বিদ্যুৎ সরকার :
১.
লো ভলিউমে রবিশংকরের সেতারের সুর বেজে চলছিল আগে থেকেই। খানিক এয়ার ফ্রেশনার ছড়িয়ে দেয়ার দরুন একটা মিষ্টি গন্ধ ঘরময় ম ম করছিল। অনেকটা আমাদের দেশের দোলন চাপার ফুলের কাছাকাছি বলা যেতে পারে। সঞ্চালক কখনো ইংরেজি কখনো চলিত বাংলায় আগত অতিথিবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধান অতিথি চলে আসছেন। প্রধান অতিথি একজন প্রথিতযশা কবি গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি গ্যালারিতে চলে এলেন। সদাহাস্যজ্বল কবি সাজানো প্রদীপদানীর প্রদীপ প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে আলোক চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন ঘোষণার করেন। সাথে সাথে অপেক্ষায়মান অতিথিবৃন্দ গ্যালারির ভিতর ঢুকতে শুরু করে দিল। বাঙ্গালী- অবাঙ্গালী বিভিন্ন স¤প্রদায়ের নারী-পুরুষের প্রচুর সমাগম দেখে আলোক চিত্রি শুভম স্বভাবতই খুশি। বেশিরভাগ দর্শকই ছিল যুব সপ্রদায়ভুক্ত। গ্যালারির এক প্রান্তে একটি টেবিলে সাজানো আছে চা, কফি কিছু নাটস, চিপস, কুকিজ আর শ্যাম্পেন, রেড ওয়াইন ও ফ্লাওয়ার ভাসে ফুলের ইকাবেনা। অতিথিদের এসব দিয়েই আপ্যায়ন করা হয়েছে। যার যা খুশি নিজ হাতে তুলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেয়ালে টানানো ছবি দেখে যাচ্ছে আনমনে। শুভম প্রধান অতিথি ও অন্যান্যদের সাথে থেকে ছবি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। ছবি মননের কথা বলে, ছবি জীবনের কথা বলে।
দুপুরের দিকে দর্শকদের ভীড় অনেকটা কম থাকলেও বিকেল হওয়ার সাথে সাথে তা কিন্তু দর্শক পরিপূর্ণ গ্যালারিতে রূপান্তরিত হলো অপ্রত্যাশিতভাবে। ছুটির দিনের বিকেল বলে কথা। ‘ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফির উপর আপনার ভীষণ দুর্বলতা দেখতে পেলাম।’ ঠিক আমার অনেকটা কাছে পিছন দিক থেকেই কথাগুলো আসছিল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই কিছুটা ধন্দে পড়তে হয় আমাকে। যে নারী আমাকে এসব কথা বলে যাচ্ছিল সে কোনভাবেই বাঙ্গালী স¤প্রদায় না কিন্তু, কী করে এতো সুন্দর বাংলায় আমাকে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো!
ওর চোখে চোখ পড়তেই হাত বাড়িয়ে নিজ থেকে পরিচিত হয়ে নিল,
– আমি নাতাশা। না আমি বাংলাদেশী বা বাঙ্গালী কোনটাই না। তবে, আমি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের কালচার দুটোই দারুণভাবে ভালোবাসি।
– হাউ কাম য়্যু গট্ দ্যা মেসেজ অব দিস ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন?
– ভেরি অফেন আই ইউজ টু সি দ্যা আপ কামিং ইভেন্টস পেজ।
– আই সি। সো, হাউ ডু য়্যু লাইক দিস শো?
– ভেরি নাইস, স্পেশ্যালি ইউর এরেঞ্জমেন্ট ইস আর্টিস্টিক, কুল এন্ড এডোরেবল্।
– ইটস্ টু মাচ।
– স্পিকিং এবসোলিউটলি ট্রু।
– লেট আস হ্যাব সামথিং। হুইচ্ ওয়ান য়্যু প্রেফার, শ্যাম্পেন অর রেড ওয়াইন?
– নো থ্যাংক্স সামথিং হট।
– কফি টি অর মি?
– ‘হ্যারল্ড রবিন্স’।
– করেক্ট, ইটস্ এ গুড বুক।
– হাউ ইজ ফটোগ্রাফি?
– এক্সেলেন্ট, স্প্যাশালি ইউর ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি। ওকে, টি ইজ অলমোস্ট ফিনিশড আই মাস্ট লিভ নাও।
– সো আরলি?
– সি ইউ টুমরো।
২.
প্রথম দিন বেশ জমজমাট উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হোয়ে গেল। স্বভাবতই শুভম যার পর নাই খুশি। প্রদর্শনীর আজ দ্বিতীয় দিন, চলবে মোট তিনদিন। প্রদর্শনীর সচিত্র প্রতিবেদন স্থানীয় পত্র-পত্রিগুলোর প্রথম পাতায় স্থান করে নিয়েছে। প্রথম দিনের ছবি বিক্রির পরিমাণ আশাব্যঞ্জক ছিল। শুধু যে বাঙ্গালী ক্রেতারাই তার ছবির ভক্ত, প্রচুর অবাঙ্গালী ক্রেতাও শুভমের ছবির গ্রাহক ছিল প্রথম দিনে। এটা শুভমের তৃতীয় একক আলোক চিত্র প্রদর্শনী। সময় গড়ানোর সাথে সাথে প্রদর্শনীর দর্শক সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছিল। এরই মধ্যে ভীড় ঠেলে নাতাশা পিছন থেকে আলতো করে শুভমের পিঠ ছুঁয়ে দিতেই শুভম পিছনে তাকিয়ে নাতাশাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
– হাই শুভম, হাউ আর য়্যু?
– থ্যানক্স, আই এম ফাইন, য়্যু?
– আই এম সো সো।
– টু ডে য়্যু আর লুকিং সো প্রিটি।
– অনলি প্রিটি, নো হট্?
– ও য়া ও, টু হট্ টু হ্যান্ডেল।
– রিয়েলি?
– আজও তুমি এসেছো, সত্যিই আমি খুশি।
– কালতো তুমি ভীষণ ব্যস্ত ছিলে, তোমার সাথে তো ভাল করে পরিচিতও হতে পারিনি। উপরন্তু, ছবিগুলো ভাল করে দেখাও হয়নি আমার তাই চলে এলাম।
– বেশ করেছো।
– আজ কি দিয়ে শুরু করা যায়?
– কেন, তোমার ছবি তোলা প্রসঙ্গ?
– আরে, সে কথা জিজ্ঞেস করিনি ড্রিংকস।
– তোমার যা কিছু ইচ্ছে?
– আমার তো ইচ্ছে তুমি আজ একটু রেড ওয়াইন পান কর। তা’হলে আমিও একজন সাথি পেয়ে যাব।
– ও কে, তাতে তুমি খুশি হলে অবশ্যই রেড ওয়াইন পান করবো এবং আমিও ডাবল্ খুশি হতে চাই।
– দারুন বলেছো কিন্তু।
– বাই দ্যা ওয়ে, ডে আফটার টুমরো ডাউন টাউনের একটি গ্যালারিতে তিনজন ফটোগ্রাফারের ছবি প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে তুমি যাচ্ছ তো? নিশ্চয়ই তুমি ‘না’ বলবে না?
– অবশ্যই যাবো। কাল আমার প্রদর্শনী শেষ হওয়ার সাথে সাথে সব কিছু গুছিয়ে ফেলতে হবে তাহ’লে।
– অসুবিধা নেই আমি আছিতো, তোমাকে সহয়তা করবো কথা দিলাম।
– সো নাইস অব য়্যু ডিয়ার।
৩.
ইয়ং এন্ড বেøার স্টেশনে নেমে পায়ে হাঁটা পথে দশ মিনিটেই আমরা পৌঁছে গেলাম গ্যালারি – ১৬। শুন শান পরিবেশ, ট্রাম্পেটে গানের সুর খুবই লো ভলিউমে বেজে যাচ্ছে সারাক্ষণ। এ গ্যালারিটিতে সব সময়ই কোন না কোন শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনী চলতে থাকে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয় শিল্পীদের চিত্র কলা প্রদর্শনের একটি সুপরিচিত গ্যালারি এ স্থানটি। নাতাশার খুব পছন্দের গ্যালারি – ১৬।
এ গ্যালারির একটি বিশেষত্ব হলো যে দেশের শিল্পীর প্রদর্শনী চলে সে দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংগীত বা মিউজিক চলতে থাকে। এতে করে প্রদর্শনী একটি বিশেষ মাত্রা পায়। তিন শিল্পীর আলোক চিত্রগুলো তিন ভাগে ভাগ করে বিন্যাসিত করা হোয়েছে। তিন জনেরই সাদা-কালো ও রঙ্গীন ছবি প্রদর্শীত হচ্ছে এ গ্যালারিতে।শোভাগ্য বলতে হবে একই সাথে তিন আলোক চিত্রীর প্রদর্শনী একই স্থানে পাওয়া।
আমরা দু’জনেই শিল্পকে মনে-প্রাণে ভালবাসি, ধারণ করি এবং দু’জনেরই বিষয় বস্তু ন্যাচার। যে কোন নৈসর্গিক দৃশ্যতে চোখ আটকে যায়,মন ছুঁয়ে যায়। পার্থক্য শুধু মাধ্যমে, নাতাশার মাধ্যম রং তুলি আর ফটোগ্রাফি আমার মাধ্যম। ইচ্ছে করলে একই সাথে বাইরে গিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যসমূহ ক্যামেরা বন্দী ও ক্যানভাসে ধারণ করা দু’জনের জন্য বেশ মজার ব্যাপার হবে বৈকি! ছবি দেখতে দেখতে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। নাতাশা দেরি না করে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। নাতাশার এসব ছোট – খাটো বিষয়গুলোর জন্য কারোর বন্ধুত্ব পেতে মোটেও অসুবিধে হয় না তার। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, চঞ্চলতা ও পজিটিভিটি তাকে আরো আকৃষ্ট করে তুলেছে। প্রথম দিন থেকেই তাকে আপন করে নিতে আমি মোটেও দ্বিধাগ্রস্ত হইনি। সেদিন থেকেই সময় পেলে আমরা কোথাও না কোথাও দু’জনে দেখা করি। চিত্র কলা আলোক চিত্র প্রদর্শনী, পাব বা মিউজিক ফেস্টে। দূরে গিয়ে প্রায়ই ছবি তোলা ও ছবি আঁকার সময়গুলো আমাদের মাঝে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রাণের সঞ্চার এনে দেয়। এ সময়গুলোতে পরস্পরকে চেনার ও জানার অনেক সুযোগ সৃষ্টি করে।
৪.
নাতাশাকে কখন থেকে অন্যভাবে ভাবতে শুরু করি তা নিজেও জানি না। শুধু অনুভবের অনুভ‚তিতে একটা অন্যরকম শিহরন মাঝে মধ্যে আমাকে আলোরিত করতো। আলোকিত করতো আমার চোখের তারাদের। তখন তারায় তারায় রটিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো তুমি আমার। সাপ্তাহান্তে নাতাশাকে অদেখা মন খারাপের চিঠি হয়ে আমার ডাক বাক্সে পৌঁছে যায় সযতনে। নাতাশা যেন আমার এক গোপন প্রেরনা, নতুন রঙ্গীন আকাশ। রংধনুর সব রং এঁকে দেয় আমার মনাকাশে। গতকাল ও’র জন্মদিন ছিল। সারা বেলা আমরা দু’জন এক সাথে ছিলাম। বিভিন্ন আর্টগ্যালারিতে গিয়ে প্রদর্শনী দেখেছি। সন্ধ্যা হতে হতেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমার পূর্ব নির্ধারিত ক্যাফেতে। নাতাশার জন্য ছিল এটা বড় সারপ্রাইজ। নাতাশা ভেবে ছিল হয়তো আমি তার জন্মদিনের তারিখটি বেমালুম ভুলে গিয়েছি। সার্ভার এসে কেক ও ফুল দিয়ে গেলো সময় মত। আমার পকেট থেকে ছোট্ট একটি গিফট বের করে যখন নাতাশার হাতে তুলে দিলাম নাতাশা তো দেখে অবাক, তার প্রিয় জিনিসটি। তার অনেক কাংখিত উপহার এখন তার হাতে শোভিত। ফসিলের একটি রিস্টওয়াচ। কথা প্রদঙ্গে একদিন এই ঘড়ির বিষয়ে বলছিল। আমিও মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম কোন একদিন সুযোগ পেলে তাকে এটি উপহার দেবো। তার জন্ম দিনে এ উপহারটি তাকে দিতে পেরে আমি ভীষণ আনন্দিত।
৫.
নাতাশার পেইন্টিং ও আমার ফটোগ্রাফি যৌথভাবে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে আগামী তিন তারিখ, প্রদর্শনী চলবে সাত তারিখ অব্দি।প্রদর্শনীটি দু’জনের কাছেই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আমার আর নাতাশার সম্পর্ক ও ভাল লাগার প্রতিক, বন্ধুত্বের বন্ধন, শিল্পের যুগলবন্দী। আমরা দু’জনেই ভীষণ ভীষণভাবে এক্সাইটেড, শিহরণের উত্তাপে তাপিত। মাইকেল, নাতাসার খুব কাছের এক বন্ধু যে কিনা এশিয়ান পেইন্টার হিসেবে স¤প্রতি লন্ডনের এক চারুকলা প্রদর্শনীতে যোগদান করে ভুয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং সেবারের ‘পেইন্টার অব দ্যা ইয়ার’ খেতাবে ভুশীত হয়। নাতাশা লন্ডন থাকা কালীল সময়ে মাইকেলের সাথে পরিচয় হয় এবং তা এখনো দৃঢ়ভাবে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।নাতাশার মুখে মাইকেলের অনেক গল্প শুনেছি। শুনে শুনে এক সময় অনেক কিছুই তার প্রসঙ্গে আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। কেন জানি আজকাল ওর বিষয়ে কিছু বললে আমি ততটা মনযোগ দিতে পারি না। হয়তো বিষয়টি নাতাশা অনুধাবন করে থাকবে। তবুও সে তার প্রসঙ্গে বলতে থামেনি। সে ই কিনা টরন্টো আসছে আমাদের এ প্রদর্শনী উপলক্ষে। অনেকটা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি মনে মনে।
৬.
একটু পরেই প্রদর্শনী উদ্বোধন হবে। এরই মধ্যে নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের অনেকেই চলে এসেছেন। হঠাৎই নাতাশার কণ্ঠে ঘোষিত হলো, আমাদের এ প্রদর্শনীর দুটো দিক উল্লেখ না করলেই নয়। প্রথমটি হচ্ছে দুটি মাধ্যমে একই প্রদর্শনীতে আলোকচিত্র ও চিত্র কলার যৌথ আবির্ভাব এবং অপরটি হলো আমার পাশে যে দুজন দাঁড়িয়ে তাদের দুজনেই আমার খুব প্রিয়। মাইকেল একজন চিত্র শিল্পী, লন্ডনবাসী আর শুভম ফটোগ্রাফার এ শহরেই তার সাথে আমার পরিচয়। মাইকেল আমার চিরদিনের ভাল বন্ধু ও শুভম আমার আজীবনের জীবন সাথী। শুভম হঠাৎ করে যেন অনেকটাই বিচলিত হয়ে পড়লো। নাতাশার মুখে সে এসব কী শুনছে আজ! পরক্ষনেই নাতাশা দু’হাতে দু’জনকে কাছে টেনে নিলেন সহাস্যে।
এক দুর্ঘটনায় মাইকেল তার ডান হাতের কর্মক্ষমতা হারিয়েছে স¤প্রতি অথচ এ হাতেই নির্মিত হয়েছে অনেক অনেক মানসম্মত বিখ্যাত শিল্পকর্ম। তার হাতের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন হবে। মাইকেলের একার পক্ষে সে চিকিৎসার খরচাদি চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমার ইচ্ছে এ প্রদর্শনীর শিল্প কর্ম বিক্রির অর্থের একটা অংশ মাইকেলের হাতের সুচিকিৎসার জন্য তাকে প্রদান করলে কেমন হয়? শুভম নাতাশার এ তরিত সিদ্ধান্তে সম্মত জানিয়ে তার মহানুভবতার প্রশংসা করতে ভুললো না। মাইকেল এতে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। এ যেন ত্রিমুখী ভালোবাসা ও ভালো লাগার অপ্রকাশিত এক শিল্পকর্ম।