বিদ্যুৎ সরকার
– রমজান ভাই এক কাপ চা আর এক প্যাকেট বিড়ি দেন, সকাল না হইতেই বিড়ি শেষ, মনডা কেমন লাগে কন দেখি ভাই?
– বিড়ি কম খাওনই ভালা। লগে একটা কুকিজ দেই খালি পেটে চা আর বিড়ি খাউন খারাপ। ইলিশের খবর কি, ধরা পরছে কেমন?
– মাত্রতো মৌসুম আইল, দিন দিন বারতে থাকবো। এইবার ইলিশের সাইজডা কিন্তু ভালা ভাই, দেখলে মনডা জুড়াইয়া যায়। পেটের দিকটা অনেক তেলতেলা, রইদের মইধ্যে কেমন চক চক করে, তমারে একটা খাওয়ামুনে।

রমজান মিয়া আর বলাই দাসের ভাব অনেক দিনের। যদিও রমজান- বলাইয়ের বয়সের ফারাক অনেক তবুও দুজনের ভাবের কমতি নেই। আপদ বিপদে রমজান বলাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। কানাই দাসের ছেলে বলাই। ছোটকাল থেকেই বাবার সাথে মাছ ধরার নৌকায় নদীতে নদীতে ঘুইরা বেড়ায়, মাছ ধরার আনন্দে সেও ভাগ বসায়। তবে জালে ইলিশ মাছ ধরা পড়লে আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায় তার। বিশেষ করে ইলিশের সৌন্দর্য তাকে অভিভূত করে দেয়। রোদের আলোয় ইলিশের পেট কেমন চিক চিক করতে থাকে। শিশুকালে কম বেশি সব মাছই খাইতো বলাই কিন্তু বয়স বারার সাথে সাথে ইলিশে এসে থিতু হয়েছে, বিশেষ করে পেটের অংশটুকু তার চাইই চাই। পেটের এক টুকরা ইলিশ দিয়ে এক থাল ভাত খাওয়া তার পক্ষেই সম্ভব। বাবা মারা যাবার পর মাছ ধরার দায়িত্ব পুরোপুরি তার উপর ন্যাস্ত হয় এবং সাথে সংসারের দায়িত্বও।

বলাই অনেক আগেই সাবালকত্ব অর্জন করেছে কিন্তু সংসারের দায়িত্বের কথা চিন্তা করে এক পা আগায় তো দু’পা পিছিয়ে যায় অজান্তেই। সম বয়সীদের সিংহ ভাগই এখন বিবাহিত। অনেকের আবার সন্তানের বাবা হওয়ার তকমাও নিয়ে নিয়েছে। রমজান ভাই প্রায়ই বলাইকে বিয়ে-সাদির কথা জিজ্ঞেস করে, তখন শুধু মুচকি হেসে উত্তর দেয় ‘হইবো হইবো রমজান ভাই, বিয়াতো একটাই করমু একটু দেইখা শুইনা লই না।’ রমজান মিয়াও তার সাথে একটু হাসে। রমজান ভাই সবারই ভাই। বলাইয়ের বাবাও তাকে ভাই বলেই সম্বোধন করতো, এখন বলাইও ‘রমজান ভাই’ বলে ডাকে। গুদারা ঘাটে রমজানের দোকান অন্যগুলোর চাইতে বড়। এখানটায় চা-বিস্কুট ছাড়াও অন্যান্য প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যায়। যার দরুন সবসময়ই এ দোকানটায় ভীড় লেগেই থাকে। বলাই মাছ ধরতে নদীতে যাবার আগে ও ফেরার পথে একটুক্ষণের জন্য হলেও রমজান ভাইয়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাবেই। রমজানের সাথে দু’দন্ড বসে গল্প করতে পারলে মন চাঙ্গা সারাদিনের জন্য নির্ঘাত। ইলিশের সিজনে তাকে প্রায়ই পদ্মার গভীরে যেতে হয় সে রাতে আর তার বাড়ি ফেরা হয় না। কিন্তু বউটার জন্য রাতভর বলাই ছটফট করতে থাকে। ঘরে রেখে আসা নতুন বৌয়ের মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে। কিন্তু সংসারের কথাও যে তাকে ভাবতে হয়, এ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তাকে চলতে হচ্ছে আজকাল। এক রাতে বউ ইলা সোহাগের বশে বলাইকে বলেছিল, ‘তুমি কেন মাঝে মাঝে রাইতে আমারে একা রাইখা নদীতে মাছ ধরতে যাও? আমিই তো তোমার বড় ইলিশ।’

বলাইয়ের হাতটা টেনে ইলা তার পেটে ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। বলাইও ইলার মসৃন তেলতেলে পেটে বার বার হাত বুলাতে থাকলো, নাভি, নাভির আরো কিছুটা নিচে। সে দিনই প্রথম সে উপলব্ধি করতে পারল সত্যিই তো ইলা আর পদ্মায় ধরা ইলিশের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পায় নাই। ইলাকে দু’হাতে আরো কাছে টেনে নিল বলাই, বুকের উপর ইলাকে তুলে নিয়ে সজোরে চেপে ধরলো নিজের দিকে। আসল সুখ বুঝি আজই খুঁজে পেল বলাই। হঠাত জালে টান পরলো, নিশ্চয়ই জালে মাছ পড়েছে। তরিঘরি করে উঠে জাল টানতে শুরু করে দিল বলাই। তার ভাবনায় চ্ছেদ পড়লো। জাল বেশ ভারি ভারি মনে হচ্ছিলো, মাছ কয়েকটা জালে ধরা পড়ে আছে নিশ্চিত। এ যাত্রায় বেশি বেশি মাছ ধরে নিয়ে যাবে। সামনের হাট থেকে ইলার জন্য একটি লাল শাড়ি আর কিছু ইমিটিশনের গয়না কিনে আনতে হবে, ও কিছুদিন আগেই বলেছিল। আগামী কয়েক দিন মাছ ধরতে যাবে না, ইলাকে সময় করে সময় দেয়া হয় না। মনে হয়তো রাগও জন্মেছে এসকল কারণে।

সকালের দিকেই ঘাটে ফেরা সম্ভব তবুও জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। নদীতে নাও ভাসানোর সময় বলাই রমজান ভাইকে বলে এসেছিল কেজি কয়েক চাল যেন ছেলেকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, অন্যান্য সবকিছুই ঘরে রাখা আছে।
নৌকা ঘাটের কাছা কাছি আসতেই চারিধারে হাজারো মানুষের ভির দেখতে পেল বলাই। শুধু কি তাই, কোস্ট গার্ডের একটি স্পিড বোটও ওখানটায় দেখতে পায়। ঘটনার কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না সে। আরো কাছে আসতেই বলাইত হতবাকব!

রমজান ভাইকে হাতকড়া লাগিয় টেনে হিচরে স্পিডবোট-এ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তার সমস্ত শরীর ও কাপড়ে রক্ত মাখা। ঘাটে নৌকা ভিড়তেই আম জনতা এখন তার দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে। বলাই তরিঘরি করে নৌকা থেকে নেমেই দ্রæত পায়ে বাড়ির দিকে ছুটলো। বাড়ির কাছে আসতেই আরেক দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হলো তাকে, উঠোন ভরা লোকে লোকারণ্য। মনে ভীষণ খটকা লাগলো, কী হতে পারে ওখানটায়? একটা ভয়, কিছুটা শংকা ভেতর ভেতর কাজ করছিল তখন। ভিড় ঠেলে ভিতরে গিয়ে যা দেখতে পেল তাতে সে বাকরুদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে।

জ্ঞান ফিরলে চোখ মেলে দেখে ইলার নিথর দেহটি পড়ে আছে, শুধু চোখ দুটো আধা মেলা। যেন অনন্তের দিকে তাকিয়ে আছে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে, এ পরিণতিই কি তার প্রাপ্য? গলার নিচটায় আঙ্গুলের কালচে কালচে দাগ। পাষণ্ড লোকটা ইলার হাতের দায়ের কোপ খাওয়ার পরেই গলা টিপে হত্যা করেছে তাকে। এর আগে ইলাকে পাশবিক নির্যাতনের প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিল ভীষণভাবে। প্রতিবেশীরা ইলার চিত্কার শুনে দৌড়ে এসে ঘটনার শেষ দৃশ্যটুকুই শুধু দেখতে পেয়েছিল। আর ঘটনার বাকিটা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিল রমজান নিজ মুখেই। বলাই যাকে এতোদিন ভাই বলে সম্বোধন করতো, সুখে-অসুখে তার পাশে যে এসে দাঁড়াতো, যার দোকানের এক কাপ চা না খেলে সারাদিন শরীর কেমন করতো। সে কি না আজ বলাইয়ের এতো প্রিয় লোকটার গলায় তার পাষণ্ড হাতের কদর্য দাগ রাখতে একটি বারও দ্বিধা করলো না?

ঝুরি থেকে ছিটকে পড়া ইলিশগুলো তখনও উঠোনের কোণায় পড়েছিল। সকালের রোদে আর ঝিলিক ছিল না সেই রূপালী ইলিশের শরীরে। ইলার প্রাণহীন দেহের মতোনি কেমন স্তব্ধ, মলিন, অনুজ্জ্বল শুধুই দুঃখ জাগানিয়া স্মৃতিময়।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা