বিদ্যুৎ সরকার : আমার পরের বাড়িটাই জেসিন্থাদের। কিন্তু ওর বাড়িটায় যেতে হলে একটু ঘুরেই যেতে হয়। প্রথমে সিড়ি ভেঙ্গে কিছুটা উপরে উঠে সামনে ওর সাজানো বাগান পাড়ি দিয়ে তবেই তার সাদা গ্রিলের ফটক। ফটকের এক পাশে একটি ডোর বেল, আলতো ছোঁয়ায় মিষ্টি মধুর শব্দে বার কয়েক বেজে থেমে যাবে। দরজা খুলে এক গাল মিষ্টি হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে ভুল করবে না কখনো। ভিতরে যেতে যেতে আমার বয়ঃবৃদ্ধ বাবা-মা ছাড়াও বাড়ির সবার কুশলাদি জানতে চাইবে। এমনকি সদ্য আনা কুকুর ছানা পিউ’র কথাও জিজ্ঞেস করবে। ও ঠিক মতো খাচ্ছে কি না, রাতে ঘুমাচ্ছে তো? না কি মা’র জন্য কান্নাকাটি করে , গুমড়া মুখ করে চুপটি করে বসে থাকে।
সে যে কতটা আন্তরিক তা তার স্বাভাবি আচরণ ও আলাপচারিতায় বুঝে নেয়া যায়। জেসিন্থার বাসায় ঢোকা মাত্র লিভিং রুমে বসতে দিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা- শীতল ফ্রুট জুস সাথে কিছু কাজুবাদাম খেতে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য কিচেনে চলে গেল। তিন বেড রুমের বৃহৎ এ বড়িটিতে জেসিন্থা এখন একাই বসবাস করছে। ফায়ার প্ল্যাসের উপরটায় তার প্রিয়জনদের ছবি শোভা পাচ্ছে। এমনকি তার প্রিয় কুকুর জেমির ছবিও। একমাত্র সন্তান স্বামীর সাথে সুদূর সিডনি শহরে বসবাস করছে আজ প্রায় পাঁচ বছর যাবত। দু’বছর আগে একবার এসেছিল লিওকোমিয়া আক্রান্ত বাবাকে দেখতে। মেয়ে ফিরে যাওয়ার মাস কয়েকের মধ্যে বাবার অকাল প্রয়াণ জেসিন্থাকে ভীষণভাবে একাকী করে দেয়। তখন বৃহৎ এ বাড়িতে প্রিয় জেমি ছাড়া তার সঙ্গী বলতে আর কেউ-ই র’ল না। একাকীত্ব এবং ট্রেস ঘুচাতে কুকুরের সঙ্গ নাকি অদ্বিতীয়। তাই জেমি তার নিত্যদিনের একমাত্র নির্মল বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেল ক্রমশ। শপিং, মর্নিং ওয়াক বা বেরাতে গেলে জেমি আছে তার সাথে সাথে। জেমি – জেসিন্থা যেন একে অপরের সম্পূরক। যেথায় জেমি হেথায় জেসিন্থা, একেই বলে হরিহর আত্মা। জেমির ব্যাপারে জেসিন্থা খুবই যত্নবান। তার স্নানাহার, ঘুম হাঁটতে নিয়ের যাওয়ার বিষয়ে কখনো ব্যতিক্রম হয় না। এমন কি অসুখ বিসুখ হলে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে ছুটে যেতে ভুল করে না। এরই মধ্যে জেমি আমার পাশে এসে চুপচাপ বসে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। এর এভাবে তাকানোর মানে কেন এখনো তাকে কাছে টেনে আদর করছি না?
জেসিন্থার হাতের ট্রেতে প্লেট ভর্তি চিকেন উইংগস আর কফির সুঘ্রাণে জিভে জল না এসে পারে! ওগলো রাখতে রাখতে বললো, ‘দেরি হয়ে গেল একটু’। যখনই আসি না কেন কিছু না কিছু খেতেই হবে এবং যা কিছু পরিবেশন করবে সব কিছুই তার হাতের তৈরি। ওসব খেতে খেতে কথা হচ্ছিল সামার থাকতে থাকতে ধারে কাছে কোথাও কটেজে দু’রাত কাটিয়ে আসার প্রোগ্রাম করলে কেমন হয়? জেমি এখন জেসিন্থার পায়ের কাছে এসে বসলো। জেসিন্থা জেমিকে কাছে টেনে নিল, একটু আদর করে দিতেই সোহাগে লেজ নাড়তে থাকে। জেমি এমনিতেই একটু বেশি আদর প্রত্যাশি, কারোর আদর পেলে বার বার তার কাছে ফিরে যাবে। এরই মধ্যে আলাপ আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো নেক্সট ফ্রাই ডে ইভনিং উই আর মুভিং টুওয়ার্ড মাস্কোকা ফর ফান এন্ড হ্যাভ গুড টাইম।
মাস্কোকা কটেজ থেকে ফেরার দু’দিন বাদে আজই প্রথম জেসিন্থার সাথে দেখা আমাদের বাড়ির সম্মুখেই। হাতে একগাদা শপিং প্যাকেট। যদিও এগুলো হাল্কা কিছু ফুড স্টাফ ছিল তবুও আমি জেমিকে বললাম, সাহায্য লাগবে কিন?
– থ্যাংক য়্যু, মনে হয় তেমন কোন অসুবিধে হবে না। বরঞ্চ, তুমি আমার এখানে চলে আস একসাথেই না হয় দু’জনে মিলে বিকেলের চা-টা খাওয়া যাবে।
– আজ না আসলে হয় না?
-আজ নয় কেন? কোন গেস্ট আসার কথা নাকি?
– তা অবশ্য নয়।
– আরে বংলা দোকান থেকে তোমার প্রিয় কুকিজ এনেছি চায়ের সাথে জমবে ভাল। এ ছাড়া তোমার প্রিয় সেই ফ্রুট।
– তা হলে তো আসতেই হয়।
জেসিন্থার পিছু পিছু তার জানের জান জেমি, তাকে অনুসরণ করছি আমি। এ বয়সে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠাটা তার জন্য আসলেই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
হঠাৎ একটা শব্দ হতেই উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি জেসিন্থা অপর একটি সিঁড়িতে মুখ থুবরে পড়ে আছে নাক বা মুখ থেকে একটি রক্তের ধারা সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসছে। হাতের প্যাকেটগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক পড়ে আছে। একটা প্যাকেটের মুখ খুলে গিয়ে ওটার থেকে অনেক অনেক চেরি গড়িয়ে গড়িয়ে এক সিঁড়ি থেকে নিচের আরেক সিঁড়িতে পড়ছে। চেরিগুলো কেমন বড় বড় ও কালচে রঙ্গের। কেন জানি চেরিগুলোকে মনে হলো এ যেন জেসিন্থার শরীর থেকে নির্গত রক্তধারার জমাট বাধা বল। এবং বলের আঁকার ধারণ করে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। ভাবতেই আমার শরীর গুলিয়ে উঠলো, এখনই বুঝি আমার বমি হবে! সাথে সাথে ৯১১ কল করলে প্যারামেডিক্স টিম এসে জেসিন্থাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জেমি অবাক হয়ে শুরু থেকে জেসিন্থার চলে যাওয়া অব্দি বার বার ওর দিকে তাকাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর সবাই চলে গেলে একাকী আমরা দু’জন, জেমি ও আমি। একটি শূন্যতা, কিছু বিষন্নতা ক্রমেই আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছিল। প্রিয়জন, প্রিয় ব্যক্তি দূরে চলে গেলে বুঝি এমনি হয়! একটু আগেও যা ছিল বাস্তব, চলমান, দৃষ্টির সীমানায় সে হয়ে যায় স্মৃতিময় এক অতীত, অচঞ্চল স্থবির, অদৃশ্যমান মধ্য রাতের হুইসেল।