বিদ্যুৎ সরকার : অনেক দিন পর তোকে লিখছি। অনেক দিন কি, বেশ ক’বছর পরই তো লিখতে শুরু করলাম আবার। কেমন করে যে দিন মাসে, মাস বছরে গড়ায় কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। সাংসারিক উটকো, অপ্রত্যাশিত ঝামেলাগুলো স্বাভাবিক জীবন যাপনকে অনেকাংশে বিঘ্নিত করে থাকে প্রায়শই। তাই, কখনই ভাবিস না তোকে আমি ভুলতে বসেছি। আজ লিখি, কাল লিখি করে করে সময় মত লিখা আর হয়ে উঠছে কই বল? প্রতিদিনের শত কাজের ফাঁকে তোর কথা অন্তত একবার হলেও আমার মনে পড়বেই। আমাদের সমস্ত শৈশব ঘিরে তোর – আমার স্মৃতিগুলো এখনো প্রাঞ্জল, অমলিন। বয়স বারার সাথে সাথে স্মৃতির ভান্ডারও সমৃদ্ধ হতে থাকে ওজনে আয়তনে। কিন্তু, শৈশবের স্মৃতিগুলো সততই সুখের, বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ ধারা জীবনের প্রতিটি ক্ষণে। স্মৃতি কাতর মানুষ বার্ধ্যকে পৌঁছেও শৈশবের স্মৃতি রোমন্থনে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সময় অসময়ে। আমরাও বুঝি আস্তে আস্তে সে দিকেই এগুচ্ছি দিন দিন প্রতিদিন। সুমন্ত তোর কি মনে পড়ে স্কুলের প্রথম দিন, আমি যখন ক্লাসে ঢুকলাম তুইই আমাকে তোর পাশে বসতে জায়গা করে দিয়েছিলি? সেই থেকেই তোর প্রতি আমার এক ধরনের টান জন্মেছিল এবং এক অদৃশ্য সুতোর টানে আমরা আবদ্ধ হোয়ে গেলাম পরস্পর। এটাই কি ভালো লাগা, এটাই কি বন্ধুত্ব? দু’জনের কেউ একজন স্কুলে না আসলে মনের ভেতর কষ্ট অনুভূত হতো।

ক্লাসে পড়ায় মন বসতো না। টিফিন পিরিয়ডের ছোট ছোট ঘটনাগুলো মনে করে এখনো কেমন ইমোশনাল হয়ে পড়ি। যা খেতাম দুজনেই শেয়ার করে খেতাম। একদিন পয়সা ছিলো না বলে একটি আইসক্রিম একবার তুই এক কামড় দিতিস পরের বার আমি। এমন করেই আমরা ভালোবাসা ভাগ করে নিতাম। যখন আমরা ক্লাস নাইনে উঠলাম আমাদের স্কুলটা বেশ দূরের হয়ে গেল। এতটা দূরে হেঁটে যেতে আমাদের কষ্ট হতো। বাধ্য হয়ে তোর মামার ভাঙা সাইকেলটা মেরামত করে দু’জনে মিলে শেয়ার করে চালিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতাম। একদিনের কথা তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, একটি ছাগল ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে সাইকেল সমেত দু’জনেই পরে গেলাম পাশের ডোবাতে। দু’জনে জলে ভিজে একাকার আর কি! গ্রিষ্মের দুপুরগুলোতে আম- জাম গাছে উঠে আম-জাম, পেরে খাওয়া আর পাখির বাসা খোঁজার স্মৃতিগুলো কম কিসের বল্। এ সকল সুখময় দিনগুলোর কথা মনে করে ভীষণ আনন্দ পাই, কষ্টও পাই সুমন্ত। পয়ষট্টির দাঙায় একদল লোক রাতের অন্ধকারে এসে আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল তুই দৌড়ে এসে নেভাতে চেষ্টা করলি কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। তুই তখন রাগে, ক্ষোভে আগুনের মতোই অন্তরে অন্তরে জ্বলছিলি পাশে দাঁড়িয়ে আমি এক অজানা অভিমানে গুমরে গুমরে কাঁদছিলাম। সুমন্ত তুই আমার পিঠ ছুঁয়ে শান্তনা দিতে চেষ্টা করছিলি বার বার। আমি শুধুই নীরবে কেঁদেই যাচ্ছিলাম নির্বোধের মতো। আগুনে পুড়ে ভস্ব হয়ে যাওয়া আমাদের বাড়ি, ঘরের ছাই দলা থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছিল। এক লহমায় আগুন আমাদের কেমন নিঃস্ব করে দিয়ে গেল। বাবা সে রাতেই সবাইকে নিয়ে কোথায়, কি উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে দিলেন। আমরাও কলের পুতুলের মত তার পিছু পিছু ছুটছিলাম। বাবাকে কোনকিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছিলো না কারোরই। রাগে, অভিমানে তার চোয়াল শক্ত, গাল রক্তিম দেখাচ্ছিল সেই অন্ধকারেও। খুব ভোরে আমরা সবাই একটা বড় বট গাছের নিচে এলে বাবা সবাইকে বসতে বললেন। এবার কিছুটা নরমাল দেখা যাচ্ছিল তাকে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমরা বর্ডার ক্রস করলাম।

কিন্তু আমিতো কোন সীমারেখা দেখলাম না, না কোন প্রাচীর কিংবা কাঁটাতারের বেড়া। নেই কোন সুবর্ণ রেখা নদী, একই মাটি, গাছ, সবুজ পাতা, নীল আকাশ – তবে কেমন করে বর্ডার হলো? পার্থক্যটা কোথায়, সব কিছুই তো একই রকম! বাবা বললেন পার্থক্যটা কিছু দুষ্ট লোকের মনের মাঝে, ওটা দেখা যায় না মাঝে মাঝে হঠাত সুযোগ বুঝে প্রকাশ পায়। তখন সে আর মানুষ থাকে না, পশুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। মুষ্টিমেয় কিছু দুষ্ট লোকের দাড়াই শান্তি বিঘ্নিত হয়, স¤প্রদায়ে স¤প্রদায়ে মারামারি হয়, হানাহানি, কাটাকাটি, দাঙা ঘটে। যেমনটি ঘটেছিল সাতল্লিশে। মানুষ দেশান্তরিত হয় তার নিজ ভিটে ত্যাগ করে, নিজের বাপ-দাদার শেকড় ছিন্ন করে চিরকালের জন্য। আমাদের সহায় সম্বল কিছুই ছিল না শুধু স্মৃতি ছাড়া। সেই স্মৃতি আকড়ে এখনো আমরা বেঁচে আছি বেঁচে থাকবো আগামী দিনগুলোতেও। সুমন্ত তোদের উঠোনের উপর যে পেয়ারা গাছটা ছিল কী ডাশা ডাশা পেয়ারা হতো। যখন ওগুলো পাঁকার সময় হতো দু’জন দিনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দিতাম গাছের ডালে ডালে। পাড়ার অনেক ছেলে মেয়েরাই আসতো সেই মিষ্টি ডাশা পেয়ারা খেতে। তোদের পাশের বাড়ির যমজ দুই বোন তিথি বীথিও আসতো। ওরা আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়তো। তুই তিথিকে যেমন একটু বেশি পাত্তা দিতি আমিও তেমনি বীথিকে। বিভিন্ন পুজা-পার্বনে ওদের বাসায় যেতাম লাড়ু, মোয়া খাবার ইচ্ছায়। আবার ঈদের দিনে সবাই যেতাম তোর মায়ের হাতের সেমাই খেতে। কী যে মধুর ছিল সে সব ফেলে আসা দিনগুলো। আমরা কেউই জানি না ওরা কেমন আছে, কোথায় আছে শেকড় ছিন্ন করে দিয়ে কোন্ দূর দেশে? দিনে দিনে অনেক বেলা হয়ে গেল। বয়স বারার সাথে সাথে চোখের দৃষ্টি শক্তিও ভাটার দিকে। তবুও মনের চোখ দিয়ে স্মৃতির ক্যানভাসে দেখতে পাই ফেলে আসা শিমুলতলি গ্রাম, মিত্তির বাড়ির পদ্ম পুকুর, রথের মেলার নাগর দোলা, লক্ষন দাসের মন কাড়া সার্কাস আর গড়ম গড়ম জিলাপির রস সিক্ত হাতছানি।

সুমন্ত, আমাদের সুখময় শৈশব, রথের মেলার নাগর দোলায় দোল খাওয়া শৈশব, ঘুর্ণায়মান সাইকেলের দু’চাকায় আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার শৈশব, নীলকন্ঠ পাখির পালকের পেলবতা মাখা শৈশব, কাচা আমের সুঘ্রাণ মাখা শৈশব, নির্জন দুপুরের ঘুঘু ডাকা শৈশব আজ কোথায় হারিয়ে গেল, কেন হারিয়ে গেল এক অসময়ের শ্লেজ গাড়ি চড়ে? সুমন্ত আমার মন ভাল নেই, তোকে ভীষণ মিস করছি প্রতিদিন প্রতিক্ষণ। জানি কোন দিন আর দেখা হবে না দু’জনায়। কষ্ট পেতে আমরা কেমন অভ্যস্ত হোয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। একটি ফড়িং ধরার প্রত্যাশা নিয়ে দু’জনে আর ছুটবো না মাইল মাইল ধান ক্ষেত? সুমন্ত আমি ভাল নেই, একটি নীল প্রজাপতি বার বার উড়ে এসে জুড়ে বসছে মাধবীলতার ফুলের ডগায়। সুমন্ত তুই এসে দেখে যা আমি কেমন করে বেঁচে আছি সুখ হীন অসুখে, শেকড় বিহীন স্বর্ণলতার মতোন।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা