Home কলাম এই মেঘ এই রোদ্দুর : তিতাসের বাঁকে

এই মেঘ এই রোদ্দুর : তিতাসের বাঁকে

বিদ্যুৎ সরকার : পূঁইয়ের মাচায় লাউয়ের ডগাগুলো কেমন লকলকিয়ে উঠে গেল। হয়তো লাউডগার জন্য পূঁই লতার এ এক মমত্ব বোধ। দু’প্রজাতির লতার পাশাপাশি অবস্থান, বেড়ে উঠা। ইদানীং সকালটায় একটু একটু করে ঠান্ডা পরতে শুরু করেছে- শীতের পূর্বাভাস। সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দেখা যায় পূঁই পাতা, লাউ পাতার উপর বিন্দু বিন্দু কুয়াশা জমে থাকতে, সূর্যের আলো পরলেই কেমন হিরক কুচির মতো জ্বলতে থাকে অনবরত। সকাল বেলায় হাঁটতে গেলে দুর্বা ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশির কনাগুলো পায়ের আঘাতে ভেঙ্গে চূড়মার। রাস্তার ধারে লতিয়ে উঠা সিম গাছগুলোতে কলি থেকে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। বিভিন্ন বর্ণের সিম ফুলের অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারিধারে। শীত আসে সুখের আগমণী বার্তা নিয়ে, শীত আসে ফুলের সৌরভ আর বর্ণিল সৌন্দর্য নিয়ে। পিঠা-পুলি আসে জিভের আস্বাদন নিয়ে। রসসিক্ত চিতই, ভাপা পিঠার অন্তরে জমে থাকে মিষ্টি অনুভূতি। পরিযায়ী পাখির ডানার নরোম পালকে বয়ে আনে সুখের শুভ সংবাদ। সীমান্ত রেখাগুলো অতিক্রম করে সুখ চলে আসে অসুখের নিবৃত্তে। কুয়াশায় ঢাকা দূর গ্রাম, সূর্য উঠার তাগিদ নিয়ে কৃষকের চকচকে লাঙ্গলের ফলায় উঠে আসে উর্বর নরম ভূমি। সবুজে সবুজে ঢাকা প্রান্তর। কীট-পতঙ্গের সন্ধানে পাখিদের বিরচরণ। সবুজ প্রান্তর দোলে উঠে পাখার মৃদু ঝাপটায়। প্রাণ দোলে – মন দোলে আসন্ন ফসলের সোনালী হাত ছানিতে। প্রান্তিক কৃষকের থালায় নবান্নের সুঘ্রাণ।

দূরের ঐ লাল কৃষ্ণচূড়া গাছ, তার গা ছুঁয়ে তিতাস নদীর বাঁকে বনমালীদা’র ভেসাল। সেখানটায় আমাদের ছোট্ট নীড়। নদীর ভাঙ্গা-গাড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের বেড়ে উঠা। বনমালীর ভেসালের জালে আটকে আছে একাদশীর চাঁদ। জলের বানে, মাছের টানে নির্ঘুম বনমালীর ক্লান্ত দু’চোখে মাছের রূপালী স্বপ্ন। ভেসালের টংঘরে এক ব্যান্ডের রেডিওতে বাজে আব্দুল আলীমের মরমী গান। নদীর জলে মিশে আছে প্রাণের গান, গানের প্রাণ। তিতাসের এ বাঁক ভেসাল, বনমালী দা, তরল জলের সরলতা, মাটির সোঁদা গন্ধ, সবুজের স্নিগ্ধতা, নীল আকাশ, আকাশের রঙিন ঘুড়ি, লাটিমের দুরন্ত ঘূর্ণন, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, পরন্ত দুপুরে খেলা শেষে নদীর জলে ঝাপটা-ঝাপটি, রামধনুর রং দেখার প্রতিযোগিতা, টিনের চালে টুপ টুপ আমের বোল পড়ার শব্দ, পাকা বকুলের সিদুঁরে রং, পাখির বাসার নিপুন কারুকাজ – এসব কিছুই ছিল আমার ধমনীর রক্ত প্রবাহ আর প্রাণের স্পন্দন। বনমালী দা’র ভেসালের টং ঘর ছিল ছুটির দিনগুলোতে গল্প শোনার আসর। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। কেমন করে যুদ্ধ করে লাল-সবুজ পতাকা জয় করেছে তারই গল্প। আমাদের বনবালী দা একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তি যোদ্ধাদের গল্প, সহ-যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার গল্প বনমালী দা’র গল্পের বিষয়বস্তু। সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুর গুলির আঘাতে কেমন করে তার হাতের একটি আঙ্গুল হারাতে হয়েছে সে কাহিনীও শোনালো একদিন। তার ঝুলিতে কত যে গল্প তা না শোনলে অনুমান করা সম্ভব ছিল না কোন কালেই। বনমালি দা ছিল আমাদের খুউব প্রিয় একজন, তেমনি ছিল বড়দের কাছেও। তার দু’চোখে প্রায়ই একটি দৃশ্য এসে ভিড় করতো- একটি লাল-সবুজ পতাকার হাওয়ায় পত পত করে উড়ার দৃশ্য। লাল-সবুজ পতাকাটা তার সব চাইতে প্রিয়, অনেক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ পতাকা।

আমাদের শৈশবকে ঘিরে যেমন ছিল রঙিন ঘুড়ি, লাটিম, কানামাছি খেলো তেমনি ছিল প্রিয় বনমালী দা’র ভেসাল, ভেসালের রূপোলী চাঁদ, চঞ্চল মাছ আর লাল-সবুজ পতাকার গল্প। কলেজে পড়ার জন্য শহরে আসতে হয়েছিল এক সময়। কিন্তু যখনই কলেজ বন্ধ হতো ছুটে যেতাম তিতাসের বাঁকে সেই শান্তির নীড়ে, বনমালী দা’র টং ঘরে বসতো গল্পের আসর। কিন্তু শৈশবের সে ভাললাগার আবেদন কোনভাবেই আর ফিরে আসে না শুধু স্মৃতিটুকুই সত্য হয়ে দেখা দেয় বার বার। মন আকাশে অনেকগুলো রঙিন ঘুড়ির উড়োউড়ি, আমের বোল পরার টুপ টুপ শব্দ, লাটিমের অন্তহীন ঘুর্ণন, বনমালী দা’র বারুদের গন্ধমাখা গল্পসমগ্র। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের একটি চিরস্থায়ী চলচ্চিত্র আমার চির সঙ্গী।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা

Exit mobile version