বিদ্যুৎ সরকার : স্টেশনের নাম, ‘নাগরদোলা’। অদ্ভুত সুন্দর নাম, শুনলেই দেহ-মনে কেমন দোল খেয়ে যায়। একটা মিলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ জনপদ। স্বল্প কিছু দোকান-পাটা আর একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ছাড়া উল্লখযোগ্য তেমন কিছু নেই। এখানে এ স্টেশন না হলেও চলতো, মাইল তিনেকের মধ্যেই অপর একটি স্টেশন রয়েছে। তবুও স্টেশন স্থাপনের মূল কারণ এখানে অনেক আগে গড়ে উঠা রূপগঞ্জ সুগার মিল। এ সুগার মিলকে ঘিরেই রূপগঞ্জের যেটুকু উন্নয়ন। নাগরদোলা রেল স্টেশন তারই একটি। আছে মিল কর্তৃক পরিচালিত স্কুল, বাজার, মিল কর্মচারীদের জন্য আবাসন। সারা দিন পেসেঞ্জার ট্রেন ও গুডস ট্রেন মিলে মোট তেরটি ট্রেন চলাচল করে। এর মাত্র পাঁচটি নাগরদোলা স্টেশনে থেমে থাকে, দুটি গুডস ট্রেন ও তিনটি পেসেঞ্জার ট্রেন। পেসেঞ্জার ট্রেন সকাল, দুপুর এবং শেষটি আসে রাত দশটার দিকে। তখন যে ক’জন যাত্রী এখানে নামে তাদের বেশিরভাগ যাত্রী প্রতিদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্য নিয়েই। এরপর একটি গুডস ট্রেন। গুডস ট্রেন দু’টি এ স্টেশনে থামে মূলত পূর্ববর্তী স্টেশনগুলো থেকে রূপগঞ্জ সুগার মিলের জন্য আখ নিয়ে আসে এবং যাওয়ার সময় মিলের চিনি বোঝাই করে বড় শহরগুলোতে নিয়ে যায়। এ স্টেশনের স্টাফ মোট তিনজন- স্টেশন মাস্টার, লাইন্স মেন যে কিনা ট্রেন আসা-যাওয়ার ব্যাপারে সিগনাল দিয়ে থাকে আর একজন হলো পিওন কাম ক্লিনার। তিনজনই সরকারের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ভোগী। ওদের তিনজনের জন্যই রয়েছে রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টার। সুমন্ত চৌধুরী, স্টেশন মাস্টার, নবাগত। অন্য স্টেশন থেকে এসেছে মাস কয়েক হলো। অবিবাহিত, বিয়ে করি করি করে সময় গড়িয়েছে এন্তার। ভাল মানুষ বলতে যা বোঝায় সুমন্ত বুঝি তাই। শুধু যে স্টাফদের সাথেই ভাল ব্যবহার করে থাকে তা নয়, আশেপাশের পড়শীদের সাথেও তার সুব্যবহার সর্বজন বিদিত। লাইন্সম্যান রশিদ এখানকার সব চেয়ে পুরনো, স্টাফ, স্ত্রী – সন্তান নিয়ে সুখেই আছ। বিগত পনের বছর নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। সুখলাল ব্যতিক্রম একটি চরিত্র। কাজের সময় কাজ, কাজ শেষ হলে তাকে খুঁজে পাওয়া দায়। মূলত তার পূর্ব পুরুষ অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পশ্চিম প্রান্ত থেকে এ বাংলায় চলে আসে কাজের খোঁজে, সে থেকেই আজ অব্দি এখানেই রয়ে যায় ওরা। সুখলালের বাবার বাবা প্রথমে রেলের এ কাজে যোগ দেয় এবং বংশ পরম্পরায় সেও এ কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। পদটি পার্মানেন্ট হল বছর কয়েক আগে। সুখলালের সুখ প্রাণ জুড়ে মন জুড়ে। সে তার সুখকে বৈচিত্রময় করতে চলে যায় রূপগঞ্জ সুগার মিলের লোয়ার ডিভিশনের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে। ওখানে বেচেলার কোয়ার্টারের এক ঘরে তাদের মধ্য রাত অব্দি আড্ডা হয়, সাথে থাকে আখের রস থেকে ঘরে বানানো বাংলা মদ ও চালভাজা। দেশী মদের ঝাঁঝ যেমন, অল্পতেই আনাড়িদের নেশায় কোপকাত করে ফেলে। সুখলাল সেখানে সেই রাতগুলোতে অনাবিল সুখ খোঁজে পায়। এক অপ্রত্যাশিত দুঃখকে ভুলে যেতে বিকল্প সুখের সন্ধান তার। ওর বিয়ে হোয়ে ছিল কয়েক মাস আগে, অজানা এক অসুখে কঠিন জ্বরে দুদিনের মাথায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ওর অনেক আদরের নব বধূ কাঁকন। সে যেন ছিল সুখলালের হাতের কাঁকন, সব সময়ই বেজে চলতো বিরামহীন অবিরাম।
কাঁকনের মৃত্যুর ঠিক এক বছরের মাথায় বন্ধুদের পিড়াপিড়িতে সুখলালকে আবার বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো। রাজি না হয়ে উপায় ছিল না তার। ওদের যুক্তি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে সুখলালের পত্নি বিয়োগের শোককে কিছুটা হলেও লাঘব করতে সমর্থ হবে। বন্ধুদের এ কথা যে অনেকাংশেই সত্যি বলে প্রমাণিত হলো বিয়ে পরবর্তী সময়ে। সুখলাল আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই মদ খাওয়ার অভ্যাসটা একেবারে দূরে ঠেলে দিতে পারছিল না সে। নতুন বৌ রুথমিলা। সুখলালকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে কিন্তু শুধু মদ খাওয়ার ব্যাপারটা মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারছে না। এ বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই দু’জনের মধ্যে মন খারাপের ঘটনা ঘটে থাকে। এ ছাড়া ওরা ভাল থাকতে চেষ্টা করে প্রতি নিয়ত। বয়সের দিক দিয়ে রুথমিলা অনেকটা কম হলেও মন ও দেহের মেচ্যুরিটি কোন অংশে কম নয়। সব সময়ই স্বামীর আদর চায় সোহাগ চায় অবুঝের মতোই। ও চায় সুখলাল তাকে পাগলের মত আদর করুক আর রুথমিলা সে ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হোয়ে যাক, তছ নছ হোয়ে যাক মাধবী লতার মতোন। মাধবী লতা শুধুই সুবাস ছড়িয়ে যায় বেহিসেবীর মতন। পাশের কোয়ার্টারে সুমন্ত চৌধুরীর রেডিওতে গীতমালার মধ্যরাতের গান বাজে হেমন্তের কন্ঠে, ‘একটি মাধবী তুমি এখনতো ঠিকই জেগে আছো…!’ রুথমিলা গান ভালোবাসে, গানের সুর তার রক্ত কণিকায় শিহরণ জাগায়। তখন আরও ভাল করে ভালোবাসা পেতে মন চায়। উদাসী মন জানে না কখন নোঙ্গর করে এ বন্দরে।
সুমন্ত যতক্ষণ স্টেশনে থাকে সে সময়টা ওর ভাল কাটে। লোকের সাথে মিশে থাকে কাজে কথায়, কারণে অকারণে। একাকী কথা ছাড়া বসে থাকতে কারইবা ভাল লাগে। বাসায় গিয়েই বা কি করবে! রাতের অন্ধকার তাকে টেনে নিয়ে যায় একাকিত্বের দোরগোড়ায়। বিষন্নতার কুয়াশায় ঢেকে যেতে থাকে ক্রমশ চারিধার, তার অন্তর বাহির। তখনি সে ভীষণভাবে উপলব্ধি করে তার নিঃসঙ্গ জীবনের বেদনা, ক্ষুধা ও ভালোবাসাহীন পথ চলার কঠিনতম দিক। অন্ধকারের রাতগুলো, বিষন্নতার রাতগুলো কেবলই বেদনাময় ও দীর্ঘতম হতে থাকে লাগামহীনভাবে। চার দেয়ালে সীমিত সীমানায়, সিলিংয়ের বদ্ধ আকাশে আটকে থাকে অশুভ দৃষ্টি। কোন বিকেলে রাতের খাবারগুলো গরম করে ঢেকে রেখে গেছে রুথমিলা। ইচ্ছে হচ্ছে না উঠে গিয়ে খাবার খেতে। বেশ কদিন ধরেই শরীরটা ভাল যাচ্ছে না সুমন্তের। রাতের দিকে জ্বর আসে ধীর পায়ে। মাথার ব্যথাটাও বারতে থাকে সেই সাথে।
রুথমিলা আসার পর সে-ই সুমন্তের রান্নার কাজটি করে যাচ্ছে। সকালের জল খাবার সুমন্ত নিজ হাতেই সেরে নেয়। দুপুরের রান্নার কাজটা নিয়মিত রুথমিলাই করে থাকে? এর আগে কাঁকন এ কাজ করে দিত মৃত্যুর আগ অব্দি।
সকালে সুখলাল জংশনে যাচ্ছে জরুরি কাজ নিয়ে বেশি রাত হলে আজ নাও ফিরতে পারে। যাবার সময় বলে গেছে স্টেশন মাস্টার বাবুকে একটু দেখে রাখতে, আজ জ্বরের কারনে বেশিক্ষণ অফিস করতে পারেনি। সুমন্ত বাবুর জন্য সবার মায়া, তার একটু কিছু হলে সবাই হুমরি খেয়ে পড়ে তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে। রুথমিলাও এর ব্যতিক্রম না। মাস্টার বাবুর জ্বর হওয়াতে তারও ভাবনার শেষ নাই, সময় মত পথ্য খেল কি না, ঘুমাতে পারলো কি না, ওষুধ খাওয়া হয়েছে তো? শেষ প্যাসেঞ্জার ট্রেন অনেক আগেই স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে, কই সুখলাল তো ফিরে আসলো না আজ! রুথমিলা ঘুমাতে যাবার আগে ভাবলো বাবুকে একবার দেখে আসা উচিত, জ্বর কমেছে কি না?
পাশেই মাস্টার বাবুর বাসা, একটু হেঁটে গেলেই হয়। দরজা চাপানো ছিল একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ধির পায়ে ঢুকে কাছে গিয়ে কয়েকবার ডেকে কোন উত্তর না পেয়ে বুঝতে অসুবিধে হলো না বাবুর ভীষণ জ্বর যার জন্য কথা বলতে পারছে না। সন্তর্পণে রুথমিলা তার হাতটা বাবুর কপালে ছোঁয়াল এবং চমকে উঠলো জ্বরের পরিমাণ দেখে। সাথে সাথে বালতিতে জল এনে মাথায় ঢালতে শুরু করে দিল। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে মাস্টার বাবুর সম্বিত ফিরে পেল কিছুটা। তখনও জল ঢেলে যাচ্ছিল রুথমিলা। চোখ বুজেই জানতে চেষ্টা করছিল জল ঢালা হাতের পরিচয়। সুমন্ত হাতরিয়ে তার হাতটা ধরতে চেষ্টা করছিল। রুথমিলার হাতের চুরি তার হাতে লাগতেই অস্পষ্ট স্বরে ডেকে বললো,
– রুথমিলা?
– হ্যাঁ বাবুজি, আপনার তো অনেক জ্বর!
– আমি কিছুই বলতে পারবো নারে।
– কিছু খেয়েছেন বাবুজি?
– না রে, জ্বরের মুখে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না, মাথাটাও ভীষণ ব্যথা করছিল,
এখন অনেকটা ভাল কিন্তু মাথা ব্যথাটা এখনো রয়ে গেছে।
– একটু মাথা টিপে দেই ভাল লাগবে।
– তুই অনেক কষ্ট করছিস আমার জন্য।
– কি যে বলেন বাবুজি, আপনি আছেন বলেইতো আমরা বেঁচে আছি। এতোটুকু সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি সে তো আমার ভাগ্য বাবুজি।
– দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কখন থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছিস, এখানটায় বসেই দে না হয়।
– ঠিক আছে বাবু জি।
রুথমিলা সামনের দিকে এসে খাটে বসে বসে সুমন্ত’র কপাল টিপে দিচ্ছিল আর জানতে চাচ্ছিল কিছু খাবে কি না। সুমন্ত মাঝেমধ্যে দু’একটা কথা বলতে চেষ্টা করে।
এই প্রথম সুমন্ত অনুভব করলো মিষ্টি একটি গন্ধ তার নাকে-মুখে এবং ক্রমান্বয়ে তার সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ছে।
– তোর গায়ে দেয়া সুগন্ধির সুবাসে আমি অনেকটাই সুস্থ হোয়ে উঠেছি।
– আমিতো কোন সুগন্ধি মাখি না।
– তাইলে যে মিষ্টি একটা সুঘ্রান আসছে?
– সুখলালও এমন কথা কইতো আমি না কি গায়ে সুগন্ধি লাগাই! আসলে যে আমার শরীরের গন্ধ কেমনে বুঝাই তারে?
এখন বিশ্বাস করে।বুকে নাক লাগাইয়া শেষমেষ বুইঝা নিছে।
– তোর সব কথাই বিশ্বাস করিরে, কিন্তু এইটা মানতে কষ্ট হইতাছে আমার।
– তাইলে আপনেও দেখেন! বলতে বলতে রুথমিলা সুমন্ত’র নাকের কাছে তার বুক এনে ধরলো। না, তাতেও নাকি সুমন্ত সেই সুঘ্রাণ খুঁজে পাচ্ছে না। অভিমানে রুথমিলা একটি একটি করে সবগুলো বোতাম খুলে ফেললো। তার সমস্ত উদোম বুক সুমন্ত’র নাকে মুখে ঘষে যেতে লাগলো অনবরত।
– রুথমিলা, এখন একটু একটু পাচ্ছি, যেন চন্দনের সুবাস। আরো বেশি বেশি দে, আমি মন ভরে প্রাণ ভরে সে সুঘ্রানে ডুবে যেতে চাই।
– বাবু জি, তোমার যত ইচ্ছা নেও। সুখলাল কোনদিন এমন কইরা আমার গায়ের সুবাস নেয় না, কতবার কই শুনতে চায় না।
– রুথ, তুই আমার জীবন্ত চন্দন গাছ। তোর সমস্ত অঙ্গে অঙ্গে চন্দনের সুঘ্রান ছড়িয়ে আছে যে। ইচ্ছে জাগে আমরন এমন একটি জীবন্ত গাছকে জড়িয়ে থাকি।
সকালের প্রথম আলো জানালার কপাট ছুঁয়ে বিছানো চাদরে একে দেয় আলপনা। সদ্যজাত মানব-মানবীর দেহ দু’টি বুঝি অনন্তের ঘুমের ঘোরে জড়িয়ে আছে সেই অনাবিল এক সুখের সন্ধানে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা