বিদ্যুৎ সরকার : ও’র চলে যাবার সমস্ত আয়োজন শেষ। এখন শুধু বাকী কয়েক ঘন্টা, কয়েক মিনিট, আর কিছু চোখের পলক। অতপর এস্কেলেটরে চেপে সরাসরি সেভেন ও সেভেন উড়োজাহাজের দোরগোড়ায়। এবারই তার প্রথম আকাশযানে আরোহন। স্বভাবতই ও’র কাছে একটা বিরাট থ্রিল, এডভেঞ্চার। ভিতরের স্বপ্নময় একটি পরিবেশ তার ভাবনাকে কতটা স্বপ্নীল করে তুলবে তা সহজেই অনুমেয়। নিশ্চয় আমার বেলায়ও এমনটি হয়েছিল। ফরাসি এয়ারফ্রেসনারের মিষ্টি সুবাস, ভিনদেশী গানের সুর বাজে লো ভলিউমে, স্বল্প আলোয় কেমন রোমান্টিক করে তুলে আগত সবাইকে সে তো সবারই জানা। সেও তো তেমনি অনুভব করবে তাই নয় কি? তা হলে সেও কি সবি ভুলে যাবে সকাল বিকেলের খুনসুটি, কাছে আসার তাগিদ, দূরে জাওয়ার অভিমান।
সব কিছুর সাথেইতো আমার আমিত্ব জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। সমস্ত কিছুই কি এক নতুন সূর্যোদয়ে, মেঘ ভাংগা রোদে ঝলসে যাবে অবলিলায়? প্রতিদিনের ও’র – আমার চাওয়া পাওয়ার আয়োজন। সুখের সন্ধানে দখিনা বাতাসের সবিনয় আমন্ত্রণ। সাত সকালের শুভ সম্ভাষণ এক দৃষ্টি নন্দন অমোঘ হাসির বিনিময়ে। দেয়া-নেয়ার এক উজ্জ্বল ধারাপাতের পাতায় পাতায় একটি নতুন সকালের শুভ মহরত। দিনভর কতো না বলা কথার আলাপন। ভালো লাগার যত কথোপকথন চোখের ইশারায়, তারায় তারায়। কী আছে ও’র শান্ত দু’টি চোখের আংগিনায়? কাজল কালো চকচকে মার্বেলের মতো দুটি চোখের সীমানার অসিমে? ওখানটায় তো হারিয়ে যেতে মন চায় বার বার হাজারো বার! কাঠাল চাপার মতো সরু সরু আংগুলো ছুঁয়ে দিলাম শেষ বারের মত। ওর বরফ শীতল গালে আদরের চিহ্নটুকু এঁকে দিয়ে দিলাম সযতনে। কি মনে করে সে তাকিয়ে থাকলো পলকহীন চোখে হাজারো জিজ্ঞাসা নিয়ে এক শব্দহীন অনুভবে। একটু বাদেই ও উঠে যাবে আকাশের ঠিকানায় মেঘেদের কোলে মেঘ বালিকা হয়ে। শুধু শেষ চিহ্নটুকু রেখে যাবে মনের ভেতর একবুক অভিমান আর অভিযোগ। আরো কিছুটা সময়, আর নাহয় ক’টা দিন থেকে যেতে পারতো বুকের কাছাকাছি, হৃদয়ের গহীনে। আমার না বলা কথাগুলো কেমন করে ও কে জানাবো? আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে ঠিক ঠিক পৌঁছে যাবে তো আকাশের বুক ছুঁয়ে মেঘের কোলে ওর কাছেই? বিচ্ছিন্নতায় রক্ত ক্ষরণ হয় হৃদয়ের অলিন্দে – সুখের আমার অসুখ করেছে বড় অবেলায়। এখানে এখন হেমন্ত। গাছেদের দেহ-মন চাংগা, পাতায় পাতায় রঙের অনুপম ছোঁয়া। রংগীন সাজের রংমশাল। মনের রং বিবর্ন হয়ে যায় কোন এক বিরহ ব্যথায়। এক সময় গাছের পাতারও ঝরে পড়বে মৃত্তিকার টানে। যেমন সেও চলে গেল হৃদয়ের নিগুঢ় টানে। আমি একা হয়ে গেলাম, ভীষণ একা। কোথাও কেউ নেই। শুধুই শূন্যতায় ভরে আছে প্রতিটি গৃহকোণ, আমার বিবাগী মন। সে নেই ও’র স্পর্শ রয়ে গেছে, শরীরের সুঘ্রাণ। সর্বত্র ও’র ছায়ারা। ছায়ার শরীর ছুঁয়ে দেখলে কতটা অনুভূত হবে প্রাণ কে জানে! ও’র নাম গুন গুন। আদর করে আমি ডাকি ‘মুনিয়া পাখি’। ডাকলে ও সারা দেয় চোখের এক মায়াবী ভাষায়। আজই ও চলে গেল তার অন্য এক ভাললাগার ঠিকানায় আরেক ভালোবাসার হাতছানিতে।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা