বিদ্যুৎ সরকার : কামরার ভিতরের চাইতে বহি:দৃশ্যপট আমাকে বেশি টানে। স্বাভাবিকভাবেই ট্রেন জার্নিতে জানালা লাগোয়া আসন আমার ফার্স্ট চয়েস। চলন্ত ট্রেনে জানালায় মাথা রেখে সারাক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি দূরের সবুজ গ্রাম, বাতাসে দোল খাওয়া কলমির ডগায় উড়ন্ত ফড়িং, সোনালী ধানের সীমাহীন কুর্নিশ, পদ্ম পাতায় অস্থির ব্যাংগাচি, ভেসালের জালে হঠাত আটকে পড়া মাছেরা- দৃশ্যগুলো কত সহজেই না অদৃশ্য হয়ে যায় বিপরীত গতিতে চোখের সীমানা পেরিয়ে। এভাবে বিপরীত দিকে ছুটে যাওয়া দৃশ্যমান স্থির বস্তুসমূহ কেমন করে সচল হয়ে উঠে, ভেবে ভেবে অবাক হয়ে যেতাম শৈশবের দিনগুলোতে।
ছুটছে ট্রেন, ছুটছে সবুজ গ্রাম, সোনালী ধানের মাইল মাইল প্রান্তর, স্বচ্ছ জলের মসৃন জলাশয়। উড়ন্ত মাছরাঙার দূরন্ত উড়াল। স্মৃতিরাও বুঝি এমনি করে হারিয়ে যায়, অদৃশ্যমান হয়ে যায় চলন্ত ট্রেন থেকে দেখা দূরের সবুজ গ্রামগুলির মতন। জীবন কি একটি চলন্ত ট্রেন? স্মৃতিগুলো কি বিপরীত দিকে দ্রুত গতিময় স্মৃতির মন্তাজ? বর্ণিল স্মৃতিরা কেবলই বিবর্ণ মোড়কে ঢেকে দেয় সোনালী শৈশবকে।
প্রথম ট্রেনে চড়া শৈশবের কিশোরগঞ্জেই। কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ। রেলের কামরা ঝিক ঝিক ঝিক-কিশোরগঞ্জ-ঈশ্বরগঞ্জ-শম্ভুগঞ্জ ব্রীজ, নীচে অশান্ত ব্রর্ম্মপুত্র নদ, দূরে সবুজে ঘেরা গাড়ো পাহাড়। সবুজের মত সহজ সরল অবুঝ জনবসতি, প্রকৃতির ভালোবাসায় লালিত পাহাড়ী এ জনগোষ্ঠী। ব্রীজের ওপারে ময়মনসিংহ জেলা শহর, প্রথম ভালোলাগার নতুন এক শহর- আবিষ্কারের সজিব শিহরন। সকাল বিকাল শহর দেখা নব উদ্যম আর উচ্ছ্বাস আমাকে দু’দিনেই অনেকটা শহর প্রেমিক করে তুলেছিলো। এই শহর ঘুরে ঘুরে দেখার গাইড কাম বন্ধু সমবয়সী কুহু। যাদের বাসায় থেকেছি। কুহু একই শ্রেণীতে পড়ে। এতে করে বন্ধনটা ভালোই জমে গিয়েছিলো। সে বয়সে ওর সাধ্যমত যতটুকু চেনা জানা ছিলো এই শহরটার মনে হয় তার সবটুকুই চেনাতে সক্ষম হয়েছিলো কুহু। তবে প্রতিদিন একবার হলেও আমরা ব্রম্মপুত্র নদের পাড়ে ছুটে যেতাম। আমার যেমন নদী ও পাহাড় প্রিয় কুহুরও তাই। নীল সমুদ্রের চাইতে সবুজ নদী আমাকে অধিক বিমুগ্ধ করে। দু’পাড়ে সবুজ বনভূমি, পাহাড়ের উচ্চতা, তার শরীরের রং বৈচিত্রের বিচিত্র অনুভূতি মনে সুখ জাগায়। নদীর পার ঘেসেই কুহুদের বাসা তাই, সময় অসময় ছুটে যেতাম নদীর পাড়ে অতল জলের আহ্বানে। এক সন্ধ্যেতে ছুটে গিয়েছিলাম জোছনা কবলিত রুপালী ব্রম্মপুত্রের অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকনে। জোছনায় পূর্ণ যৌবনা নদীকুল। মানুষ ছুটে যায় নদীর বুকে চন্দ্র কিরনের আকি-বুকি, আল্পনার কারুকাজ দেখতে। শুধু মানুষ নয়, মাছেরাও চন্দ্রাহত হয়। ভরা পুড়ড়ণী নদ-নদীর গভীর তলদেশ থেকে জোছনা বিহারে ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়িয়ে পরে চন্দ্রাহত মাছেরা।
মন খারাপের পালা। সকালেই ফিরে আসতে হবে। শেষ বারের মতো তাই ব্রম্মপুত্র নদীর কাছে ছুটে যাওয়া। বিচ্ছেদের দু:খ বোধটা তখন থেকেই শুরু দু’জনের মধ্যে। কথোপকথনের স্বল্পতা। চোখ ছল ছল সময়-অসময়। রাতে কুহু ও’র ষ্ট্যাম্প অ্যালবাম থেকে বেশ কটি ষ্টাম্প আমাকে দিয়েছিলো। আর, ওর প্রিয় খেলার সামগ্রি থেকে মাঝারি সাইজের একটি ম্যাগনেটও আমাকে দিয়েছিলো। ভীষণ খুশী হয়েছিলাম ম্যাগনেটটি পেয়ে। কিন্তু আমি ও’কে কিছুই দিতে পারিনি শুধু আমার কাছে থাকা একটি পাজলবক্স দিতে পেরেছিলাম সেই মুহূর্তে। সকালে আবার ফিরে আসা ট্রেনে চড়েই। আবার ট্রেনের কামরায় ঝিক ঝিক ঝিক দূরে সবুজ গ্রামগুলোর বিপরীত দিকে ছুটে চলা। স্মৃতিরাও বুঝি ছুটে চলে ফেলে আসা অতীতের ভালোলাগার ঠিকানায়। কুহুর দেয়া ম্যাগনেটটা পকেট থেকে বের করে দেখতে ইচ্ছে করলো। মসৃন, শীতল ভালোবাসার উপাখ্যান যা শুধু লোহাকেই কাছে টেনে নেয় না, পরস্পরের হৃদয়কেও কাছে টেনে নেয়। হৃদয় হৃদয়কে স্পর্শ করে নেয়। সৃষ্টি হতে থাকে অনুভবের ‘ম্যাগনেটিক ফিল্ড’ যা কিনা শুধু কাছে টেনে নিতেই জানে।
বিদ্যুৎ সরকার : : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা