বিদ্যুৎ সরকার
ওর নাম দিঘি। দিঘির মতোই ডাগর চোখ দুটো। জল থৈ থৈ,স্বচ্ছ জল চোখ জুড়ে। কাজল রেখার সীমায় আবদ্ধ দিঘির চোখ দুটো। তাই চোখ দুটোর সৌন্দর্যে যে কেউ প্রশংসা করবে এটাই প্রত্যাশা। গায়ের রং শ্যাওলা, পাতলা গড়ন। কাঁধে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগ ও চপ্পল পায়ে স্বাভাবিকের চাইতে একটু দ্রুত হেঁটে চলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে দিঘি। সপ্তাহের পাঁচ দিনই নয়টা পনেরর ট্রেন চেপে তাকে পৌঁছতে হয় গন্তব্য। কাজ শেষে পাঁচটা ত্রিশের ট্রেন ধরে কল্যাণী থেকে চাকদা ফেরা। প্রতিদিনের এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না খুব একটা। হঠাত কোন জরুরি কাজ কিংবা শরীর ভীষণ খারাপ লাগলেই নিয়মের হের-ফের ঘটে কখনো-সখনো। তাথৈ তার মেয়ে, বয়স আট হবে হয়তো। এর কোন ভাই-বোন নেই। তাই বাবা-মা ই তার আসল খেলার সাথী। অন্য দু’চার জন যারা আছে পাশের বাড়ির রিনি ঝিনি আর স্কুলের উচ্ছ্বাস ও উজান। এ তিন বন্ধুর সাথে তার যত ভাব স্কুল ও বাসায় অবস্থান কালে। মা কাজে চলে গেলে বাবার কাছেই থাকে তাথৈ। স্কুল থেকে আনা-নেওয়া, সকাল-দুপুরে খাওয়া-দাওয়া এবং ঘরের মধ্যে বাবা-মেয়ের খুনসুটি দীর্ঘ সময়কে অনেকটাই সংক্ষিপ্ত করে দেয়। বিকেলের জল-খাবারটা দিঘি ফিরলেই তিনজনে মিলে এক সাথে হয়। এগরোল, চপ, সিংগাড়া কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই দিঘি। তাই বিকেলটা খুউব ফুর ফুরে মুচ মুচে মনে হয় তাথৈয়ের। সবাটাই বুঝি তেলে ভাজার তেলেসমাতি! স্কুলের হোম ওয়ার্ক শেষে রাতের খাওয়া শেষে ঘুমের দেশে চলে যায় তাথৈ। খওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রাতের খবর শেষ করে ঘুমিয়ে পড়তে হয় দিঘির, পরদিন ভোরেই আবার ছুটতে হবে যে তাকে। অনেক দিন অপেক্ষার পর তার ভাগ্যের শিকে ছিরলো বুঝি। কল্যাণী এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। টান-পোড়েনের সংসারে খুশির ঝিলিক খেলে যায় তাতে। বি.এড পাশ করার পর চাকরির খোঁজে ব্যস্ত থাকতে হতো সারাক্ষণ, দু’বেলা দুটি’ টউশনি, রাতে তাথৈয়ের পড়াশোনায় সহায়তা এবং কিছুটা সময় তাকে বাধ্য হয়েই ব্যয় করতে হতো পার্টির কাজে। এ ছিল চাকরি পূর্ব রোজনামচা।
বাবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই চারু মজুমদারের অনুসারী দেশে মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে। সেখানেই আনন্দের সাথে পরিচয় এবং পরবর্তীতে পরিনয়ের সুতোয় বাঁধা পড়ে যায় দু’জনে। আনন্দ বলতে গেলে ফুল টাইম পার্টিওয়ার্ক করে, মাঝেমধ্যে কিছু ইলিক্ট্রিক্যাল কাজ করে থাকে। যেহেতু সে ইলিক্ট্রিক্যাল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার তাই এ কাজে তাকে যশ ও অর্থ দুটোই এনে দেয়। তাদের আর্থিক টানা পোড়েনের সংসার হলেও আত্মিক বা মানসিক সুখের কমতি ছিল না কোন কালেই। তবুও দিঘির চাকরি পাওয়াটা ছিল গ্রীষ্মের খরতাপে শান্তির বারিধারা। তার চাকরি পাওয়াটা অপ্রত্যাশিত ছিল না কিন্তু, ভীষণ কঠিন ছিল। সেও নাছোড়বান্দা, এর শেষ দেখে তবেই ক্ষান্ত হবে। সবুরে ও প্রচেষ্টায় যে মেওয়া ফলে তার উদাহরণ দিঘির চাকরি পাওয়াটা। আনন্দ আমার স্কুল বন্ধু সে সুবাদে তার সাথে আমার একটি পারিবারিক বন্ধন ছিল শৈশব থেকেই। মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাত হতো। কিন্তু দিঘির সাথে প্রায়ই কল্যাণী স্টেশনে দেখা হয়ে যেত। দেখা হলে কুশলাদি বিনিময় হতো, এই যা। আমারও চাকরির স্থান কল্যাণী হওয়ায় দিঘির সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি ছিল স্বাভাবিকভাবেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জয়বাংলা (পূর্ব বাংলা) হতে হাজার হাজার উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে এসে আশ্রয় নেয়। কল্যাণীতেও অনেক বড় আশ্রয় কেন্দ্র ছিল। তাদের আহার, বাসস্থান ও চিকিত্সা সেবা দিতে সরজারের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। তখন অপর একটি রাজনৈতিক বিষয় সরকারকে অনেকটাই অস্থির করে তুলেছিলো। প্রায়ই কোলকাতা সমেত অন্যান্য স্থানগুলোতে সরকারি দলের ছাত্র-যুব ফ্রন্টগুলোর সাথে নকশালদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত হতো। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও চোরাগুপ্তা হামলা অথবা দলবদ্ধ হামলার শিকার হতো পরস্পর বিরোধী দলের সদস্য-সদস্যারা। প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলায় প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বেড়েই চলছিল। চাকরিতে যোগদানের কিছুকাল আগেও দিঘিকে নকশালদের একজন গোপন সশস্ত্র যোদ্ধা হিসেবে জানতাম। এ খবর আমি কিন্তু কখনো কাউকে বলিনি বা বলতে সাহস করিনি নিজ থেকেই। যার দরুণ দেখা হলে খুব একটা কথা বলা থেকে বিরত থাকতাম আমি। তাথৈ অল্প কিছুতেই অনেক খুশি। যেমন চুলের ব্যান্ড, ক্লিপ, টিপ, ফ্র্যান্ডশিপ ব্যান্ড – এগুলো পেলে যার পর নাই আনন্দে আটখানা। তাই দিঘি প্রায়ই তাথৈ’র জন্য এটা ওটা কিনে আনতো।
সেদিনও কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে তাথৈর জন্য কয়েকটি বাটারফ্লাই চুলের ক্লিপ কিনে নিলো। ক্লিপের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দাম চুকিয়ে হন্ হন্ করে ছুটতে থাকলো ৫-২০ মিঃ এর ট্রেন ধরতে। স্টেশনের কাছে আসতেই উল্টো দিক থেকে একটি বাইক এসে তার পথরোধ করে দাঁড়ালো। পিছনে বসা আরোহী দিঘির বুক লক্ষ্য করে পর পর দু’রাউন্ড গুলি ছুড়ে নিমেষেই ছুটে চলে গেল। দিঘির গুলিবিদ্ধ ক্ষত স্থান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিল না দিঘি। নিজের কাছে যেন দেহের ওজন দ্বিগুন মনে হলো। রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো দিঘি। রক্তে ভিজে কাপড়, শরীর লাল হয়ে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। অবচেতন মনে দিঘি দেখতে পেল তাথৈ দূর থেকে ছুটে আসছে মায়ের ডাকে মায়ের দিকেই। তাথৈর পড়নে রক্তিম একটি ফ্রক, বাতাসে উড়ছিল, চুলের বেনী দুটোও দুলছিল অবিরাম। দিঘি চিত্কার করে বলছিল, তাথৈ এই দেখ তোর জন্য কতগুলো বাটারফ্লাই চুলের ক্লিপ নিয়ে এসেছি। তাথৈ কাছে আসতেই দিঘির হাতের মুঠোয় থাকা প্যাকেট পড়ে খুলে গেল। প্যাকেটের ভিতরে থাকা রঙিন ক্লিপিংগুলো যেন কতগুলো রঙিন প্রজাপতি হয়ে শূন্যে উড়ে গেল তাথৈ কাছে আসার আগেই। এরপর দিঘির নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে থাকলো পুলিশ না আসা অব্দি। তাথৈ বুঝি অথৈ জলে ডুবে যেতে থাকলো দিঘির অতলান্তিক ভাবনার পুকুরে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা