বিদ্যুৎ সরকার : কেমন আছিস সীমান্ত?
ছয়.
কেমন আছিস সীমান্ত? কতো দিন, কতো ঘন্টা পর তোকে লিখছি। আমি খোঁজ না করলে হয়তো আগামি এক যুগেও তোর হদিস মিলবে না। যেমন দুই যুগ আর হঠাৎ কোলকাতা চলে এলি পুজো দেখবি বলে। কোলকাতার পুজো ভিশন মিস করিস তাই না? একাত্তরের যুদ্ধে ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে এলি এ পারে।
বারাসাতের দশ বাই আঠার ফিট বাঁশের বেড়ায় ঘেরা একটি ছোট্ট ঘরেই তোদের পাঁচজনের আবাসন। সেখানেই তোর সাথে হঠাৎ পরিচয়। আজঅব্দি সে সুতোর টানেই ঝুলে আছি আমরা। পুজোয় এবার আমাদের আগের মতো রাতভর ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা, থেমে থেম ঘুগনী, চটপটি, আইসক্রীম আর গরম চা/কফি। ফুরসুত পেলেই একাত্তরের প্রসঙ্গ চলে আসতো বার বার। অন্য দিনগুলোতে কলেজ স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড, ফাইন আর্ট একাডেমিতে প্রদর্শনী দেখে নন্দনে এসে থমকে যেতাম আমরা। আবার গরম কফি, পাকুরা আর ছবি দেখা। মনে আছে নন্দনে আমাদের দেখা শেষ ছবি ছিল ‘রোববার’। এরপর আমাকে নিয়ে দক্ষিনাপন গিয়েছিলি বন্ধুদের জন্য উপহার কিনতে। আমার পছন্দের উপর তোর আস্থাটা অনেক বেশি। এবারের তোর দেয়া সাইড ব্যাগ (পার্টস) চিরসঙ্গী হয়ে ঘুরে বেরায় আমার কাঁধ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। যেমন হাঁটতে বসতে তোর হাত ছুঁয়ে থাকতো আমার কাঁধ। এখনো তাই মনে হয় তুই ছুঁয়ে আছিস আমাকে। এখনো কি সিগারেট খাচ্ছিস? আমাকে ছুঁয়ে প্রমিজ করেছিলি টরন্টো ফিরে এসে এসব ছেড়ে দিবি। …. ইস্ কী বাজে ঠেকছিল সেদিন। এখন কোলকাতার আকাশ অনেক নীল ঠিক তোদের টরন্টোর আকাশের মতোন। দুষনমুক্ত আকাশ, সুনসান সড়ক, জনপথ- কোথাও কোন জ্যাম নেই, ঠিক তোদের শহরের মতোন। তুইতো এমন আকাশই চাইতি ছবি তুলতে গিয়ে, তাই না? ‘একান্তে’ তোর তোলা আমার ছবিগুলো প্রিন্ট করে ফ্রেমবন্দী করেছি। কেমন হয়ে গেল আজ সমস্ত পৃথিবীর। একই নীল আকাশ, দুষনমুক্ত চারিধার, পাখিদের দখলে আস্ত আকাশ। মাছেদের সীমাহীন ডুব সাতার জল যমুনায়। সব্বাই আজ বড় স্বাধীন, মুক্ত। শুধু আমরাই গৃহবন্দী অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। সীমান্ত আজ তোর কথা বারবার মনে পড়ছেরে। টিভির খবরে পৃথিবীর তাবৎ শহরগুলোর মৃতের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার ছবি দেখছি রাতদিন। তুই সাবধানে থাকিস সীমান্ত। আরেক পুজোয় আবার দেখা হবে, আবার একসাথে দু’জনে রাতভর ঘুরবো ঠাকুর দেখবো, আতশবাজী আর, ঘুগনী চটপটি খাবো সাথে গরম চা/কফি। মনে পড়ে? আতশবাজির আলোকচ্ছটায় আকাশ রঙ্গিন হলে তুই খুশি হতি? তাই বলে শব্দবাজিগুরো তোকে ভীষণ জব্দ করে দিতো। যতবার শব্দবাজি ফাটতো ততবারই তুই আমাকে ভয়ে জড়িয়ে ধরতি। আসলে তুই একটা ভিতুর ডিম? যখন তুই আমাকে জড়িয়ে ধরিস তোর গা থেকে একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ আমাকে আপ্লæত করে। কী পারফিউম তুই মাখিস? সেবার তোকে ‘পুজোর গিফ্ট’ হিসেবে একটি পারফিউম কিনে দিতে চাইলাম– তুই নিলিনা, বরং রাগ করে বসলি। তোর অভিমানের পাল্লাটা বরাবরই ভারি ছিল। শুধুই অভিমান জমে জমে ভালবাসা হয়ে যায় অজান্তেই। সে ভালবাসা কি কেবলই স্মৃতি? তবে কেন এক পাহাড় স্মৃতি চাপিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাস অনন্তের অজানা ঠিকানায়?
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা