বিদ্যুৎ সরকার : চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ক্ষিণ হোয়ে আসলেও মনের দৃষ্টির প্রখরতা ও প্রকটতা ক্রমবর্ধমাণ শমসের মাতব্বরের। বয়স বারার সাথে সাথে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগবালাই শরীরে এসে বাসাবাঁধে। শমসের মাতব্বরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বহুমূত্র রোগের বহুমাত্রিক সংক্রমণ শমসের মাতব্বরকে জর্জরিত করে ফেলেছে অকালেই। অথচ এককালে শমসের মাতব্বরের নামে কয়েক পরগনার জনগণ তটস্থ থাকতো এমনিতেই। যৌবনে আশপাশের কয়েক গ্রাম জুড়ে তার মতো সবার গ্রহণযোগ্য একজন শালিশ পরিচালনা কারি ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই দুরূহ। যেমন ছিল বুকের পাটা তেমনি ছিল ঠাট-বাট, দাপট। অথচ মনটা ছিল দিঘির জলের মতোন স্বছ ও কলমি ডগার মত সরল। একজন সদা পরপোকারী আত্মনিবেদিত ব্যক্তি শমসের মাতব্বর। সাদাকে সাদা বলতেই ভালোবাসেন তেমনি, কালাকে কালা।
চোখের দৃষ্টি ক্ষিণ হওয়ায় আজকাল অনেক কিছুই রয়ে যায় দৃষ্টির সীমানার বাইরে। অথচ একদিন এ চোখের আলোয় দেখে নিয়েছে সাতচল্লিশের দেশ ভাগ, ভাষা আন্দোলন অত:পর মহান মুক্তিযুদ্ধের দামামা। ছানিপড়া চোখ দিয়ে দূরের অনেক কিছুই ঝাপসা দেখায়, একটি চশমার অনেক প্রয়োজন এ সময়ে। শমসের মাতব্বর আমার বড় নানা হন অর্থাৎ মা’র বড় চাচা। আমার সাথে ভাবের বিশেষ কারণ তার ছোট-খাটো ফুট – ফরমায়েশ খাটি বলে এবং রাতে ঘুমানোর আগে তার বর্ণিল জীবনের রঙিন গল্প শোনার কারণেই। বড় নানার চোখের ক্রমবর্ধমান দৃষ্টিহীনতা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়, সাহস করে একদিন বলেই ফেললাম- – ও নানা তোমার দেখতে এত কষ্ট হয়, পথে চলতে গেলে এখানে সেখানে হোঁচট খাও, এত কিছুর পরও তুমি একটা চশমা লাগাও না কেন? – তুই ই খালি আমার কষ্টটা বুঝলি আর কেউ আমার কথা তোর মতন করে বুঝতে চায় না। – কালকেই তুমি আমার বাজানরে কইবা তোমার জন্য একটা চশমা পাঠাইতে। – তুই সত্যি সত্যি কইতাছস, তাইলে কালই একটা চিঠি লিখন লাগে যে দাদু ভাই। – কোন চিন্তা কইরো না, সে ব্যবস্থা হইয়া যাইব। তুমি রাজি হলেই সব ঠিক হইব এমনেই। দরকার হইলে বড় ক্লাসের একজনরে দিয়া চিঠি লিখাইয়া নিমু কি কও? পর দিনই বড় নানার তরফ থেকে বাবার কাছে চিঠি লেখা হয় একটা চশমার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে। সাথে সাথেই বাবা চিঠির উত্তরে বিস্তারিত জানিয়ে দেয়। যেহেতু তার বাড়ি আসতে দেরি তাই, কাউকে পেলেই তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিবে নিশ্চিত। উত্তর পেয়ে আমি যেমন আনন্দিত বড় নানা তার চাইতেও বেশি খুশি মনে হলো। কেননা দেখার ব্যাপারটা তো তার। কয়েকদিন পর পাশের বাড়ির জলিল চাচা কাংখিত চশমা নিয়ে হাজির।
চশমা পেয়ে সাথে সাথে চোখে দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিকওদিক দেখছিল, তার কাছে মনে হচ্ছিলো বাবার কাছ থেকে এ যেন নতুন এক জোড়া চক্ষু দান। খুশিতে বাড়ির সবাইকে ডেকে এক উঠোন করে ফেলেছে। হাতের লাঠিটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠলো ‘আজ থেকে তোর চিরকালের ছুটি’। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো- – দাদুভাই তোমারে অনেক কষ্ট দিছি, তুমিও মুক্ত হইয়া গেলা। – আমিতো নানা মুক্ত হইতে চাই নাই। তোমার সাথে সাথেই থাকতে চাই, তোমার মত করে সুন্দর গল্পগুলো কে কইব আমারে? – তাইতো দাদু ভাই। না, তুমি আর আমি এক সাথেই থাকুম যেমন ছিলাম আগে। তার হাক ডাকে বাড়ির সব্বাই উঠোনে এসে জড়ো হলো এক মুহূর্তে। গর্বের সাথে জানিয়ে দিল আজ থেকে সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে একটি চশমার মাধ্যমেই। সে এখন সব কিছু ফক ফকা দেখতে পারছে যেন। আর এ মহৎ কাজটি করেছে আমিন চৌধুরী আমার বাবা। সে এও চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে চোখের ছানি কাটার ব্যবস্থাটাও করে ফেলবেন। বড় নানার দু-চোখে আনন্দের অশ্রæ ধারা বয়ে যাচ্ছিল তার অগচোরে। এসব কিছু দেখে আমারও মনের ভিতর একটা অনুভূতি জেগেছিল সুখ-দুঃখ মিশেল। প্রতিদিন বিকেলে বাড়ির কাছের স্কুল মাঠে যাই ফুটবল খেলা দেখতে। বড় নানাও এক সময় ভাল ফুটবল খেলতো তাই আকর্ষণটা তারেই বেশি। ওখানে যেতে আমাদের ছোট্ট একটি খাল পের হতে হয় বাঁশের তৈরি জীর্ণ শীর্ণ সাঁকো দিয়ে। আমার ভীষণ ভয় হয় যদি পা ফসকে জলে পরে যাই। বড় নানা আমাকে হাত ধরে পাড় করে দেয়।
সেদিন এমন করেই সাঁকো পাড় হচ্ছিলাম হঠাৎ করে বড় নানার চশমাটা কেমন করে জানি খালের জলে পরে গেল। খালের স্থির জলে অস্থির বৃত্ত তৈরি করে চশমাটি অতল জলে হারিয়ে গেল। বৃত্তগুলো বড় হতে হতে একসময় জলের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। বড় নানা মিলিয়ে যাওয়া বৃত্তগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বুকের মাঝে শোকের বৃত্তগুলো বুঝি চিরস্থায়ী হয়ে ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। শোকাচ্ছন্ন বড় নানা কিছুক্ষণ ধরে জলের গভীরে তার দুমরানো প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থেকে আমাকে পারে রেখে খালের জলে নেমে পাগলের মতো চশমাটা খুঁজে যাচ্ছিল অনবরত। শেষ অব্দি চশমা না পেয়ে পারে এসে আমার পাশে বসে পরলো মন খারাপ করে। বড় নানার দুঃখ কষ্টগুলো আমাকেও প্রভাবিত করতে শুরু করে দিল ক্রমশ। বড় নানার অনেকটা গা ঘেঁষে বসে বললাম যে কালই বাবাকে জানিয়ে দিবো আরো একটি চশমা পাঠিয়ে দিতে। বড় নানা সাথে সাথে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো – কি কইলি তুই, ভুলেও আর চশমার কথা তোর বাজানরে কইস না। আমার দোষে আমি আমার চশমা হারাইছি। শুনলে কি কইবো, মনে মনে ভাববো আমার কোন আক্কেল নাই। চাইর মাসও হইলো না চশমাডা হারাইয়া ফালাইছি। – তাইলে এখন তুমি চলবা কেমনে? -পাইয়া হারানোর দুঃখডা কেমন তার স্বাদ আমি বুঝতাছি। আর, তুইতো আছস আমার সাথে, চিন্তা কিসের? – আমারে কি তুমি সবসময় কাছে পাইবা? – আর কয়ডা মাসই তো, ঈদে তোর বাপজান আইলে ছানি কাটাইবো তখন আর চিন্তা কিসের? মাস কয়েক পর খালের জল প্রায় শুকিয়ে গেছে তবুও সাঁকো দিয়েই খাল পার হতে হয়। একদিন বড় নানা আমি খাল পার হচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি নানা সাঁকোর মাঝখানটায় এসে দাঁড়িয়ে গেছে, আমি কিছু বলার আগেই বড় নানা চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আঙুল নিচের দিক করে জিজ্ঞেস করলো, – কিছু কি দেখতাছস চোখ দিয়া, ভালা কইরা চোখ মেইল্লা দেখ, কাদার মইদ্দে এইডা কী দেখা যায়? আমি সাথে সাথে নিচের ঐ নিশানায় তাকিয়ে দেখি সেই হারিয়ে যাওয়ার চশমার একটি ক্ষুদ্র অংশ কাদার মাঝখান থেকে উঁকি দিয়ে আছে। অবাক হয়ে আমি একবার বড় নানার চোখের দিকে আরেকবার চশমার দৃশ্যমান অংশটুকুর দিকে তাকাচ্ছিলাম বার বার। অদ্ভূতরে কান্ড, এও সম্ভব তাও আবার এতোদিন পর?
বড় নানা ঝটপট আমাকে পাড়ে রেখে নেমে পরলো খালের জল-কাদায়। এক ঝটকায় কাদা থেকে তুলে আনলো তার হারানো মানিক। বিশ্বয়ের আনন্দধারা যেন ছড়িয়ে পরলো তার সর্বাঙ্গে, আমিও বাকরুদ্ধ হয়ে পরলাম ক্ষনিকের জন্য। – আমার মনডায় কেন্ জানি টানতাছিল একদিন না একদিন এইডা পাইয়া জামু। এই যে তরে দেখতাছি ঠিক আগের লাহান ক, তুই কই যাবি? কি খাবি? আমার চোখে এহন চশমা, সব দেখি সব ফক ফকা। পেয়ে হারানোর দুঃখের চাইতে, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বস্তুটি আবার ফিরে পাওয়ার আনন্দটা অনেক বেশি তা আর বলার অপেক্ষায় থাকে না।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা