ভজন সরকার : তোমার ও আমার অনেক কিছুতেই অমিল ছিল। শুধু শতভাগ মিল একটি বিষয়ে ছিল, রবীন্দ্রনাথ। তাই তো রবীন্দ্রনাথ নিয়েই মেতে থাকতাম; হ’তো অতিকথনও। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই যে অতিকথন, ভাবছো এতোসবের কি মানে ছিল কিংবা আছে?
মানে তো নিশ্চয়ই একটা আছে। প্রকৃতির অনেক কিছুই আমরা দেখি না। দেখেও বুঝি না। আমাদের চিরায়ত সংস্কার-শিক্ষা-বিশ্বাস এসবও অনেক কিছু প্রকৃতির কাছ থেকে পাঠ নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো জলে প’ড়ে পাতা ন’ড়ে ওঠার স্বাভাবিক সৌন্দর্যটা দেখতেও বাংগালিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে বছরের পরে বছর। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনার পরেই বৃষ্টি-আকাশ-চাঁদ-চাঁদেরআলো কেমন অন্য অনুভূতিতে ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে।
তুমি হয়তো জানো ‘হোমো সেপিয়ানস’ নামে আমাদের যে মানবজাতি তার উৎস কালো মানুষের আবাসস্থল আফ্রিকায় আজ থেকে দুই লক্ষ বছর আগে। পৃথিবী আর সৌরমন্ডলের বয়স তারচেয়েও অনেক অনেক বেশি। অথচ মানুষ প্রথম যেদিন বুঝলো, এই সৌরমন্ডল একটি নিয়মের আবর্তে চলছে। সেই নিয়মকে জানা এবং বোঝা সম্ভব। সেটাও আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। তা হ’লে এই এক লক্ষ সাতানব্বই হাজার পাঁচ শ’ বছর পৃথিবীর তথাকথিত বুদ্ধিমান মানবজাতি কি এই সাধারণ ধারণাটুকুও করতে পারে নাই? সৌরজগতকে জানা তো আরও অনেক অনেক পরে।
তা হ’লে মানুষের এই না-চেনা কিংবা না-জানা বিষয়গুলো, যাকে অজ্ঞতা বললে একটু কঠিন শোনায়, তাকে এক অলৌকিক শক্তি প্রভাবিত ব’লে চালিয়ে দে’য়া হয়েছে; যা আজও হচ্ছে। আমরা একে বলছি ঈশ্বর। সেই অলৌকিক ঈশ্বর ভাবনাকে ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ নামক বইয়ে এক প্রচন্ড আঘাতে যিনি নাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর নাম ষ্টিফেন হকিংস।
তুমি শুনলে খুশী হবে প্রচন্ড সাহসী এই বিকলাঙ্গ মানুষটি ঈশ্বর নিয়ে এই মহাতামাশাকে পদার্থ বিজ্ঞান আর সৌরবিজ্ঞানের মাধ্যমে একেবারে বাতিল করে দিয়েছেন। যে প্রকৃতিকে তথাকথিত ঈশ্বরের দান এবং সৃষ্টি বলে ঈশ্বর -ব্যবসায়ীরা বলে এসেছে এতোদিন, তাদের আবার নতুন কোন বিষয় খুঁজে বেড়াতে হবে। যে তুমি -আমি -আমরা তথাকথিত ঈশ্বরের নামে ভিন্নভিন্ন ধর্মের বেড়ায় নিজেদের পৃথক করে রেখে এসেছি এতোদিন, আস্তে আস্তে তার কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হচ্ছে। তাই তোমাকেই তো জানাবো সবার আগে এই খবরটা। এই দীর্ঘ বছরের পরিবর্তিত আমি-কে সহজ হবে তোমার আবার আগের আমিতে ফিরিয়ে নিতে।
মানুষ প্রতিদিন বদলায়, প্রতিমুহুর্তে বদলায়। যে মানুষটি ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ঢুকে সে মানুষটি কি একই মানুষ? দীর্ঘ বছর আগের আমাকে যদি আবার সেই রকম ভাবেই দেখতে চাও সেটাও সম্ভব নয়। এই চলে যাওয়া বছরে কতটা বদলে গেছে পৃথিবী; মানুষ বদলে গেছে; মানুষের বিশ্বাস বদলে গেছে!
অক্ষের চারপাশে পৃথিবীর সাথে ঘুরেঘুরে মানুষও থোকাথোকা দলাদলা গোষ্ঠীর বলয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একপাশে শুভ আর সৌন্দর্য, মানবতা আর সহানভূতি,বিজ্ঞান আর প্রগতি; অন্যদিকে অন্ধকারে ফিরে যাবার পেছন যাত্রা, অশুভ কুপমন্ডুকতা, আর আত্মঘাতি লোলুপ ঈশ্বর বিশ্বাস।
মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোনো দৈত্যকায় পরাক্রমশালী মহাশক্তি। এভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। আমি এই শীতার্দ্র উত্তর মেরুর দেশ কানাডার এক পাহাড় ঘেরা শহর হ্যামিলটনে, তুমি অনেক অনেক দূরে তৃতীয় বিশ্বের কোন এক অজ্ঞাত -অখ্যাত মফস্বল শহরতলিতে। মাঝে মাঝে ভাবি, এক সময়কার আমাদের সেই সমান্তরাল ভাবনাগুলো, যা একই সমতলে চলতো পাশাপাশি, সেটা কি আরও বেড়ে গেছে দূরত্বে? মাঝের বছরগুলোর এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে কতটুকু বদলে গেছি আমরা! কতটুকু বদলাতে পেরেছি আমরা!
সেদিন খুব কৌতুহলে অযোধ্যার রামমন্দির-বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতের এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় পড়ছিলাম। কেন বিশ্বের তাবৎ সংবাদ থাকতে এটা নিয়ে আমার ঔৎসুক্য? আর কেউ না জানুক তুমি তো তা জানো। বাবরি মসজিদ যেদিন ভাঙা হলো,তার পরের কয়েকটা দিন হিন্দু-মুসলমান মৌলবাদীদের যে তান্ডব সারা ভারত আর বাংলাদেশ জুড়ে, তার সাথে আমাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে। তুমি ছিটকে গেলে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে। মোড় ঘুরে গেল আমাদের জীবনের।
আমাদের মত হাজারো সাধারণ মানুষের জীবনের মোড় এমন অনেক ঘটনায় বদলে যায় নিমিষেই। অসহায় নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ আমরা কালের সাক্ষী হয়ে থাকি। কিছুই করার থাকে না আমাদের। ঘটনা ঘটে যায়। ঘটানো হয় একবার, বারবার। রাজনীতি সমাজনীতি এসবের মারপ্যাঁচে ভিন্ন ভিন্ন ধারাবাহিকতায় নতুন ঘটনার প্লট খোঁজা হয়। কিন্তু আমরা বহুদূরের সূর্যের মত তার উত্তাপে জ্বলে যাই। ধরতে পারি না, কিছুই করতে পারি না। শুধু নিঃশেষ হই। অসহায়ের মত ইতিহাসের কাছে আত্মসমর্পন করি।
কিন্তু ইতিহাস কি সঠিক ভাবেই সে সব লিখে রাখে? নাকি, অযোধ্যার রামমন্দির-বাবরি মসজিদের বিচারকদের মতো পৌরাণিক কাহিনীকেও ইতিহাসের অংশ বলে রায় দিয়ে মৌলবাদীদের কাছে আত্মবিক্রি করে দেয়। রামায়ণের রচয?িতা বাল্মিকী। রবীন্দ্রনাথ রামকে পৌরানিক কাহিনী বলেছেন। সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায়ের মত ঐতিহাসিকও রামায়নকে কবির কল্পনা ও আদ্যন্ত কাল্পনিক কাহিনী বলেই উল্লেখ করে বলেছেন। রামচন্দ্র কোন ঐতিহাসিক পুরুষ নন, তার কালও নির্ণয় করা যায় না। অথচ এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারক পৌরাণিক রামের জন্ম স্থানও নির্ধারণ করে দিলেন। ইতিহাস আর পুরাণের মধ্যে কী পার্থক্য থাকলো? প্রকারান্তরে ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের কাছেই হেরে গেল ইতিহাস। অবমাননা করা হলো হিন্দু পুরাণকেও। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতকে আরও একধাপ নিচে ছুঁড়ে দেয়া হলো আবারও।
তুমি হয়তো বলবে এসব তো হচ্ছেই সারা পৃথিবী জুড়ে, আমেরিকা থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে এশিয়া। ধর্মকে রাজনীতির মোড়কে একের বিরুদ্ধে অন্যেকে ব্যবহারের হাতিয়ার করা হচ্ছে সর্বত্র। এটা কি নিভে যাবার আগে জ্বলে উঠা শেষ ফুৎকার? মানুষ কি সেই সর্বনাশা আগুনে জ্বলে পুড়ে আবার সোনা হয়ে উঠবে? মানুষ কি জলহীন শুকনো আগুনমুখা নদী সাঁতরে উঠে আসবে সুবর্ণ গাঁয়ে? নাকি, বিচ্ছিন্ন হতে হতে আমাদের মত ছিটকে পড়বে দুই মহাদেশে?
সেদিন তুমি ছিলে নির্ভয়, নির্ভার, অবিচল। পলাতক আমি পালিয়েছিলাম যেদিন উপদ্রæত রানওয়ে ধরে। পেছনে ফিরে দেখার সময়ও ছিল না আমার। এই জলবিহীন নদীর উপাখ্যান আমার পলাতক জীবনের লিমেরিক; সেদিন যা তোমাকে বলা হয়নি, সে না বলা কথারই দূরন্ত এক সুনামি।
তুমি বলবে, “এই এতো বছরে এতটুকুও বদলাও নি তুমি?”
যে বদলাবার সে কয়েকদিনেই বদলে যায়। একেবারে খোল্নল্চে সমেত বদলায়। আর পাথর বদলায় সহস্র বছরে; দৃষ্টির আড়ালে কণাকণা বদলায়; ঘষেঘষে বদলায় জলে রোদে বাতাসে।
তুমিতো জানোই আমি এক বিবর্ত পাথর সেই বহুকাল থেকেই। আমার পরিবর্তন কি সম্ভব এই দশকের নিমিষে? তাই দেখো, এখনো কেমন তোমাকেই লিখছি অবসরে, জীবনের মধ্যদুপুরে?
ভালো থেকো এই কালো মাটির বাসায়, শ্যামল সুখের ধরায়। মনে রেখো এই পৃথিবীর ওপারে আর কোনো পৃথিবী নেই। তাই এই পৃথিবীকেই ভালো রেখো, নিজেও ভালো থেকো।
ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা