বিদ্যুৎ সরকার : ১.
উইন্টার ভ্যাকেশন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে একটা শিহরণ অজান্তেই দোলন চাপার শরীর জুড়ে প্রবাহিত হতে থাকে। সময় যেন আর কাটতে চায় না কিছুতেই। আরো দু’সপ্তাহ বাকি ইউনিভার্সিটি ছুটি হতে তবেই না দেশে ফেরার পালা। থার্ড সেমিস্টারের শেষ এক্সামের পর পরই একটানা অনেক দিন ছুটি, পড়াশোনার কোন বালাই নেই প্রাণখুলে বেড়ানো আর মন খুলে বিরতিবিহীন গল্পের আসর বন্ধুদের সাথে। এ উচ্ছল প্রাঞ্জল সময়গুলো ইউনিভার্সিটিতে মেলা ভার, সবাই এসাইনমেন্ট জমা, টিউটোরিয়াল এক্সাম, ক্লাস এটেন্ড এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তখন প্রাণখুলে আড্ডা দেয়া তো দূরে থাক দাঁড়িয়ে একটু আধটু কুশলাদি যে বিনিময় করবে সেই সময়টুকুও বের করা কঠিন। আদা জল খেয়ে যেন সবাই পড়ায় মত্ত। সর্বক্ষণ পড়ার টেবিলে বা লাইব্রেরি ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই ছুটির দিনগুলো দোলন চাপা যতটা সম্ভব কড়ায় গন্ডায় ভোগ করে নেয়। ছুটি এলেই যেন তার ফুর ফুরে মেজাজ আর কুর কুরে ঘটি গরমের আমেজ।
দোলন চাপার ইচ্ছে এবারের ছুটিতে এতোটা সময় শুধু শুধু দেশে না কাটিয়ে একটু আশেপাশে নেপাল কিংবা ইন্ডিয়াতে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না!
যেমনি ভাবা তেমনি স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়া তার স্বভাব। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই পরীক্ষার ঝামেলা শেষ এর পরেই ছুট্টী! রোদেলাকে আগেভাগেই বলে রেখেছিল টরন্টো – ঢাকার ফিরতি টিকেট করে রাখতে বাংলাদেশ বিমান এয়ার লাইন্স থেকে। প্রথম বারের মত নিজ দেশের এয়ারক্রাফট চড়ে নিজ দেশে যাওয়া – আসলেই অন্য রকমের সুখানুভূতি।
বেকপ্যাকে তার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে অন্যান্য কাপড় চোপর, বন্ধুদের জন্য কিছু গিফট, বাসার সবার জন্য চকোলেট ক্যান্ডি পারফিউম নিয়ে নিল বড় একটি লাগেজে। কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে টরন্টোর ফ্লাইট ধরতে। ওখানে দু’দিন কাটিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিমানে সোজা এক ধাক্কায় ঢাকা এয়ারপোর্ট, ভাবাই যায় না!
লাগেজ তুলে দিয়ে বোর্ডিং পাশ নিয়ে কাস্টম, ইমিগ্রেশনের তাবৎ ফর্মালিটিস সেরে সোজা বিমানে। মনে হলো দেশের মাটির সুঘ্রাণ বুঝি আমার দেহ পল্লবে ছড়িয়ে পড়েছে। মনের অজান্তেই উচ্চারিত হলো, ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার বুকে ঠেকাই মাথা….। সিটবেল্ট বাধতে বাধতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলে দিলাম, ‘বাই বাই কানাডা……আবার আসিবো ফিরে মাস তিনেক পরে।’ জানালার পাশের সিট বরাবরই আমার পছন্দ, রোদেলাকে বার কয়েক মনে করিয়ে দেয়া সত্বেও যেই লাউ সেই কদু- মাঝখানের সিট আমার জন্য বরাদ্দ হলো।
কী আর করা আমার আকাশ দেখা হলো ফাঁকি।
– এক্সকিউজ মি, আপনি কি জানালার পাশটায় বসতে ইচ্ছুক? আমি আপনার ওখানটায় না হয় বসবো।
– সো নাইস অব ইউ। ওখানটায় আমি ভীষণ এঞ্জয় করি, বিশেষ করে আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়া।
– আমি তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম জানালা দিয়ে তাকিয়ে বার বার কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
– এতোই যখন বুঝতে পারলেন তখন বলেননি কেন?
– আপনার আগ্রহের গভীরতা পরখ করছিলাম।
– আসলে আকাশের না না রঙের খেলা মন ভরিয়ে দেয়। এখানে আকাশ অনেক নীল কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রঙ বদল হতে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার লগ্নে এর রঙ যেমন থাকে ক্রমান্বয়ে তা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে আসে। হালকা হলুদ থেকে গাঢ় হলুদ অতঃপর লাল এবং গাঢ় লাল। এক সময় সূর্য ডুবে যায়। আকাশ তার সব কটা রঙ হারিয়ে ফেলে অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এমন রঙ বদলের খেলা কার না ভাল লাগে বলুন?
– আকাশ তো আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি কিন্তু অমন করে দেখতে চেষ্টা করিনি কখনো।
– ব্যাপারটা ঠিক মোটেও তা নয়। প্রত্যেকেই আমরা চোখ দিয়ে দেখছি, এ চোখের ভেতর অপর দুটো চোখ রয়েছে যার নাম উপলব্ধি। নান্দনিক দিকটা খুঁজে বের করাই তার কাজ। বাই দ্যা ওয়ে আপনার নাম এখনো জানা হলো না। আমি দোলন চাপা, বলেই হাত বাড়িয়ে দিলাম।
– হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম, আমি শাওন মানে শ্রাবণ।
– বেশতো মাসের নামে নাম আপনার তাও আবার ‘রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি….।’
– আপনারটা যেমন ফুলের নামে, ‘ফুলে গন্ধ নেই সে তো ভাবতেও পারি না..!’
(দু’জনেই এক সাথে হেসে উঠলো)। (চলবে)
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা