বিদ্যুৎ সরকার : সে দিন হঠাৎ করেই অলৌকিকভাবে চৈতির সাথে দেখা। অনেকটা ভুত দেখার মতো। প্রথমতো নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। হয়তো আমার দেখার ভুলও হতে পারে এই ভেবে। যখন তার অনেকটা কাছে চলে আসলাম তখনই সমস্ত ভুল সত্যি হয়ে গেল এক পলকেই। এ চৈতি ছাড়া আর কেইবা হবে – কার্লড বয় – কাট চুল, সাইড থেকে ওর টোল পড়া গালের অংশটুকুও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ভুল বোঝা বুঝির অবসান হলো নিমিষেই। ও কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়ে ঘুরতেই আমাকে দেখেতো ‘থ’! এক দৌড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে প্রায় ঝুলে পড়ার উপক্রম। কিছু বলার আগেই সোজা দাঁড়িয়ে ধুম-ধাম বার কয়েক ঘুষি বসিয়ে দিল আমার দিল্ বরাবর। এমনটাই হলো চৈতি। যখন তখন যা খুশি ইচ্ছা তাই বলতে পারে, তাই করতে পারে। পাত্রটি কে? তাতে কিচ্ছু আসে যায় না। শুধু আমার বেলায় মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম হতো। চৈতির এহেন চারিত্রিক বৈশিষ্টের জন্য সব্বাই ওকে কম বেশি সমীহ করে থাকতো। অন্যান্যরা যে নামেই ওকে ডাকুক না কেন আমি চৈতি কে ডাকতাম ‘তুফানী’ নামেই। চৈতি হাওয়ার প্রবলতা, ভয়াবহতার কথা ভেবেই তাকে এ নামে ডাকা। সে ভীষণভাবে একরোখা, মুখে যা উচ্চারণ করবে সেটা সে করতে বদ্ধ পরিকর। প্রথম থেকেই ওর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতাম সবসময়। যার দরুন চৈতি আমার যে কোন সিদ্ধান্ত সহজেই মেনে নিত। অবশ্য মাঝে মধ্যে এর ব্যতিক্রমও ঘটে যেত। তবে ওর বোল্ডনেস প্রশংসনীয়। সত্যটাকে সত্য বলতে কখনো পিছ পা হতো না। তেমনি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলায় তার জুড়ি মেলা ভার। যে কোন প্রতিক‚লতার মধ্যেও সে তার কথায় অনঢ় থাকতো। তার এসকল বৈশিষ্ট তার খুব কাছ থেকেই আমার দেখা ও জানা। চৈতির সাথে পরিচয় কলেজের প্রথম বর্ষের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে। ও আনমনে গেয়ে চলছিল কবি গুরুর গান, ‘তুমি কোন্ কাননের ফুল, কোন্ গগনের তারা…।’ গান শেষে করতালিতে মুখরিত সমগ্র হলরুম। পরপরই আমার আবৃত্তি পরিবেশনের পালা। আবুল হাসানের ‘পৃথক পালংক’ থেকে কবিতা পাঠ। সব্বাই হাত তালি দিয়ে আমাকে উজ্জীবিত করলো। আরো একটি কবিতা পাঠের জন্য অনুরোধ জানালে আমি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ পাঠ করলাম। অনুষ্ঠান শেষে হলরুম থেকে বের হতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে নারী কন্ঠে একজন বলে উঠলো, তোমার বনলতা সেনকে এদ্দিনে খুঁজে পেলে তা’হলে? শুনে আমি তো হতবাক, ‘কে এই ললনা অমন সুন্দর করে আমাকে টিজ্ করলো?’ পিছন ফিরে তাকাতেই টোল পড়া গালে মৃদু হেসে জানালো ওর নাম ‘চৈতি’, একই ক্লাসে, একই ডিপার্টমেন্টে পড়ছে। কী আশ্চর্য, একই সাথে পড়ছি অথচ চিনতে এতো দেরি হচ্ছে! আসলে কলেজের প্রথম বর্ষের উচ্ছলতা, উদ্যমতা ক্ষণিকের ঘটে যাওয়া অনেক কিছুকে ভুলিয়ে দেয়, নতুন কিছুকে কাছে টেনে নেয়। এত এত নতুন ও অচেনা মুখের সমাগম হয়ে থাকে যে সবগুলো মুখ, সব ঘটনা একসাথে মনে রাখা খুবই কঠিন। এই প্রথম আমি কিছুটা যেন ব্যাক্ ফুটে বেট করতে গেলাম। নামের সাথে তার কথা বলার প্রকাশভঙ্গী ও বোল্ডনেস আমাকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করেছিল। সংক্ষেপে আমার পরিচিতি বলতেই সে সাথে সাথে আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই গড় গড় করে বলে যেতে থাকলো। অফ পিরিয়ডে আমরা ক’জন মিলে যে টেবিল চাপড়িয়ে ফিল্মি গান ও কবিতা পাঠ করে থাকি সেটাও তার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। টেবিল টেনিস, ক্রিকেটও যে আমার প্রিয় সেটাও এ দু’দিনের কলেজ জীবনে জানা হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে প্র্যাকটিকেল ক্লাস যে মাঝে নাঝে ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত তাও তার অজানা নয়। সংক্ষিপ্ত এ সময়ে আমার সম্পর্কে এতো কিছু যার জানা হয়ে যায় তাকে সমীহ না করাটা নির্বুদ্ধিতা।
সময়ের সাথে সাথে ও’র – আমার সম্পর্ক সহ-পাঠির চেয়ে সহমর্মীর দিকে পাল্লাটা ভারি হতে লাগলো। বছর না ঘুরতেই চৈতি আমার খুব কাছের বন্ধুদের একজন হয়ে গেল। আমাদের কলেজের কালচারাল যত প্রোগ্রাম, খেলাধুলা, সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন কাজে আমার সাথে সহায়তার হাত প্রসারিত করেছে সময় অসময়। ডিপার্টমেন্টাল পিকনিকগুলোতেও তার তৎপরতা থাকতো চোখে পড়ার মতোন। একবার স্টাডি ট্যুরে আমাদের যেতে হয়েছিল কক্সবাজারে জ্যুলজিকাল স্পেসিম্যান কালেকশন করতে। সেই সূর্য উঠার আগেই আমরা সি-বিচে গিয়ে জড়ো হতাম সবাই। যদিও মেয়েদের রাতে থাকার ব্যবস্থা ছিল পাশের একটি হোটেলে, সকাল বেলায় তারা ঠিকই সময় মতো বিচে চলে আসতো। চৈতি ঠিক ঠিক আমার পাশেই থাকতো সারাক্ষণ। সকাল থেকে ঘুমাতে যাবার আগ অব্দি চৈতি আর আমি একই সাথে, একই পথে হেটে চলতাম। কথা বলতাম অবিরাম। না বলা অনেক প্রাসঙ্গিক -অপ্রাসঙ্গিক বিষয় – আসয় চলে আসতো দু’জনের অজান্তেই। যে ক’দিন ওখানে ছিলাম প্রতি বিকেলেই বিচে যেতাম সূর্যাস্ত দেখতে। একদিন ফেরার পথে চৈতিকে একটি কড়ির মালা কিনে দিয়েছিলাম। সাথে সাথে ওটা গলায় পড়ে নিল মহানন্দে। বেশ মানিয়ে ছিল ওকে।
– তোমাকে কী দেয়া যায় বল তো?
– তোমার যা খুশী ইচ্ছে।
– যখন কড়ির মালা কিনি তখন তোমাকে কী কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম?
– তা অবশ্য করোনি, কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দ হোয়েছে তোমার সুন্দর উপহারটি। একটি ছোট্ট মেয়ে অনেকগুলো বকুল ফুলের মালা হাতে নিয়ে ওদের পিছু পিছু হাঁটছিল। চৈতি দুটি মালা মেয়েটির কাছ থেকে কিনে নিয়ে আমাকে দিল। আমি সাথে সাথে একটি তাকে দিতে চাইলে সে বললো, ‘রেখে দেও তোমার কাছে পড়ে নিয়ে নেব।’ কিন্তু সে দু’টি মালার একটি আজও নেয়া হয়নি চৈতির। হয়তো কোন কবিতার বইয়ের ভাঁজে এর বিবর দেহ এখনো পড়ে আছে স্মৃতির সুঘ্রাণ বুকে নিয়ে।
অদূরেই দৃশ্যমাণ সারি সারি ঝাউগাছ গাছ দেখে চৈতি গুন গুনিয়ে গেয়ে উঠলো, ‘চলনা দীঘার সৈকত ছেড়ে ঝাউ বনের ছায়ায় ছায়ায়, শুরু হোক পথ চলা, শুরু হোক কথা বলা।’
– এখানে একটু কারেকশন হবে, ‘চলনা দ্বিধার সৈকত ছেড়ে…..’
– ‘দ্বিধাটা’কার তোমার না আমার?
– তোমার কিংবা আমার অথবা দু’জনেরই।
– বড় ভাবনায় ফেলে দিলে তুমি।
– ফরগেট দিস্। অন্য প্রসংগে আসা যাক।
– কাল বাদেই আমাদের ফিরে যাবার পালা
যে কটা দিন এখানে কাটিয়েছি বেশ ভালো, স্মৃতিময়।
– মধুর স্মৃতি কখনো কখনো দুঃখও বয়ে আনে।
– বুঝতে পারলাম না, অনেক গভীরে চলে গেলে কী?
– সময়ই বলে দিবে।
– হেয়ালি করো না, বলে ফেল প্লিজ।
– কিছু কিছু কথা থাকে বলা যায় না, বুঝে নিতে হয় যে।
– থাকনা না বলা কিছু কথা, অপেক্ষায় থাকবো সেই আদুরে দিনটির জন্য। ভেজা ভেজা রোদ্দুরের তাপে ফুলের মতো ফুটে উঠবে আপন বৈভবে একদিন সত্যি।
– ‘টাইম এন্ড টাইড ওয়েট ফর নান্।’
– ‘রাতের সব তারারাই লুকিয়ে আছে দিনের আলোতে… ’
কক্সবাজার থেকে ফেরার প্রায় মাস ছয়েক পর হঠাৎ একদিন চৈতি জরুরি ভিত্তিতে আমাকে আড়ংয়ের ক্যাফেতে দেখা করতে বললো। আমিও সময়মত সেখানে পৌঁছে গেলাম, চৈতি সময়ের আগেই ওখানে অপেক্ষা করছিল। কিছুটা বিষণœ দেখাচ্ছিল ওকে। ওর মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করলাম চা না কফি?
– ক্যাপিচিনু সাথে ফ্র্যান্স ফ্রাই দ্যাটস্ এনাফ।
ওয়েটার কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি, ফ্র্যান্স ফ্রাই এনে টেবিলে রেখে চলে যেতেই কথা বলা শুরু।
– আগেই তোমাকে বিষয়টি বলা উচিৎ ছিল কিন্তু, আমি ব্যাপারটা তখন এতটা গুরুত্ব দেইনি। এখন কেমন করে বুমেরাং হয়ে গেল নিজের অজান্তেই। বেশ কিছুদিন আগেই এপ্লাই করা হয়ে ছিল স্কলারশিপের জন্য, আমি ভেবে ছিলাম হবে না, খামোখাই এ চেষ্টা! কিন্তু এখন দেখি হয়ে গেল। সবাই বলছে এ সুযোগ যেন মিস্ না করি। দুই বছরের কোর্স শেষে জব পাবার সুযোগ রয়েছে। আল্টিমেটলি ইচ্ছে হলে সে দেশে স্থায়ী বসবাসও করা যেতে পারে।
– কোথায় যেতে চাচ্ছ?
– কানাডার উইন্ডসর ইউনিভার্সিটিতে।
– আমার কি করণীয় এ ব্যাপারে?
– যেহেতু তোমার রেজাল্ট আমার চেয়ে ভাল আমি চাই তুমিও এপ্লাই কর। হয়তো আমার পরের সেশন তোমাকে ভর্তি হতে হবে।
– আমি যাবো এ ধারণা কি ঠিক? আর এটা আগে বলোনি কেন?
– যাওয়া না যাওয়া সম্পূর্ণ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন আমি ফিল্ করলাম তাই বললাম। আরো একটি বিষয় তোমার কাছে জানতে চাই, আমি কি সেখানে যাব? একটু ভেবে বলবে প্লিজ। সেদিনের কথোপকথন অমিমাংসিত রেখেই আলোচনা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দু’জনেই আড়ং থেকে নেমে যার যার বাসায় ফিরে গেল।
তার পর বহুবার পরস্পরের সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কিন্তু সেই অমিমাংসিত কথার প্রসংগ কোনদিন আলোচনায় উঠে আসেনি। একদিন সত্যি সত্যি চৈতির কানাডা চলে যাবার সময়ও ঘনিয়ে এলো। যে দিন ও কানাডায় রওনা দিবে সেদিন এয়ারপোর্ট অব্দি ফাগুন এসেছিল। যাবার মুহূর্তে চৈতির হাতে একটি ইনভেলপ গুঁজে দিয়ে বলেছিল ভাল থেকো, আবার দেখা হবে কোনদিন। এ দেখাই ছিল সে সময়ের শেষ দেখা। চৈতি প্লেনে উঠে গেল। এখন মন খারাপের পালা। দুঃখময় সময় কিছুটা কাটিয়ে উঠলে ফাগুনের দেয়া ইনভেলপ খুলে কার্ডটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিল। ফাগুনের সেই সুন্দর হাতের স্পষ্ট লেখা- ‘বনলতা চলে যায় বনবাসে!’ চৈতি কী মনে করে বার দুয়েক হেসে ছিল সে সময়। জানালার কাছে ওর আসন থাকায় বার বার আকাশ দেখার মনোরম সুযোগ ছিল তার। আকাশ এতোটা নীল, এতোটা নির্মল দু’চোখ ভরে যায় স্নিগ্ধতায়। তবুও মন পড়ে রয় দেশের সবুজের সীমানায়।
কানাডায় পৌঁছে ইউনিভার্সিটির সমস্ত ফর্মালিটিজ শেষ করে ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি নিতে হয় তাকে কেননা কোন অবস্থাতেই পিছিয়ে পড়া যাবে না, প্রতি সপ্তাহেই ওকে এসাইনমেন্ট জমা দিতে হয় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। ক্লাস পরীক্ষা, সপ্তাহান্তে নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নেয়া – এ সকল ব্যস্ততার জন্য সবার সাথে সব সময় যোগাযোগ করা হয়ে উঠে না। ওখানে যাবার পর শুধু একবারই ফাগুনের সাথে ফোনে কথা হয়েছিল, তখনই চৈতি জানিয়ে ছিল সবকিছু একটু গুছিয়ে নিয়ে পড়ে যোগাযোগ করবে। ধীরে ধীরে উভয়ের পক্ষ থেকেই যোগাযোগটা হ্রাস পাচ্ছিল তখন। এতে কারোরই কোন অভিযোগ বা অনুযোগ কিছুই ছিল না। মূলত প্রতিনিয়ত দেখা না হওয়া ও চৈতির কানাডা চলে যাওয়া অনেকটা প্রভাব ফেলেছে।
আজ এদ্দিন পড় আবার দু’জনে দেখা, অবাক হবারই তো কথা! মাইল মাইল পথের দূরত্ব, কথা না বলার সময়ের ব্যবধান সবকিছু যেন নিমেষেই ঘুচে গেল কোন এক যাদু বলে। কে কেমন করে যে রিএক্ট করবে সে ক্ষমতাও বুঝি হারিয়ে ফেলেছিল দু’জনেই।
– তুমি তো হাওয়া মুভি দেখছো তাই না?
– আর তুমি কোন মুভি?
– একই মুভি একই সময়ে।
– কিন্তু এক সাথে বসা হবে না হয় তো।
– ঠিক আছে মুভি দেখা শেষ করেই মিট করছি দু’জনে।
– ও কে।
এটা বলেই চৈতি হাঁটতে শুরু করে দিল হল অভিমুখে। ফাগুন তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের মনেই বলে উঠলো, ‘একি চঞ্চলতা জাগে আমার মনে ভাল লাগে কতো ভাল লাগে…..’। চৈতি চঞ্চল, চপল, উচ্ছল ফাগুনের এক দমকা হাওয়া যেন। মুভি শেষ হলে ভীড়ের মাঝ থেকে খুঁজে বের করে টেনে নিয়ে গেল গাড়ি পার্কিং লটে। লাল রঙের কিউট একটি গাড়ি, সদ্য কেনা মনে হয়। ডোর খুলে দিয়ে বসতে বলে নিজে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। গাড়ি চালাতে চালাতে কথা হচ্ছিল দু’জনায়,
– কী পছন্দ তোমার, বেঙ্গলি অর ইন্ডিয়ান ফুড?
– এজ ইউ লাইক।
– তা হ’লে ‘আড্ডা’তেই মনযোগ দেই।
– খাওয়া বাদ দিয়ে আড্ডা?
– আরে না, সুন্দর, সুস্বাদু বাংলা দেশী খাবারের রেস্তোরাঁ। ওখানে খেতে খেতে আড্ডাও চলবে। নিশ্চয়ই মন্দ হবে না ব্যাপারটা!
– একটা বিষয় নিশ্চিত করতে চাই, বিলটা কিন্তু আমাকে পরিশোধ করতে দিতে হবে।
– খাওয়ার আগেই বিলের প্রশ্ন আসে কেমন করে? নিয়ে আসলাম আমি খাবার প্রস্তাব সেটাও আমার আর, তুমি কি না দিবে বিল শুনে প্রিত হলাম!
– আচ্ছা তোমার সন্তান-সন্ততি, পতি দেব সম্পর্কে কিছু বল শুনি।
– এক কথায় জবাব দিতে গেলে বলতে হয় ভাল আছি, একা আছি।
– মানে কি? একটু বুঝিয়ে বলবে?
– তুমি যেমনটা দেখেছিলে ঠিক তেমনি আছি।
– তার মানে তুমি বিয়ে থা করোনি?
– আমি তো এতক্ষণ তাই বলতে চেয়ে ছিলাম মনে হয়। আর তোমার কি খবর?
– তথৈবচ। মানে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। না করার পিছনের ইতিহাসটা তোমার জানা প্রয়োজন মনে করি। তা’হলে ভুল বুঝার অবকাশ থাকবে না কারোর।
– বল শুনি।
– অনার্স পাশ করার পর হঠাৎ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। রোগ নির্ণয় করতে গিয়ে বেশ কিছু টেস্ট করতে হয়েছিল তখন। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসে। ভবিষ্যতে কখনো আমার পক্ষে সন্তান উৎপাদন সম্ভব হবে না। বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে বিষন্নতায় ঠেলে দিয়েছিল। নিশ্চয়ই এ অবস্থায় আজীবন আমার কুমারত্ব বরণ করাটা মোটেও দোষের হবে না?
কথা বলতে বলতে আডডা’র দোর গড়ায় এসে পড়লে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে ঢুকে ডিনারের অর্ডার দিয়ে দিল চৈতি দু’জনের পছন্দের খাবারগুলো।
– তোমার বিয়ে না করার আর কি কারণ থাকতে পারে।
– বিয়ে নাইবা হলো এক জীবনে। তুমি পারলে আমিও পারবো আশা করি।
– তোমার উইন্ডসর থাকার কী হলো?
– ওখানে পি এইচ ডি শেষে ডিপার্টমেন্টেই শিক্ষকতায় নাম লিখালাম। অতঃপর বেশ কিছুদিন বাদে টরন্টোয় মুভ করলাম, এখানেই থেকে যাব ভাবছি।
– তার মানে দেশে আর ফিরছ না?
– আপাতত তাই। তবে, কিছুদিনের জন্য যাব বাবা-মাকে দেখে আসি। অনেক দিন হলো যাওয়া হয় না, তাদেরও বয়স হয়ে গেল। যদিও অন্যান্য ভাই-বোনরা পাশে আছে তবুও, আমার মাঝে মাঝে যাওয়া উচিৎ। তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
– একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে আমার কানাডায় আসা, এর আগেও একবার আসতে হোয়েছিল আমাকে। বেশ ভাল লেগেছে দেশটিকে। ভাবছি আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে পি আর হিসেবে এখানে আসা যায় কি না।
– চলে আস ভালোই হবে একজন প্রকৃত ও পরীক্ষিত বন্ধুর অভাব ঘুচবে আমার। ইচ্ছে করলে আমার সাথেই একই বাসায় থাকতে পারবে যদি, তোমার কোন আপত্তি না থাকে।
– কী যে বল, আপত্তি – বিপত্তি কোনটাই থাকার কথা নয় বরঞ্চ, আমার অর্ধেক কষ্ট কমিয়ে দিলে তুমি।
– ‘রেললাইন বহে সমান্তরাল…..।’ গানটি নিশ্চয়ই তোমার মনে থাকার কথা, আমাদের দু’জনের অবস্থা অনেকটা তেমনি। পাশাপাশি, কাছাকাছি দু’জনের সহাবস্থান আজীবন তাই বা কম কিসের!
– হুম, জীবন তো একটাই হোক না তা, ‘আধেক চাওয়া আর, আধেক পাওয়া..’।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা