বিদ্যুৎ সরকার : কোন এক নীলকণ্ঠ পাখির নরোম পালকের ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে উঠে দেহ মন। ঝরে পড়া রঙিন ম্যাপেল লিফ কেমন উড়ে উড়ে হারিয়ে যায় অচেনা ঠিকানায়। শীতের আগমনে এভাবেই পাতারা ঝরে পড়ে বৃক্ষ থেকে সমস্ত ভালোবাসা উপেক্ষা করে। “আমার মন ভাল নেই” বলতে বলতে যেমন সুনীল চলে গেল না ফেরার দেশে। কী তার দুঃখ, কী তার ব্যাথা বেদনা এতো অভিমান? নীরাকেও কিছু না বলে যে চলে গেল সে। “রতত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি” তাওতো সুনীল বিলিন হয়ে যায়নি আকাশের একান্ত নীলে। তবে কেন তার এভাবে চলে যাওয়া মহাপ্রস্থানের পথে? আশির দশকে সুনীলদার সাথে কয়েকটি দিনের স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে মনের মাঝে। এরপরও বেশ কবার ঢাকা তথা বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। দূর থেকে দেখা হয়েছে, দু-একটি কুশল বাক্য বিনিময় হয়েছে কিন্তু, কোথাও বসে জমপেশ আড্ডা অর্থাৎ রাত ভোর করা আড্ডা দেবার সুযোগ হয়নি আমার। ফুরসৎ পেলেই চলে আসতেন তিনি। মাটির টানে, শেকড়ের সন্ধানে বার বার এভাবে চলে আসা। এইতো সেদিনও অর্থাৎ এ বছর জানুয়ারিতে ঢাকায় গিয়ে বেইলী রোড থেকে হাঁটা পথে মৌচাক যেতে সেই গলি পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দোতলা বাড়িটি দেখে মনে পড়ে গেল সুনীলদার কথা। সুনীলদা সমস্ত রাত আড্ডায়, কবিতায়, হাসি-তামাসায় মাতিয়ে রেখেছিলেন সেদিন। সে আড্ডায় অনেকেই ছিলেন তাদের মধ্যে বন্ধু মিলন, শিহাব, অনুজ প্রতীম ত্রিদিব দস্তিদার, রফিক আজাদ ভাই এদের কথা মনে পড়ছে। ফারুক আমাদের এক বন্ধু সে সময় এ বাসটিতে বসবাস করতো এবং সাথে আমিও থাকতাম তার একাকিত্ব ঘুচাতে। ফারুক এ ধরণের আয়োজনে বরাবরই ভীষণ উৎসাহী ছিল। সুনীলদাকে সে রাতে অন্য একটি অনুষ্ঠান থেকে অনেকটা জোর করেই জিপে করে তুলে এনেছিলে।
সে ঘটনা সুনীলদা তাঁর পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে উল্লেখও করেছিলেন। পরদিন মেঘনা ব্রিজের নিচ থেকে নৌকায় করে নৌ- ভ্রমণ ও আড্ডার বিরামহীন সফর। কয়েকটি নৌকা পাশাপাশি চলমান রেখে এ আড্ডা চলছিল দিন থেকে গভীর রাত অব্দি। এর কিছুদিন পর সুনীলদার সাথে দেখা হয়েছিল কোলকাতার এসপ্ল্যানেডে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেদিনের আড্ডার প্রসঙ্গ টেনে সবার কুশল জেনে নিলেন সুনীল দা। অসম্ভব আড্ডাবাজ প্রাণ খোলা মানুষ ছিলেন তিনি। আড্ডায় কখনো ক্লান্তি ছিল না তার। যেমন ছিল না তার সাহিত্য রচনায়।
হয়তো আমি অনেকবার ঢাকায় যাবো। বেইলী রোড হয়ে বারবার মৌচাকে যাবো, হেঁটে হেঁটে সেই গলিপথ ধরেই। তখনো সেই দোতলা বাড়িটি ঠিক সেভাবেই তার অবস্থানটি ধরে রাখবে শুধু সুনীলদা, সুনীল গাঙ্গুলীই থাকবে না। ভালোবাসার কবি প্রিয় ত্রিদিব দস্তিদারও থাকবে না বাস্তবে। তাদের সেসব ঘটনা স্মৃতি হয়ে মনের আর্কাইভে সযতনে রক্ষিত থাকবে। আর তাঁরা বেঁচে থাকবে তাদের লেখার মাধ্যমে চিরকাল। সুনীল নক্ষত্র হয়ে তাঁর উজ্জ্বোল্য ছড়াবে নীল অন্তহীন আকাশে অনন্তকাল এ ভাবনা আমাদের।
“কোন এক আহত নীলকণ্ঠ পাখির পালক কে যেন দু’হাতে ছড়িয়ে গেল। ” সে পাখির পালকের মতো মেঘনার ব্রিজের উপর থেকে একটি নীল খাম ঘুরে ঘুরে অনেক সময় ধরে পড়তে থাকবে নদীর গহীন সবুজ জলরাশিতে। সে চিঠিটিই হবে নীরার কাছে পাঠানো সুনীলের শেষ নীল চিঠি। “নীরা, ভাল থেকো।”
বিদ্যুৎ সুরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা