বিদ্যুৎ সরকার : ছোঁয়া ও আমি একই ইউনিভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী। পার্থক্য শুধু সে আমার চেয়ে এক ক্লাস নিচে পড়ে। প্রথম দেখাতেই, প্রথম কথাতেই আমাকে অনেকটাই চমকে দিয়েছিল সে। সুশ্রী বলত যা বোঝায় সে অর্থে ছোঁয়াকে তেমনটি বলা চলে না কিছুতেই। কিন্তু তার চেহারায়, চলন-বলনে কথা বলার ঢংয়ে তাকে বেশ বুদ্ধি দীপ্ত বা স্মার্ট বলাটা মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না। ছোঁয়া যদিও জেলা শহর থেকে সদ্য এইচএসসি পাশ করে এসে ইউনিভার্সিটিতে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। তবুও কেন যেন মনে হয় এ শহর তার অনেক দিনের চেনা। এ ইউনিভার্সিটি তার অনেক আপন। ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সেটাই প্রমাণিত। ডিপার্টমেন্টে নবাগতদের অভিষেক অনুষ্ঠানে তার তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতোন। আমার উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছোঁয়াকে একটি গান গাইতে বললে কোন কিছু না ভেবেই হারমোনিয়াম টেনে গাইতে শুরু করে দেয় ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দু’জনায়…’ কী অদ্ভূত সুন্দর কন্ঠ ওর। যতক্ষণ সে গান গাইলো ততক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো কান পেতে শুনে যাচ্ছিলাম। সেই কবেকার দেখা বাংলা ছায়াছবি ‘প্রথম কদম ফুল’র প্রিয় গানটির সিকোয়েন্সের কথা মনে করিয়ে দিল তাৎক্ষণিকভাবে। কখনো কখনো কিছু কিছু ঘটনা হঠাৎ করেই ঘটে যায় যা কোন সোনালি অতীতকে মুহূর্তের জন্য বর্তমানের দোরগোড়ায় টেনে নিয়ে আসে। অনুষ্ঠান শেষে যখন সবকিছু গোছাচ্ছিলাম তখনি কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো – – – বেসুরো গলার গান কেমন লাগলো?

– কই আমিতো কোন গান শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না? তবে একটি রোমান্টিক ছায়াছবির দৃশ্য দেখছিলাম।
– আমি যে গান গাইলাম এমনি এমনি?
– এমন সুন্দর একটি গান এতো মধুর করে গাইলে, প্রাণ জুড়িয়ে গেল মন ভরে গেল। আবার কবে যে এমন গান শুনতে পাব কে জানে!
– হয়তো আবার কোন একদিন অন্য কোন অনুষ্ঠানে।
– গানটা তোমার সঙ্গী করে নিয়ে নিলেই পার।
– লেখাপড়ার দায়িত্ব – ভার কে নেবে? মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠান হলে ডাকবেন আপনার পছন্দের গান গেয়ে শোনাবো ক্ষণ।
– আমার পছন্দের গান কোনগুলো তুমি খোঁজে পাবে কেমন করে?
– এই যে আজকের গানটির কথাই ধরা যাক, গান শুনেতো মন্দ বলার সুযোগ পাননি নিশ্চয়ই? এর থেকেই বুঝে নেয়া খুব যে একটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না আপনার পছন্দ অপছন্দের বিষয় আসয়।
– বাবা, এক নিশ্বাসে মাইল পার!
– সিরিয়াসলি নেবেন না,একটু মজা করলাম।
– গোছানো তো শেষ এখন কি করা যায়?
– কেন, ফলোড বাই চা-সিঙ্গারা।
– ইয়েস, ইটস এ গুড আইডিয়া।

চা-সিঙ্গারা খেতে খেতে ছোঁয়ার সাথে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ইউনিভার্সিটিতে নতুন এসে কেমন লাগছে, হলের খাওয়া-দাওয়া, বাড়ির আপন জনদের কথা সবকিছুই কি ভীষণভাবে মিস করছে সে…..
– একটু পজ দিবেন প্লিজ। এক নাগারে এতো এতো প্রশ্ন এজ ইফ আমি বি সি এস ভাইবা বোর্ডের সম্মুখে! আপনার অবগতির জন্য বলছি ভার্সিটি জীবন আমার কাছে একটি স্বপ্ন ছিল এতোদিন, সেই স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে বাকী জীবন সুন্দর করে নিজকে গড়ে তুলতে চাই আমি। হলের খাওয়া হলের খাওয়ার মতনি, বাড়ির মতোন আশা করাট সমিচীন হবে না কোন মতেই। হ্যাঁ, আমার প্রিয় মানুষদের মিস করছি অবশ্যই। তবে, তাও তো খুব যে বেশি দূরে বা কঠিন তাতো নয়। ইচ্ছে করলে যেকোন দিন ছুটে চলে যেতে পারি নিমেষেই।
ডিপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডের পাশেই একটি ঘোষণা দেখে থমকে দাঁড়ায়, মনে মনে একটু পুলকিত হোয়ে গেল ছোঁয়া। কয়েকজন মিলে একটি ভ্রমণের গ্রুপ বানিয়েছে। নামটাও বেশ ‘সবুজের সন্ধানে’। গ্রুপের মূল লোকদের খোঁজ নিতে গিয়ে আমাকে সামনে পেয়ে গেল। কারা এ গ্রæপের সাথে জড়িত জানতে চাইলো ছোঁয়া।

– আমরা ক’জনে মিলে এ উদ্যোগ নিয়েছি, প্রতি বছর বিভিন্ন ছুটিতে আমরা কোথাও না কোথাও ছুটে যাই সবুজের সন্ধানে মনটাকেও একটু সবুজ ও ফ্রেশ করে নিতে। বই-পত্তর, পরীক্ষার গুমোট অবস্থা থেকে একটু পরিত্রাণ চাই।
– এ সংগঠন কী শুধু ছেলেদের জন্য সীমাবদ্ধ।
– তা কেন, আমাদের সাথে বেশ ক’জন মেয়েও রয়েছে। আমরা জেন্ডার ব্যালেন্সে বিশ্বাসী।
– আমিও কি দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারি? এ সফরে আমিও থাকতে চাই।
– মোস্ট ওয়েলকাম। তোমাকে দলে পেলে সব্বাই খুশি হবে, আমার বিশ্বাস। তোমার কর্মতৎপরতার কথা কারোরই অজানা নয়। উপরি পাওনা তোমার গান।
– সবই বুঝলাম কিন্তু, আমরা যাচ্ছিটা কোথায় এবার।
– তুমি কোথায় যেতে চাও, এনি চয়েস?
– সবুজের কাছে যেতে চাই, সেটা যদি পাহাড় হয় তো কথা নেই।
– আমরা পাহাড়ের কাছেই যাচ্ছি।
– ও গ্রেট!

– আগামী সপ্তাহেই রওনা হচ্ছি, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ট্রেনে, ওখান থেকে বাসে করে রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটিকে কেন্দ্র করে এর আশ-পাশ সব কিছু দেখার ইচ্ছে।
– সবুজ কেন এতো অবুঝের মত ভালোবাসতে শেখায় প্রকৃতিকে। যে দিকে তাকিয়ে দেখি শুধুই সবুজ। সবুজ মিষে আছে সবুজে, হালকা থেকে গাঢ় সবুজে চির অমলিন। দূর পাহাড়ের উপত্যকা সবুজে সবুজে ঢেউ খেলানো। আবার কোথাও সবুজ মিলে আছে আকাশের নীলে।
– তুমি সবুজকে এতোটা ভালোবাস?
– আমি ভীষণভাবে প্রকৃতি প্রেমি। প্রকৃতির সকল রূপকেই আমি ভালোবাসি। তবে, সবুজ রংটার প্রতি আমার আলাদা একটা টান রয়েছে। আর, সেটা যদি হয় পাহাড়ি সবুজ তা’হলেতো কথা নেই।
পাহাড়ের গাছ-গাছালির সবুজে একটি ভিন্নতা রয়েছে যা কি না সমতল ভূমিতে খোঁজে পাওয়া যায় না। সে জন্য পাহাড়ি সবুজকে একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমরা কি রং নিয়ে গবেষণা করতে যাচ্ছি? তা না হলে শুধু শুধু কালক্ষেপণ করছি মনে হয়। আমরা অন্য কিছু নিয়ে এগোই, কি বলেন?

– ব্র্যাকফাস্ট শেষ করেই আমরা ট্র্যাকিং এ বের হচ্ছি সবাই রেডি হোয়ে নাও। সবার সাথে খাবার জল, কিছু ড্রাই ফুড নিয়ে নিতে ভুল করো না। আমাদের ফিরতে হয়তো দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে।
পশ্চিমের নীল আকাশ তখন রং পরিবর্তনের খেলায় মত্ত। হালকা হলুদ থেকে কমলা। অতঃপর এক সময় লাল হয়ে কাল অন্ধকারের কোলে সপে দেয় নিজকে। পাহাড় ও সবুজ উপত্যকা ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে। নৈশব্দের বলয় ভেঙ্গে বন মোড়গের হঠাৎ আর্তনাদ, ঝিঁঝিঁ পোকার বিরামহীন ঐকতান। জোনাকির হাজার আলোয় আলোকিত পাহাড়ের পাদদেশ। ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার….’

সারা দিন ট্র্যাকিং’র ধকল, চড়াই-উতরাই পাহাড়ি পথ, ক্লান্তিতে শরীর রীতিমত অবশ ও অবসাদগ্রস্ত। রাতের খাবার শেষ করেই ঘুমের ঘোরে সবাই। সকালে আবার নতুন উদ্যোগে সবুজের সন্ধানে পাহাড় অভিযান। আবার চড়াই-উতরাই সবুজ উপত্যকা, সুনীল আকাশের বর্ণীল হাতছানি।
সাত সকালে মোবাইল বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। অসময়ে বৃষ্টির আবেশে ঘুমের ঘোরে হাতরিয়ে হাতরিয়ে কাছেই ফোনটা পেয়ে গেলাম, কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে,
– কেমন আছেন, ছোঁয়া বলছি।
– এদ্দিন পর, কোত্থেকে?
– ঢাকা থেকেই বলছি, ভুলে জাননি তাহলে।
– কী যে বল না, তোমাকে ভোলা কি এতোটাই সহজ! তোমার কন্ঠস্বর, তোমার চঞ্চলতা, তোমার কর্মতৎপরতা -এ সব কিছু কি না ভোলার জন্য যথেষ্ট নয়? তুমি চলে যাবার পর একটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম আমরা।

– আমরা কেউই কি চিরকাল এক সাথে থাকতে পারবো কিংবা থাকতে পারছি? বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার শিকার হয়ে বন্ধন থেকে অন্যত্র ছিটকে পড়তে হোয়েছে এবং হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক এটাই চিরন্তন সত্য।
– তোমার চলে যাওটা কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল সবার কাছে।
– আপনিও তো সবাইকে তাক লাগিয়ে জব নিয়ে চলে গেলেন সুদূর চট্টগ্রাম।
– বাস্তবতাকে মেনে নিতে হচ্ছে সবাইকেই।
– তবুও লেখা-পড়ার পাঠ চুকিয়ে অনেকটা দিন আমরা একসাথে একটা দারুণ সময় কাটিয়েছি, এটাইবা কম কিসের!
এখন আসল কথায় আসি, আগামী সপ্তাহে আপনাকে ঢাকায় দেখতে চাই, কোন অজুহাত মানতে নারাজ। দেখা হচ্ছে শনিবার সকাল ধানমণ্ডির সেই সাম্পান-এ।
যদ্দুর মনে পড়ে আমাদের শেষ দেখাও হয়েছিল এ সাম্পানেই।
– তোমার স্মরণ শক্তির তারিফ করতে হয়।

– সকাল দশটার মধ্যেই আমি চলে আসবো অবশ্যই। আশা করি আপনারও এ সময়ের মধ্যে আসতে অসুবিধে হবে না?
শীত আসতে এখনো দেরি তবুও লেকের জলে কুয়াশা ও ধোঁয়ার একটি মিশ্রিত লেয়ার দেখতে ভালই লাগছে। লেকের দু’ধারে গাছ-গাছালির সমারহ, দু’পাড়ে রয়েছে বেশ কিছু রাধাচূড়া ও কৃষ্ণ চূড়া গাছ, লাল-হলুদ ফুলের মিশেল। এ এক মনোরম দৃশ্য। এখানটায় আসলে মন এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। লেকের স্থির জলে অস্থির প্রজাপতিদের উড়াউড়ি।
ভালো লাগে দেখতে, ভালো লাগে ভাবতে। কোলাহল বিহীন এ নিরবতায় সুখ লুকিয় থাকে লজ্জাবতীর পাতার অন্তরালে। ছোঁয়া বা মনিস দু’জনের কেউই এখনো এসে পৌঁছায়নি, যদিও দশটা বাজতে আরো পনের মিনিট বাকি। কিছুক্ষণ পর হুড তোলা একটি রিকশা এসে ঠিক সাম্পানের সামনে থামলো। হয়তো ছোঁয়া এসে গেছে। লাল পেড়ে সবুজ শাড়িতে ওকে মানায় বেশ, সবুজ প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার। ভিতরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো, নিশ্চয়ই মনিসকে খুঁজছে মনে মনে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ছোঁয়া। একটু বাদে পিছন ফিরতেই মনিসকে দেখে চমকে যায়। এখনো দশটা বাজতে দু মিনিট বাকি। হাতের প্যাকেট ও গোলাপ ফুল ছোঁয়ার হাতে তুলে দিতে দিতে বললো,
– খুব বেশি দেরি করে ফেললাম নাতো?

– ওটাই আপনার জন্য স্বাভাবিক, আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবুও ভেবেছিলাম আজ তার ব্যত্যয় ঘটলেও ঘটতে পারে। আসলে আপনি যেমনটি ছিলেন তেমনটিই রয়ে গেলেন।
– শেষ অব্দি আমি তেমনি থাকতে চাই। ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও…..।’
– আবার প্যাকেট কেন, সাথে আবার গোলাপ?
– দু’টোই তোমার প্রিয়, নোয়েল গুরের সন্দেশ আর গোলাপ।
– সব কিছুই মনে রাখেন দেখছি, শুধু মনে রাখতে ভুলে যান কষ্টগুলো।
– কাকে কষ্ট দিয়েছি, কে কখন কষ্ট পেল তা তো মনে করতে পারছি না!
– থাক ওসব কথা, চলুন খোলা জায়গাটায় গিয়ে বসি, ওখান থেকে লেক, লেকের টল মল জল, জলের মধ্যে গাছেদের প্রতিচ্ছবি, সুনীল আকাশ দেখতে পাবো।
– কী খাবে বল, চা অর কফি? সাথেতো স্ন্যাক্স থাকছেই, এখানকার প্রিয় তোমার সেই ম ম আর হট পেটিস।
– আগামী সপ্তাহেই দুবাই চলে যেতে হচ্ছে।

– হঠাৎ করে দুবাই কেন? এই চিরসবুজ বাংলাদেশকে ছেড়ে ধু ধু মরু প্রান্তরে?
– বরকে তার কোম্পানির হেড অফিসে জয়েন করতে বলা হয়েছে এর মধ্যেই। তাই, আমাকেও চলে যেতে হচ্ছে সাথে।
আকাশটা বুঝি হঠাৎ কাল মেঘে ঢেকে গেল, লেকের জলে মৃদু কম্পন, বিম্বিত ছবিগুলো ভেঙে যাচ্ছে অনবরত, বিবর্ণ হতে লাগলো রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়ারা। কোথাও কেউ নেই, নৈশব্দের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে আস্ত ‘সাম্পান’! ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বার রোডের বহুল আলোচিত সাম্পান রেস্তোঁরা। সকাল বিকাল বাধনহীন আড্ডা, প্রেমিক প্রেমিকার স্থির চোখের ভাষাহীন কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দু, সবার প্রিয় সাম্পান ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে মফস্বল শহর থেকে আসা এক কৃষ্ণ কলি, ডুবে যাচ্ছে সবুজ-পাগল এক অবুঝ যুবক।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা