বিদ্যুৎ সরকার  : শ্রাবণের এক পশলা বৃষ্টির মতোন স্মৃতিগুলো আমাকে সিক্ত করে দেয়, রিক্ত করে দেয়। আমার সবটুকু ভালোবাসা একটু একটু করে কখন যে শেষ করে দিয়েছি তা তো আমার অজানা এক “গোপন হালখাতা”। বৃষ্টি পড়ে স্মৃতি ঝড়ে মনের অলিন্দে। আমি কেবলই হারিয়ে যাই স্মৃতির গভীরে। খড়কুটো মনে করে যা কিছু ধরছি সব কিছুই স্মৃতিময় একগুচ্ছ গোলাপ কিংবা গুচ্ছ গুচ্ছ রজনীগন্ধা। কী মনে করে বুক পকেট হাতরিয়ে দেখি পড়ে আছে ঝড়া বকুলের শবদেহ। এর মিষ্টি সুবাস এখনো বুক ভরিয়ে দেয়। এই তো সেদিন শীতের জেকেট পড়তে গিয়ে পকেটে অযতনে, অবহেলায় পড়ে থাকা আস্ত বিবর্ণ গন্ধরাজ কী অভিমানে আঙ্গুলের স্পর্শে কেমন সজীব হয়ে উঠলো। এ তো ছয় বছরের পুরনো স্মৃতির নিরঙ্কুশ ভালোবাসার একটি ‘কোট পিন’- শোভা বাড়ায়, গন্ধ ছড়ায় অহর্নিশ সারাদিন। ‘স্মৃতি সততই সুখের’, আমার সুখময় স্মৃতিগুলো কেবলই দুঃখের সীমানায় টেনে নিয়ে যায় বারবার। আমি দুঃখ অনুভব করি, কষ্ট পাই কেবলই কষ্ট। সবাই তো স্মৃতি রোমন্থন করে সুখী হয়, আমি কেন কষ্ট পাই সুখের স্মৃতিগুলো মনে করে করে। সেকি সুখময় কষ্ট নাকি, কষ্টদায়ক সুখ। আমার কিইবা এমন স্মৃতি আছে যা সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, এমন কিইবা স্মৃতি আছে যা আমাকে দুঃখের দংশনে নীলোৎপল করে রাখবে মনের সরোবরে।

আমি মেঘলা আকাশ হতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে আকাশও কেমন বে-হাত হয়ে গেল এক রোদেলা দুপুরে, আমি তো ছায়া সুনিবিড় প্রান্তর হতে চেয়েছিলাম কেমন করে বৃক্ষরা সব লুটিয়ে পড়ে বৈশেখের ঝড়ো হাওয়ায়। আমি তো প্রবাহমান নদী হতে চেয়েছিলাম, নদী তো চলতে চলতে থেমে যায় উজান কোন স্রোতে। এখন এখানে আমি একা, এখানে আমার কোন অহংকার নেই, চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। শুধু আমার ‘আমি’র কাছে নতজানু হয়ে স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যেতে চাই বার বার। নির্জন দুপুরগুলোতে এক ভবঘুরে শুকনো পাতার মতো স্মৃতি হাতরে বেড়াই চিরন্তন, সারাক্ষণ। স্মৃতি কী অবিনাশী বিষয়-আসয়? আমি তো পুরনো সব স্মৃতিই মুছে দিতে চাই পন্ডিত স্যারের ‘বø্যাকবোর্ডে’ লিখা বাংলা ব্যাকরণ পাঠের মতোন। অথচ ঘুরে-ফিরে ফেলে আসা সেই স্মৃতিদেরই আনাগোনা। বকেয়া টেলিফোন বিল যেমন বার বারই ফিরে আসে পরিশোধের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে। আমি যখন নৈশব্দে থাকি তখন অনেক কথা বলতে পারি। আমি আমার দ্বিতীয় সত্ত¡ার সাথে অনর্গল কথা বলে যাই। বিরামহীন কথোপকথনে কখনো আমি হেরে যাই আমারই দ্বিতীয় ‘আমি’র কাছে। নৈশব্দের যেমন একটা নিজস্ব ভাষা আছে আমারও সেরকম শব্দহীন কথোপকথনের একটি গল্প আছে আমার মনের মাঝে। সে গল্পটা জানি কখনো কাউকে বলা হবে না কোন কালেও। গল্পটার অন্তত চিত্র-রূপ দান করা সম্ভব হলে তাও করে দিতাম টিটলির জন্যে। নিশ্চয় টিটলি একদিন বড় হয়ে উঠবে, অনুধাবন করতে শিখবে আমার গল্পটাকে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করতে পারবে আমার না বলা গল্পের একটু একটু করে জমে থাকা কষ্টগুলো।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা