বিদ্যুৎ সরকার : ও’র তো অনেক আগেই চলে আসার কথা-এমনটাই বলেছিল। আবার কোন বিপদ! এইতো কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা তাকে কিইনা ভুগিয়েছিল। যখন জেনেছি ইচ্ছে হয়েছিল ওর কাছে ছুটে যাই। ও’র তো কোন ফোন নাম্বার আমার জানা ছিল না, বাসার ঠিকানা তাও আমার অজানা। আমি কখনো জানতে চাইনি। মনে হতো দেখিনা শুধু ‘ফেবু’র মাধ্যমে কতটা অনুভব করা যায়, কাছে থাকা যায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওর সাথে দেখা হয়ে যায় ঠিকঠিক। কখনো আগে থেকেই জানা থাকে বা অজানা হঠাৎ দেখা। হঠাৎ দেখার বেলায় আনন্দটা দ্বিগুণ হয়। পুলক, শিহরণে অজান্তেই হাত কাঁপতে থাকে, ছবি তুলতে গেলে কেমন ‘ব্লার’ হয়ে যায় ছবিগুলো।
বিশেষ করে যখন ওর ছবি তুলতে যাই। অথচ, অন্যের ছবিগুলো কেমন গ্রহণযোগ্যতায় থেকে যায় ঠিকঠাক। একটি অনিশ্চয়তা, শংকা আমাকে ভাবনার গভীরে নিমজ্জিত করে রাখে। শেষ দৃশ্য অব্দি আমাকে একটু একটু করে দংশন করে যায়। সময় এগুচ্ছে, আমার অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। তার কোন বিপদ হয়নি তো—আমার ভাবনাটা যেন শতভাগ মিথ্যে হয়। এমনওতো হতে পারে হয়তো কোন ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে। এ শহরে জ্যাম হয়। অহরহ সাব ওয়েতে ট্রেন আটকে থাকে। কিন্তু কিছু বলা যাবে না, নিরবে সহ্য করে যেতে হবে। ‘প্যাশেন্স’-এর এ এক কঠিন পরীক্ষা। এ মুহূর্তে আমিও ধৈর্য্য পরীক্ষায় অবতির্ন। ওর অসুস্থতার পর আজই প্রথম দেখা হবে, কি বলবো ওকে? নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবো এখন কেমন? আমার তো ভীষণ ইচ্ছে হবে একটু ছুঁয়ে দিতে, সহানুভ‚তির পরশ বুলিয়ে দিতে। না যেতে পারার অক্ষমতাটুকু ঢেকে দিতে চাইবো। আমার কেন জানি মনে হয় ছুঁয়ে দিলে ওর সমস্ত দুঃখ বেদনাগুলো স্তিমিত হয়ে যাবে, আমিও ভুলে যাবো ওর কষ্টের দিনগুলোর কথা। কেমন করে প্রতিদিন ‘ফেবু’তে ওর দুঃখ কষ্টের বিবরণ লিখতো কাঁপা কাঁপা হাতে।

এখনও তো শরৎ। কী পরে আসবে ও? সালোয়ার-কামিজ, না শাড়ি। শাড়ি পরলে নিশ্চয়ই শরতের উপযোগী রং থাকবে শাড়ির জমিনে। আঁচল হাওয়ায় দোল খাবে কাশ ফুলের মতোন- খুব বেশি কল্পনাপ্রবন হয়ে পড়ি। কল্পনা বিলাসী মন নাকি কল্পনা বিবাগী মন আমার অন্তর জবর-দখল করে রাখে যখন-তখন। খোলা জানালার ফ্রেমে আটা মেঘলা আকাশ, শ্রীকান্তের প্রিয় গান- ‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ’। দু’জনে ঠিক করেছি অন্য একটি প্রিয় গানের অনুরোধ রাখতে- ‘আমি খোলা জানালা তুমি দখিনা বাতাস’কী দারুন প্রেমময় হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে পড়ার মতো গানের সুর ও বাণী। আমি তো বলেছিলাম রোদ থাকতে থাকতেই চলে আসতে। সান-লাইটে ছবি তুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, লাইট এন্ড শ্যাডের কারুকাজ আঁকা যায় ছবিতে। কই এলোনাতো! এখনতো বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, রোদ বলছে যাই যাই। কেন যে এতো ভাবি, ভেবে ভেবে কষ্টের দোড় গোড়ায় টেনে নিয়ে যাই নিজেকে। এ এক আত্মঘাতী ভাললাগা। বার বার ভাবি, ভাবতে ভাল লাগে। এ ভাবনার প্রান্তিকে সুখ না দুঃখ তা কখনো বিবেচনায় আনিনি।

ক’দিন ধরে একটা গান ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর, সময়-অসময় হঠাৎ এসে হাজির। অজান্তেই দু’এক লাইন বিড়বিড়িয়ে গেয়ে উঠি অনুপম রায়ের গান-‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’। এই যে আমি, আমিও আমার মত থাকতে চাই। আমার মত আমি ভাবতে চাই, আমার ইচ্ছেয় রং মাখতে চাই (মনের ইজেলের) ক্যানভাসে, পারছি কই? তাবৎ সুখ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক দুঃখের সাগরে। আমার ইচ্ছেরা পরাস্ত হয় এক অনিচ্ছার বেড়াজালে। এই যে প্রকৃতিতে ফল’র (ঋধষষ) পরশ কী দারুন রঙিন করে তুললো-রং’র খেলা চোখ মেললেই চারিধারে। প্রকৃতির সাথে মনের রং বদলায়, মনের সাথে সুখের ফল্গুধারা। অথচ কী অসময়ে সুখ বিলীন হয়ে যায় চির চেনা অসুখে। রঙিন পাতারা ঝরে পড়ে রং ছড়ানোর আগেই। ক্যামেরার সাটার চাপার আগেই হাওয়া। একদম দৃষ্টির অগোচরে। যেন, চিরতরে হারিয়ে যাওয়া দুঃখটা তখনই হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নেয় ভালোবেসে। সুখ দুঃখের এই ‘টাগ অব ওয়ারে’ শেষ অব্দি দুঃখেরই জয়জয়কার। তাই শুরুটা সুখের হলেও অন্তিমে দুঃখের পরিমাণটা বেশি হয়ে যায়। তবু কেন জানি আমার প্রায়ই মনে হয় আমি তুলনামূলকভাবে সুখেই আছি। অথবা, সুখ-দুঃখের আপেক্ষিকতায় নিজেকে গুলিয়ে ফেলি। অল্প সুখে বেশি তুষ্ট।

এইতো সে এসে গেছে! সমস্ত চিন্তা-ভাবনা কর্পুরের ন্যায় ফুৎকারে উবে গেল। সকালের এক পশলা বৃষ্টির মতো ওর কথাসমগ্র আমার দুঃখ-কষ্টগুলো কী নির্মল জলে ধুয়ে নিল চোখের পলকেই। অজান্তেই ওর হাত ছুঁয়ে দিলাম, মনে হলো আমি এক পর্বতশৃঙ্গ জয় করে নিলাম এক ‘শেরপা’ হয়ে। এ বিজয় উৎসব শুধু আমার নিমিত্তে, আমার অপরিসিম প্রচেষ্টায়। ওর যন্ত্রণাগুলোও কি আমার দুঃখ-কষ্টগুলোর মতো ধুয়ে নিবে, মুছে যাবে। লবিতে কতক্ষণ বসেছিলাম আমি? অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বের শেষে এসে গেছি হয়তো। একটু বাদেই প্রিয় গানের কলিগুলো উচ্চারিত হবে প্রিয় শিল্পীর কন্ঠে-আমার সারটা দিন মেঘলা আকাশ। বন্ধুর কল-কাকলিকে সঙ্গী করে আবার হারিয়ে গেল সে সুরের সাগরে। আমিতো তখনও বসেছিলাম সে ফিরে আসবে এ আশায়। মুহূর্তেই লবিটা ফাঁকা হয়ে গেল, খেলা শেষে ‘ইডেন উদ্যান’র মতোই। শুধু একাকী আমি, আমার সত্ত¡া, আমার দুঃখ-কষ্ট-ভাবনাগুলো সঙ্গী হয়ে থাকলো যেমনটি আগেও ছিল।