বিদ্যুৎ সরকার : ও’র নাম এমনটি না হয়ে মুনিয়া, বুলবুলি বা মাধু, শিউলী হতে পারতো কিন্তু মা-বাবা ইচ্ছে করেই মেয়ের নাম রেখেছে- ‘খিলখিল’। বয়স বড় জোর দুই কিংবা আড়াই হবে হয়তো, এতো সুন্দর করে খিল খিলিয়ে হাসবে। সাথে দু’গালে দুটো ছোট্ট টোল। ওর নাম তো খিল খিল হওয়াই স্বাভাবিক। ছোট্ট দুটি পা দিয়ে টুকটুকিয়ে ঘরময় হাঁটবে আর গুন গুনিয়ে নিজ মনে কি যে ছাই পাশ অনবরত গেয়ে চলে সেই জানে। চেনা-অচেনা যেই ডাকুক তার কাছে ছুটে যাবে। সহসাই সবার মধ্যমণি হয়ে যায়। আজকাল ও সাজতে শিখেছে মানে কাউকে সাজতে দেখলে সেও দেখা-দেখি সাজতে বায়না ধরবে। যেমন, কেউ যদি চোখে কাজল দেয় তক্ষুনি খিলখিল দু’হাতে চোখ মেলে ধরবে। তেমনি কেউ যদি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে যায় সাথে সাথে কাছে গিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে ওঁ ওঁ শব্দ করতে থাকবে অনবরত।
ওর কুট্টি মাসি সেদিন পায়ে আলতা পড়ছিল সাথে সাথে খিলখিলও দৌড়ে এসে ওর নুপুর পড়া একটি পা সম্মুখে এগিয়ে দিল। যেই না ওর দু’পায়ে আলতা মাখা শেষ, ওমনি আনন্দে নাচতে শুরু করে দিল ঘুরে ঘুরে। কুট্টি মাসি যেদিন পায়ে আলতা দেবে সেদিন ওর পায়েও আলতা দেয়া চাই। কোনদিন যদি সে কোন কারণে কুট্টি মাসির সাথে আলতা দিতে মিস করে তখন বায়না ধরবে তাকেও আলতা দিয়ে দিতে। এভাবে আলতার প্রতি এক দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি হলো খিলখিলের। সাজু-গুজু করা মানেই পায়ে আলতা চাইই চাই তার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় খিলখিলের বয়স বড়জোর পাঁচ বা এর চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও হতে পারে। সবাই তখন শহর ছেরে গ্রামমুখি হতে শুরু করলো। শহরের তুলনায় গ্রামকে অনেক নিরাপদ মনে হচ্ছিল সে সময়। খিলখিল এসবের কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। শুধু তার স্মৃতিতে এতটুকুই মনে পড়ে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য কোন স্থানে ছুটে চলছে ঠিকানাবিহীন, উদ্দেশ্যহীন। সবার মুখে কেমন এক আতংক, ভয় এসে, জড়ো হোয়েছিল হয়তো। খিলখিল ঘটনাগুলো বড় হয়ে মিলিয়ে দেখেছিল।
যুদ্ধকালীন সময়টা কত ভয়ংকর ছিল। খিলখিলও ঢাকা ছেড়ে বাবা-মায়ের সাথে চলে এলো কুমিল্লার এক গ্রামে ওর মামা বাড়ি। সেখানেও সবাই কেমন আতংকগ্রস্ত ছিল। সবাই আগের মতো করে আর আদর করে কাছে টেনে নেয় না। সব কিছুই কেমন করে বদলিয়ে যাচ্ছিল যখন তখন। কারণ জানাটা অপরিহার্য ছিল না তখন ওর কাছে। কিন্তু তার প্রতি সবার অবহেলা, অযত্ন একটু বেমানান ঠেকছিল খিলখিলের মনে। দু’দিন পর হঠাৎ পাশের গ্রামের হট্টগোলের শব্দে ঘড় থেকে বের হয়ে এলো। খিলখিলও বাবার সাথেসাথে চলে এলো কি হয় দেখতে। বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো খুব কাছেই পাশের গ্রামে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে আর সেখান থেকেই মানুষের আর্তচিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে ক্ষনে ক্ষনে। বাড়ির সব্বাই নিমেষেই কেমন ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে গেল। সে রাতেই সবাই বসে কি কানাঘুষা করলো এবং বাবা ঘড়ে এসে মার সাথে হয়তো এসব কিছু বলতে লাগলো মাও কেমন জানি ভয়ে কুঁকড়ে গেল। সবার দেখাদেখি খিলখিলও কিছু না বুঝেই ভীত হয়ে গেলো। রাতে মাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকলো। ভয়ে সে ঘুমাতে পারছিলো না শুধু ছট ফট করছিল আর মনে হচ্ছিলো যেন সেই আগুনের হল্কা তার চোখ মুখ পুড়ে দিচ্ছিল অনবরত। এমনটা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে নিজেও জানে না। মা’র অনবরত ডাকাডাকিতে খিলখিল জেগে উঠে ঘুম থেকে। সে জানে না কেন সকাল না হতেই তাকে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে যেতে হলো? কিছুক্ষণের মধ্যেই মা-বাবা বাড়ির অন্যান্যদের সাথে দ্রæত পায়ে হাঁটতে শুরু করে দিল। কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না খিলখিল। শুধু একটি শব্দ ‘বর্ডার’ বার বার অনেকের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছিল ফিসফিসিয়ে। এর মধ্যে অনেক দূর হেঁটে ফেলেছে খিলখিল। এ বয়সে আর কখনো এমনটি হাঁটতে হয়নি ওর। ভোরের আলোয় মেঠো পথে এখন অনেকটাই দ্রুত হাঁটতে পারছিল সবাই। সকাল সকাল বর্ডারে পৌঁছাতে হবে যে। খিলখিলের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো ক্ষুধায় এতো দূর হেঁটে আসতে। কিন্তু বাবা কিংবা মা কে কিছু বলার সাহস হচ্ছিলো না ওর। কেমন যেন একটি ভয়ের ছাপ সবার চোখে মুখে।
হঠাৎ সবাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। পথের পাশেই একজন মানুষকে উপুর হয়ে পরে থাকতে দেখল। তার সমস্ত গা ক্ষত বিক্ষত, জখমের স্থান থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল অনবরত। কে একজন তার উপুর হোয়া মুখ দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো ‘এ তো দেখি আমাদের পরিচিত নিরাঞ্জন দাসের, ও এখানে আসলো কেমন করে?’ সবাই কেমন হকচকিয়ে গেল, একে অপরের মুখ চাওয়া চায়ি করছিল এক উৎকন্ঠা নিয়ে। খিলখিল লোকটির গা থেকে রক্ত ঝরার দিকে তাকিয়ে ছিল অপলক। কী জানি খুঁজে বেড়াচ্ছিল নিজ মনে! এক সাথে এতো রক্ত আগে কখন দেখেনি সে। কুট্টি মাসির কথা মনে পড়ে গেল তার। একদিন কুট্টিমাসী তার পায়ে আলতা দিতে গেলে হাত থেকে আলতার শিশি ফেলে দেয়। সমস্ত মেঝে তখন আলতার লাল রঙে ঢেকে গিয়েছিল। ঠিক, আজ যেমন দেখছে লোকটির গায়ের লাল রক্তের ধারা। খিলখিল ভীষণ ভয়ে কুঁকড়ে গেল। তার পায়ের দিকে তাকিয়ে কেন জানি তার মনে হলো ওর পায়ের আলতাটুকুও বুঝি কারোর ক্ষতের রক্ত। খিলখিল এখনো সময় পেলে শখ করে একটু আধটু সাজু-গুজু করে। কিন্তু, কখনো পায়ে আলতা পড়ে না। একাত্তরের সেই দূর্বিসহ স্মৃতি এখনো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা