বিদ্যুৎ সরকার : ২.
রানওয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে প্লেন চলতে শুরু করে দিল। একটু পড়েই মাটির স্পর্শ ভুলে গিয়ে উড়তে থাকবে আকাশের ঠিকানায়। সাইড ব্যাগে রাখা বইগুলোর থেকে হ্যারল্ড রবিন্স’র ‘নেভার লাভ এ স্ট্রেঞ্জার’ বইটি বের করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে এর গন্ধ নিচ্ছিলাম। নতুন বই, নতুন টাকার গন্ধ নেয়ার অভ্যাসটা আমার ছোট কাল থেকেই।
আমার কান্ড দেখে শাওন মিটি মিটি হাসছিল। তাই না বলে আর পারলাম না, হাসছেন কেন শুধু শুধু?
– নতুন বইয়ের প্রতি আপনার প্রেম দেখে।

– এখনো পড়িনি, সদ্য কেনা। দূর পাল্লার জার্নিতে বই আমার নিত্য সঙ্গী। আর নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে আমার দারুন লাগে।
– তাই তো দেখলাম এতক্ষণ ধরে। এ ধরনের আর কি কি দেখতে পাবো?
– আপনার বই পড়তে ভাল লাগে না বুঝি?
– জার্নিতে আমার ফার্স্ট প্রেফার মুভি দেখা। অতঃপর বই পড়া এবং ঘুমের প্রাক্কালে গান শোনা চাইই চাই।
– বই পড়তে শুরু করলে এর শেষ অবধি আমাকে যেতেই হবে। বিশেষ করে হ্যারল্ড, নিমাই ভট্টাচার্য ও হুমায়ুন আহমদে-এর লেখার মধ্যে একটি মিল খুঁজে পাই। তাদের লেখায় যাদু আছে পাঠককে টেনে নিয়ে যাবার, শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিতে মন চাইবে না।
দেশে ফ্যামিলির সাথে মিট করতে যাচ্ছেন বুঝি?

– পুরোপুরি ঠিক তা ও না। আপাতত আমার জবটা দু’খানেই। আমাদের মেইন কাজটা হলো গবেষণা ধর্মী। কোন প্রজেক্ট শুরুর প্রাক্কালে এর ফিজিবিলিটি স্টাডি করা, এর সোসিও-ইকনোমিক বিষয়গুলো পরখ করা। সে জন্য আমাকে ঢাকা-টরন্টো ছুটতে হয় প্রায়শই। ও আপনিতো এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন, কোন সাবজেক্ট আপনার?
– ইকনোমিক্স, থার্ড সেমিস্টার সবে শেষ করে আসলাম।
– ইচ্ছে করলে আমাদের ফার্মে জয়েন করতে পারেন।
– অফারটা লোভনীয়, ঢাকা-টরন্টো আসা যাওয়ার বিরাট সুযোগ।
– বলে রাখলাম যখনি ভাববেন জব করার সঠিক সময় হোয়েছে যোগাযোগ করবেন।
ডিনার সার্ভ করা হয়েছিল অনেক আগেই, এরই মধ্যে অনেকের ডিনার পর্ব শেষ। একটু পড়েই ভিতরের মেইন লাইট নিভিয়ে দেয়া হলো। দোলন চাপা মাথার উপর স্পট লাইট জ্বালিয়ে বইয়ের শেষটুকু সমাপ্ত করতে ব্যস্ত। শাওন গুড নাইট বলে ঘুমের আয়োজন করতে শুরু করে দিল।
এক সময় প্লেন ঢাকার আকাশ সীমায় পৌঁছে গেল। সবাই বাংক থেকে তাদের লাগেজ নামাতে থাকলো। শাওন ও দোলন তখনও সিটে বসে সাইড ব্যাগ গুছাচ্ছিল।

শাওন নিরবতা ভেংগে জিজ্ঞেস করলো।
– এতোটা সময় কি দেশেই ঘুরে বেড়াবেন নাকি দূরে কোথাও যাবার প্রোগ্রাম আছে?
– ইন্ডিয়া বা নেপাল যাবার ইচ্ছে আছে শীঘ্রই।
– আমিও কি আপনাদের ভ্রমণসঙ্গী হতে পারি?
– অবশ্যই, কেন না, ইটস আওয়ার প্লেজার।
কিন্তু যোগাযোগ হবে কেমন করে?
– তাইতো, ষোল ঘন্টা আমরা পাশাপাশি বসে কাটালাম অথচ কেউ কারোর ঠিকানা বা ফোন নাম্বার নেয়ার বিষয়টি একবারও ভাবিনি। আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিলাম, প্রোগ্রাম ফাইনাল করে আমাকে একবার জানালেই হবে। বাই দ্যা বাই বিমানে আমার পরিচিত লোক রয়েছে কিছুটা ফেবার অবশ্যই নেয়া যাবে। এর দায়িত্বটা আমাকে দিলে অখুশি হবো না।
– চলুন সবাই নামতে শুরু করে দিয়েছে।
– কদ্দূর যাবেন, রাইডের প্রয়োজন হবে?
– থ্যাংক ইউ, কাছেইতো, উত্তরা। একটা উবার নিয়েই চলে যাব। দেখা হবে এরই মধ্যে আশা করি। টেক কেয়ার।
– ইউ টু।
এরই মধ্যে নেপাল যাবার দিনক্ষণ প্রায় ফাইনাল করে ফেলা হয়েছে, হোটেলের রুম বুকিং তাও শেষ, এয়ার টিকিটের দায়িত্বটা শাওনকে দেয়াই ভাল যদি কিছু ফেভার পাওয়া যায় মন্দ কি?

বিপত্তিটা বাজলো তখনি, শাওনের ভিজিটিং কার্ডটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দোলন তার সাইড ব্যাগ তন্ন তন্ন করে দেখলো, ছোট পার্টস এমন কি প্যান্ট জ্যাকেট সার্টের পকেটগুলো – কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। টিকিট না হয় যে কেউ করে ফেলতে পারবে কিন্তু শাওনের যাওয়ার কী হবে? কাঠমুন্ডুতে নাগরকোটে সূর্যোদয় দেখা, পকোরায় ট্র্যাকিং, বেজ ক্যাম্পে রাতভর আড্ডা, ক্যাম্প ফায়ারের উষ্ণতা, প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যসমূহের ছবি তোলা সবকিছু কি পানশে হয়ে যাবে শাওনের অনুপস্থিতিতে? কার্ড না পেলে ঢাকা বা টরন্টো কোথাও ওর সাথে দেখা হবে না আর, জবেরওতো অফার ছিল ওর তরফ থেকে!

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা