বিদ্যুৎ সরকার : ১. কিসের এতো তাড়া তোমার ঠিক এখুনি যেতে হবে? কে তোমাকে ডেকে নিয়ে গেলো অমন করে। কাউকে কিছু না বলেই তুমি ছুটে গেলে সেই অচেনা বেসুরো ডাকের সারা দিতে। ‘তুমি ডাক দিয়ে যাও কোন্ সকালে কেউ তা জানে না…’ তোমার এখনি যাওয়াটি কি খুবই প্রয়োজন ছিল? এখন তোমায় আমি কোথায় খুঁজবো, কোথায় গেলে তোমাকে খুঁজে পাবো আমি? একবারও কি ভেবে দেখেছিলে, না বলে তোমার চলে যাওয়াটা কতটা পীড়াদায়ক আমাদের জন্য, বিশেষ করে আমার জন্যে। আসলে সাত–পাঁচ এতো কিছু ভাববার ফুরসত কই তোমার? যেই না ডাক শুনলে অমনি ছুটলে চিতল হরিনের মতোন শব্দহীন চঞ্চল পায়ে। তুমি চলে গেলে আর, একটি শূন্যতার ক্ষতচিহ্ন রেখে গেলে সর্বত্র। যা অমুছনীয়, অপুরনীয় সময়ের ব্যবধানে। কী যে অক্ষত ক্ষত শুধু গভীর থেকে গভীরতর হোয়ে চিরস্মরণীয় ও চিরস্থায়ীভাবে থেকে যায় মনের গহীনে।

২. অনুপ চৌধুরী, সোনালী ব্যাংক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতার জন্য স্বল্প সময়ে পদোন্নতি ঘটেছে বার কয়েক বার। সেদিক দিয়ে সে একজন সুখী ব্যক্তি। আবার অন্যভাবে বললে সু² একটি রক্তক্ষরণের ধারা তার হৃদয়ের অলিন্দে বহমান। লোকটির বাহির দিক থেকে তা বুঝার উপায় নেই কিছুতেই। তিন বছরের বিবাহিত জীবনের সন্তান না থাকার বিষয়টি তাকে যতটা না বিব্রত করে এর ঢের বেশি মনের দিক থেকে তাকে অনেকটাই দীন, দরিদ্র করে তুলে। এ ক’বছরে স্ত্রীকে একটি সন্তান উপহার দিতে না পারার আক্ষেপ, দু:খ-বেদনা তাকেও ভীষণ ভাবায় সময় অসময়। কিন্তু তার প্রতি স্ত্রীর অনুপম ভালোবাসার কোন ঘাটতি নেই। অনুপও স্ত্রীকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে রাখে সারাক্ষণ। স্ত্রীর কোন আবদার নেই তবুও অনুপ নিজ থেকে এটা ওটা দিয়ে তাকে উৎফুল্ল রাখতে সচেষ্ট সারাবেলা। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও ভালো লাগার কমতি ছিলো না কারোরই। ছুটির দিনগুলোতে বাসার যাবতীয় ছোটো খাটো কাজ, বাজার হাট, ইচ্ছে হলে দু’জনের শপিং, কোথাও বেড়ানো একাজগুলো সেরে ফেলেন। শীতকালিন সব্জি আসতে শুরু করেছে বাজারে। প্রথম দিকের সব্জির স্বাদই আলাদা। চিত্রলেখার ভীষণ ভাললাগে বাজারে আসা নতুন ফুলকপি, নতুন আলু কইমাছ দিয়ে হাল্কা ঝোল রান্না করে খেতে। অনুপ, এ কথা মনে করে সকাল সকাল ব্র্যাকফাস্ট শেষ করে বাজার অভিমুখে ছুটে। শুধু চিত্রলেখার কথা বলি কেন, অনুপেরও অনেক পছন্দ যে।

৩. ওর নাম অনন্ত। আমরা ওকে আদর করে ডাকি অনু আর দুষ্ট বন্ধুরা ডাকে অণু-পরমাণু বলেই। কিছুদিন বাদেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা, কোচিং শেষে পায়ে হেঁটেই সাধারণত বাসায় ফিরে অণু। গুলশান এক নম্বর থেকে গুলশান দুই নম্বর গোল চক্করের খুব কাছেই তাদের বাসা। বড় ভাই অনুপ সোনালি ব্যাংক এক্সিকিউটিভ, তার বাসায় থেকেই এদ্দিন পড়া-শোনা করে আসছে। ইচ্ছে করেই এতোটা পথ হেঁটে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। রাস্তায় নানা রংগের মানুষ, নানা বর্ণের চলমান যানবাহন দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছে যায় অনু। তার অনুসন্ধানী চোখ তাকে এভাবে চলতে উৎসাহিত করে। সময় এবং সুযোগ পেলে এ কাজটি সে করবেই। গোল চক্করটার কাছে আসতেই দেখতে পেল একটি জটলা, আরো কাছে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছুতেই সম্পূর্ণভাবে দেখতে পেল না। শুধু এটুকুই বুঝা গেল একটি লোক উপুড় হোয়ে পড়ে আছে। মনে হয় লোকটি এক্সিডেন্টের শিকার। তার পর্যাপ্ত রক্ত ক্ষরণ হওয়ায় রক্তের ধারা অনেক দূর অব্দি ছড়িয়ে আছে। ভীরের মাঝ থেকে কেউ কেউ বলে উঠলো তারা নাকি দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে এ লোকটা যখন রাস্তা ক্রস করছিল তখন একটি দ্রুতগামী প্রাইভেট কার এসে হঠাৎ তাকে সজোরে আঘাত করে পালিয়ে যায়। অথচ, লোকটির কোন দোষ ছিল না। সে সিগনাল দেখেই ঠিকভাবে রাস্তা পার হচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি পুলিশের ভ্যান এসে রক্তাক্ত মৃতদেহটি তুলে নিল। তখনও লোকটির মুখ দেখা সম্ভব হয়নি অনুর পক্ষে। শুধু পড়নের রক্তমাখা কাপর চোপড়গুলো দেখা ছাড়া। হঠাৎ করে অনুপের মনে হলো লোকটার পড়নের সার্টের মতো ওর দাদারও এমন একটি সার্ট আছে। অনুপ উর্ধশ্বাসে হাঁটছে আর মনে মনে বলছে তার এ ভাবনা যেন মিথ্যে হয়। বাসায় ঢুকেই প্রথম দাদা বলে ডাকতে শুরু করলে বৌদি কিচেন থেকে উত্তরে জানাল, তোমার দাদাতো বাজারে গেছে সেই কখন, এখনো আসলো না! অনু আবারো জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলো দাদা কোন সার্ট গায়ে দিয়ে গেছে? উত্তরে বৌদি বললো, কেন সব সময় যে চেক চেক সার্ট গায়ে বাজারে যায় সেটাই। হঠাৎ বৌদি একটা চিৎকার শুনে ঘরের বাইরে এসে দেখে অনু মাটিতে পরে গড়াচ্ছে আর বির বির করে কি যেন বলছে। কাছে যেতেই আবারও অনু চিৎকার করে বলে উঠলো, দাদা এক্সিডেন্ট করেছে গোল চক্করের ওখানটায়। সেই অবস্থায় আবারো ছুটলো গোল চক্করের দিকে। কাছে আসতেই বৌদি বলে উঠলো, ঐ যে তোমার দাদার পায়ের সেন্ডেল পড়ে আছে রক্তের মধ্যে। আরো দেখা গেল ছরানো-ছিটান কতগুলো নতুন আলু, একটি ফুলকপি ও রক্তমাখা কই মাছ। কয়েকটি তখনো কানকায় ভর করে এদিক ওদিক চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। স্পটটি হলুদ রিবন দিয়ে ঘেরা। দু’জনে পাশের ফুটপাতে বসে অঝোর কাঁদছিল। ওরা জানে না ওরা কোথায় যাবে! ওদের নতুন আবাসনের ঠিকানা কোনটা? ওদের চোখের স্বপ্নগুলো কত সহজেই না মুছে গেল চোখের তরল জলের সরল ধারায়। স্বপ্নগুলো এত ঠুনকো কেন, একটু জলজ ছোঁয়ায় হারিয়ে যায় সাগরের নোনা জলে। আজ থেকে ওদের কোন স্বপ্ন নেই। ওরাও ভুলে যাবে ওদের স্বপ্ন দেখার দু’চোখের কথা।

‘আমার স্বপ্ন দেখার দু’টি নয়ন হারিয়ে গেল কবে কখন কেউ তা জানে না……….’

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা