বিদ্যুৎ সরকার : আজো দিতে পারিনি। তুমি যেরকম লাল একটি গোলাপ চেয়েছিলে ঠিক সেরকম লাল রঙের গোলাপ তো আজও খুঁজে পেলাম না। এই যে না পাওয়ার দুঃখবোধ আমাকে যেমন অস্থির করে তুলছে প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন তেমনি তোমাকেও করে তুলছে আরো দুঃখি। সেদিন যাদুঘর চত্বরে ঘটা করে গোলাপ প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। দু’শরও অধিক প্রজাতির গোলাপ সেখানে প্রদর্শিত হয়। সেখানেও খুঁজেছি কই পেলাম নাতো! এতো না দেখা গোলাপ দেখার সৌভাগ্য আমার হলো সে দিন অথচ, তোমার চাওয়াটাই পাওয়া হলো না। তোমার লাল গোলাপ কি খুবই দুঃস্প্রাপ্য গোলাপ যা কি না খুঁজে পাওয়াই দায়। না আমার কিন্তু এমনটি মনে হয় না। কিছুদিন আগেও তো আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোন এক মেয়ের হাতে দেখেছিলাম কিন্তু এ মুহূর্তে তার চেহারাটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না যে! তা হলে হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারতাম কোথায় গেলে পাব এমন লাল গোলাপ।
দোষ আমারই কেন যে সেদিন বকুল তলায় বসন্ত উৎসবে একজনের খোপায় এমন রঙের একটি গোলাপ দেখে আমিই তোমাকে বলেছিলাম, ‘দেখ, দেখ কি সুন্দর গোলাপ!’ তুমি অবাক হোয়ে তাকিয়ে ছিলে গোলাপটির দিকে। তক্ষুনি তুমি বায়না করে বসলে, ‘আমাকে এমন একটি গোলাপ এনে দেবে তুমি?’ একটি গোলাপইত, সামান্য একটি ফুল তা আর এমন কি? ‘কে জানতো এ সামান্য বিষয়টি আমার জন্য অসামান্য হয়ে দেখা দিবে। সাহাবাগের ফুলের দোকান, কাঁটাবন, আসাদ গেট, ফার্ম গেট, রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলদা গার্ডেন – কোথায় খুঁজিনি আমি? কিন্তু পেলাম কই! এটা এমন কি অসাধ্য কাজ, আমি বার বার ব্যর্থ হচ্ছি। সামান্য একটি গোলাপ খুঁজে না পাওয়ার ব্যার্থতাকে অনেক বড় করে দেখছে নাতো সে? আমিতো আমার সাধ্যমতো আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেই যাচ্ছি। তার চাওয়াটা কি অমূলক ছিলো? না কি আমার ইচ্ছেটাই নড়বড়ে? আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন আমি এ লাল গোলাপ খুঁজে পাবোই। কিন্তু সেতো অনিশ্চিত কবে কখন কে জানে! ততো দিন সে কি আমার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না আমি। আমি আমার হৃদয়ের বুকে কান পেতে রই সারা বেলা। শাশাও একদিন আমাকে জোনাকি ধরে দিতে বলেছিল। রাতের অন্ধকারে জোনাকির আলো তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু তার চাওয়া এ সামান্য জোনাকি তাকে ধরে দিতে পারিনি আমি। তার কন্ঠে প্রায়ই শুনতাম একটি গান ‘জোনাকি দীপ জ্বালো আলো…’।
কিন্তু সে জোনাকির আলো জ্বেলে তাকে আলোকময় করতে পারিনি আমি। সে দুঃখতো আজো মুছে যায়নি। এক দুঃখ মোচন না হতেই আবারও কি অপর এক দুঃখের পলেস্তারায় আবৃত হবো আমি? সামার ভেকেশনে বেশ কিছু দিন বাড়িতে কাটিয়ে হলে ফিরে এসেছি। কুহু এ ক’দিন হলেই ছিল ওর আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। আমি যে ফিরে এসেছি তা কিন্তু কুহুকে জানাইনি। ভোর হতেই সাহাবাগের ফুলের আরতে ছুটে গেলাম লাল গোলাপের খোঁজে। কি আশ্চর্য, একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম আমার এতোদিনের বহুল প্রত্যাশিত লাল গোলাপ। আমি আপ্লæত, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে…।’ এক গোছা লাল গোলাপ হাতে নিয়ে ফিরে এলাম হলে। কোনভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল না হতেই ছুটে গেলাম কুহুর হল – গেটে। টিএসসি’র ওখান থেকেই কুহুকে দেখতে পেলাম আমার অচেনা এক সুদর্শন যুবকের হাত থেকে এক গোছা লাল গোলাপ সানন্দে নিয়ে নিতে। একটা রিকশা ডেকে হাসতে হাসতে হুড টেনে চলে গেল আমার সম্মুখ দিয়েই।
‘লাভ মি লাভ মি নট্, লাভ মি লাভ মি নট্’ – একে একে সবগুলো গোলাপের পাপড়ি ছিড়ে ফেললাম। টিএসসি থেকে হাঁটতে হাঁটতে শিখা চিরন্তনের জলাশয়ের পাড়ে বসে জলের মাঝে আমার বিধ্বস্ত প্রতিবিম্ব দেখে আমার প্রতি আমারই মায়া হলো। আমি জানি না কতক্ষণ ওখানটায় বসে ছিলাম।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা