বিদ্যুৎ সরকার : পাহাড়ের উচ্চতা আর সবুজের স্নিগ্ধতা, সমুদ্রের বিশালতা আর তরঙ্গায়িত সফেদ ফেনা আমাকে বার বার কাছে টেনে নিয়ে যায়। স্কুলের পাঠ্য বইতে রবি ঠাকুরের ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে সমুদ্র সম্পর্কে আমার আগ্রহটা বেড়ে যায় এবং তখন থেকেই সমুদ্র দর্শনে নিজেকে নিমগ্ন রাখি। অপেক্ষায় ছিলাম কবে, কখন সমুদ্র দেখবো, আমার একটি ইচ্ছে পূরণ হবে। এরপর যতবার সমুদ্রের কাছে গিয়েছি ততবারই সমুদ্র নতুনরূপে, নতুনভাবে, নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যে আবির্ভূত হয়েছে আমার সম্মুখে। কক্সবাজারের সমুদ্র যেন দিগন্ত বিস্তৃত বিশালতায় বিরাজমান। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতকে ছেড়ে দূরে আকাশ ছুঁয়েছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম এর বিশালতার দিকে। এরপর ছুটে গিয়েছি কাছের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে। ‘সিন্দাবাদ’ ফেরি থেকে সমুদ্রের জলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম গন্তব্যে পৌঁছানো অব্দি। নাফ নদী ছেড়ে সমুদ্রের মোহনায় সবুজ মিশে আছে নীলে। এরপর অদূরে দৃশ্যমান সেন্টমার্টিন দ্বীপ। দ্বীপের চারিধারে থৈ থৈ জলমগ্ন সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আপন বৈভব নিয়ে, আকাশের নীল যেন দ্রবীভ‚ত হয়ে পড়েছিল সমুদের জলে। শান্ত নীল জলের সৌন্দর্য্যে আমাকে অশান্ত করে তুলেছিলো বারবার। আবার ছুটে গিয়েছি বকখালির সমুদ্র সৈকতে। নিস্তরঙ্গ সমুদ্র শান্ত মোহনীয়, কোলাহল বিহীন। শুধু ঝাউ গাছের পাতায় মৃদু বাতাসে শন্ শন্ ভাল লাগার কল-কাকলি। পুরির সমুদ্র- উথাল-পাতাল ঢেউ। গাছের সবুজতা ছুঁয়ে গেছে জলের সবুজকে। নিরস প্রজাপতিরা মন্দিরের খোদাই করা পাথুরের শরীরে বসে পাখা নাড়ায় রসসিক্ত হবার দূর্বার আশায়। সমুদ্র দর্শন কত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে পড়ে নিমিশেই। ভূবন মাতানো ভূবনেশ্বর দূরে ঠেলে দিয়ে “ঝাউ বনের ছায়ায় ছায়ায় শুরু হোক পথ চলা, শুরু হোক কথা বলা।” দীঘার সমুদ্র সৈকতের প্রতিপাদ্য বিষয় চোখের রূপালী পর্দায় রূপময় হয়ে থাকে সূর্য ডোবার অলস বিকেলে। বলেছিলাম আমরা সমুদ্র দেখতে যাবো দু’জনে। পরস্পরের মাঝামঝি অবস্থান করবে শুধু ভালোবাসার মনোময় দেয়াল। একে অপরকে আবিষ্কার করবো অদেখা, অজানার নিরীখে। ঝিনুক যেমন সযতনে মুক্তোকে লুকিয়ে রাখে তার বুকে, ভালোবাসাও লুকিয়ে থাকে হৃদয়ের সুগভীরে মুক্তো প্রতিম। হৃদয় সমুদ্রের অতল জলের আহবানে আমরা অবগাহন করবো, ভালোবাসার মুক্তো কুড়াবো দু-হাত ভরে। আমার ইচ্ছেটাকে পাশ কেটে চলে গেলে অবলিলায়। আবারো আমি চিম্বুক পাহাড়ের গল্প শোনালাম, সবুজের স্নিগ্ধতার পরশ দিলাম, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখালাম তবুও তুমি ফিরিয়ে দিলে না ভেবে না জেনে। আয়নার সম্মুখে আমার মুখোমুখি আমি। আমার চোখের দৃষ্টিতে সকল উদারতা ঝাপসা হয়ে আসে। রোদ-ছায়ার ঝিকিমিকি বালুর সৈকত, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া টুপ টুপ বিভ্রম। অহেতুক কাঁঠাল চাপার সুঘ্রাণে বুক ভরে যায়। দীর্ঘশ্বাসগুলো দীর্ঘ হতে হতে দিগন্ত রেখা অতিক্রম করে চলে যায় অনন্তে। আটপৌরে ভাবনার ঝুল জমতে থাকে মনের জানালায়। মনে হয় কয়েক ঘন্টা ধরে কয়েক শ’ বছর সমান পুড়ছি। একটি টেলিফোন কতশত ‘না’সূচক সত্যের উপমা হয়ে আমার চার দেয়ালে সাপটে থাকে দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী। কেমন করে আমি মুছে দেব পাহাড় আর সমুদ্রের সুখময় দৃশ্যগুলি।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা