপনি বরং চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যান। তাকে বলেন। আমি টিকিট দিলে আমার চাকরি চলে যাবে।
আমি চারতলায় চেয়ারম্যান সাহেবের রুমে গেলাম। প্রথমে আমাকে তার পিএ পাত্তাই দিল না। আমার দিকে তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। টাইপ রাইটারে টাইপ করছে আর কথা বলছে,
স্যার বিজি আছেন, দেখা হবে না।
আমার যে তার সাথে দেখা করতে হবে।
কি ব্যাপারে বলেন।
আপনাকে বলা যাবে না।
তাহলেতো দেখা হবে না।
আমি লোকটার চোখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম আপনি ভিতরে গিয়ে বলেন, যে একজন সাংবাদিক দেখা করতে চায়। দেখা করা তার দ্বায়িত্ব। সাথে আমার ভিসিটিং কার্ডটা দেবেন।
৩.
এতে কাজ হলো। একটু পরই চেয়ারম্যান সাহেব তার রুমে ডাকলেন আমাকে। বসতে বললেন। চা অফার করলেন, কিছু খাজুরে গল্পও হলো এবং ইন্টারকমে আলাউদ্দিনকে ফোন করে বললেন, টিকিট দিতে। সেই থেকে আর কখনো টিকেটের সমস্যা হয়নি। আমি মাঝে মাঝে আলাউদ্দিনকে টাকা সাহায্য করতাম। তার স্ত্রী ছিল চির অসুস্থ্য। তার চিকিৎসার জন্য দিতাম। লঞ্চের টিকিট পাওয়াও ছিল এক কঠিন কাজ। আজও। সব বড় স্যারদের জন্য রিজার্ভ থাকে ভিআইপি কেবিনগুলো। এখানেও কোটা। লঞ্চ মালিকদের আমি কাউকে চিনি না। একবার বিমানে ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি। আমার পাশের সীটে বসেছে সুরভি লঞ্চের মালিকের ছেলে। তিনি বললেন, যখনই কেবিনের দরকার হবে ফোন দেবেন। আমার দরকার হয়নি অবশ্য। লঞ্চের সেই অভিজ্ঞার পর আমি লঞ্চে খুব একটা জার্নি করি না। কখনো করলেও বরিশালে আমার বন্ধুরা টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়। কানাডা আসার পরও আমি বরিশাল যাই প্রতিবছর এক দুই বার। বেশিরভাগই বিমানে যাই।
কিন্তু এখন নতুন সময়। নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন উচ্ছাস, নতুন আবেগ। আর স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হয় না। লঞ্চ মালিকদের খামখেয়ালির দিন শেষ হয়ে গেছে। কারো কাছে ধর্না ধরতে হয় না টিকিটের জন্য।
বিআইডবিøউটিসির চেয়ারম্যানের পিএর উপেক্ষা সহ্য করতে হয় না বা আলাউদ্দিনদের মতো কেরানিকে তোয়াজ করতে হবে না। মন্ত্রী, এমপি, ডিসি সাহেবরা যত খুশী কোটা উপভোগ করুক আমার কিছু যায় আসে না। আমি বরিশাল চলে যাই পদ্মা সেতু দিয়ে। এমনকি চাইলে আমি নিজে ড্রাইভ করেও চলে যেতে পারি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার পার হলে হয়ে পোস্তগোলা থেকে এক্সপ্রেসওয়ে ধরব আমি। তারপর পদ্মাসেতু দিয়ে চলে যাব ভাঙ্গা পর্যন্ত।
চার লেনের চমৎকার এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় বরিশাল। যদি নিজেই ড্রাইভ করি পাশে বসে থাকবে আমার প্রেমিক। বাতাসে চুল উড়বে তার। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব। আহা এই দৃশ্য এখন আর কল্পনা না, বাস্তব। এদিকে মাওয়া প্রান্ত থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা একেনেকে পাশ হয়ে আছে। বরিশালে একদিন ট্রেনও যাবে! ট্রেনের লাক্সারি কোচে যেতে যেতে আমি আর জেসমিন স্মৃতিচারন করব। একবার বুড়িগঙ্গায় বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ডুবে যেতে নিয়েছিলাম সেই গল্প করবৃ।
জসিম মল্লিক : লেখক ও সাংবাদিক
Jasim.mallik@gmail.com
