বিদ্যুৎ সরকার : ওর নাম শমসের। আমরা ডাকতাম শমু বলেই। শমু উচ্চারণটার মধ্যে লুকিয়ে আছে ভালবাসা। স্নেহ লতায় জড়িয়ে থাকা শমু সবার কাছে কেমন করে এতটা প্রিয় হয়ে গেল কখনো সে তা বুঝে উঠতে পারেনি। শুধু, আমিই প্রতিনিয়ত দেখে যাচ্ছিলাম ওর ক্রমবর্ধমান বন্ধুপ্রিয়তার উর্দ্ধরেখাটি। মাঝে মাঝে রাগ হতো, নিজের সাথে নিজে অভিমান করে চুপচাপ বসে থাকতাম পড়ার ঘরে। কিন্তু, যখনই শমু এসে আমার পিঠে ওর হাত রাখতো আমি সব ভুলে গিয়ে পিছন ফিরে না হেসে পারতাম না। ওর স্পর্শে যেন একটি শীতল জলরেখার শান্ত অনুভ‚তি আপ্লæত করে দিতো আমাকে। তখনই বুঝে নিতাম শমুর স্পর্শ, মধুর করে ডাকার ঐন্ধ্রজালিক আবেশ সবাইকে কেমন করে আবিষ্ট করে দেয় সহজেই। কেন জানি আমার ভেতর থেকে একটি দুষ্টু শক্তি আমাকে অভিমানী করে তুলতো শমুর প্রতি ভালোবাসায়। কেন জানি কাউকে ওর ভালোবাসায় অংশীদারী করতে আমার কষ্ট হতো। আমার অস্থির ভাবনার একমাত্র স্থির বিষয়টি ‘শমু-ভালোবাসা’। আর, বাকী সব বন্ধুত্বের সচল নেটওয়ার্ক বিলুপ্ত হয়ে পড়ুক এ মুহূর্তে। মানবিক রসায়নের আরো একটি জটিল সমীকরণের সূচনা হোক এখন থেকেই। রক্তের গভীরের মাঝে থাকা এক আকুতি দিগন্ত ছুঁয়ে যাক নিমিষেই। শুধু আমার ভালোবাসায়, আমার আন্তরিকতায় সমুদেধর গভীরতা মাখা তার চোখ দুটি দ্যুতিময় হয়ে উঠুক। আমার দুচোখ শমুর চোখে প্রতিস্থাপন করে বেহিসেবীর মতো সুখ কুড়িয়ে নিতে চাই দু’হাত ভরে। জানি, দুঃখী দুঃখী মুখ করে অন্য বন্ধু সকল আহত হয়ে নির্বাক, নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখবে আমার একান্ত ভাললাগার প্রতি। একটি সহজ-সরল, নিয়মতান্ত্রিক সাধারণকে স্বমহিমায় কী অসাধারণ পর্যায়ে উন্নীত করে নিতে চেয়েছি বার বার। আমি একান্তই অন্তর্গত করে হৃদয়ের চার দেয়ালে তাকে বন্দী করে রাখতে চাইতাম। এক অদৃশ্যমান ভাললাগার “ম্যাগনেটিক ফিল্ড”-এর আবেশ তাড়িত হয়ে সমান্তরাল গতিতে তরঙ্গায়িত চলনে আমার ইচ্ছে পূরণে আমি নিমগ্ন থাকতাম প্রতিটি ক্ষণ। আমার এ সকল মূল্যবান প্রহর আমার জন্য নিয়ে আসতো এক অনাবিল সুখের পরশ। সেই শমুটাই এখন আমার কোন কিছুতেই নেই। আমার শ্যামল বাংলাদেশ, লাল-সবুজের বাংলাদেশ, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহবাগের যাদুঘর, পিয়ারসন্স বিমানবন্দর, টরন্টোর বাংলা টাউন, ড্যানফোর্থের ঘরোয়া রেস্তোরাঁ- কোথাও ওকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ওর পড়ার ঘর, সেখানে সবকিছুই তেমনটি আছে, র্যাকে সাজানো মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’, জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র, হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’, দেয়ালে ঠেস্ দেয়া ক্রিকেট ব্যাট, আলমারিতে সাজানো মেডেল, কাপ ও একটি ফ্রেমে বাঁধানো সাদা-কালো গ্রæপ ছবি। আমাদের স্কুলে শেষ দিনের বিদায়ের ছবি- শুধু এ সকল জড় বস্তুতে ওকে একটু আধটু খুঁজে পাওয়া যায়। আর, বাবা-মায়ের দীর্ঘ শ্বাসের মধ্যে বেঁচে ছিলো কিছু দিন।
শমুর সাথে শেষ দেখা ত্রিপুরার আগড়তলা বিমানবন্দরে সম্ভবত: ৭১’এর এপ্রিলের শেষ দিকে হবে। শমু দেরাদুন যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিতে। কথা ছিল এক সাথেই মুক্তিযুদ্ধে যাবো কিন্তু যাওয়া হলো না। আমি ওর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম সেদিনেই। ওর আকাশের মতোন উদার, উদাস চোখ দুটি কেমন করে সহসা গাঢ় মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো সেদিন। আমার দিকে তাকিয়েছিলো যতক্ষণ আমাকে সে দেখতে পাচ্ছিলো। আমি ওর চোখ দুটোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। আমার চোখের জল দেখলে সে দৃশ্যটুকুই সে ধরে রাখতে চাইবে আমাকে না দেখা বাকী দিনগুলোতে- এ ভয়ে। আমি শমুকে দেখছিলাম আর ওর পায়ের শেওলা রংঙের “জংগল বুট” দেখছিলাম। শমু জংগল বুট পড়ে গেড়িলা টেধনিং নিতে যাচ্ছে, যুদ্ধে লড়বে, দেশ স্বাধীন করবে।
আমি ওর অপেক্ষায় ছিলাম যুদ্ধোত্তর একটি বছর। কিন্তু শমু আর ফিরে আসেনি। শমু আমার হৃদয়ের যাদুঘরে ফ্রেমে বাঁধানো একটি স্মৃতির “কোলাজ”। যেখানে শত শত “শমু- স্মৃতি” জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে থাকবে চিরকাল, চিরদিন।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা