বিদ্যুৎ সরকার : বন-জংগলের আগাছা, গুল্ম-লতার মতো বেড়ে উঠা বহ্নির। নামের সাথে এর যথার্থতা খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। তবুও ওকে বহ্নি বলেই ডাকে সবাই। বক্সনগর গ্রামের হারান মিস্ত্রীর দুই কন্যা সন্তানের দ্বিতীয়টির নামই বহ্নি। প্রথম কন্যার বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় বছর তিনেক হলো। হারান মিস্ত্রির এতোদিনের জমানো সিংহভাগ টাকাই কন্যার বিয়েতে খরচ করতে হয়েছে। হবু বরের একটি দাবি ছিল বিদেশি রেলি সাইকেল। সে দাবিটুকু মেটাতে গিয়ে হারান মিস্ত্রীর মাথার ঘাম ঝরাতে হয়েছিল এন্তার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসারে কত টাকাইবা জমানো সম্ভব!

প্রতিদিনের উপার্জনের কিছুটা অংশ গোপনে জমিয়ে রাখতো হারান। সবটাই মেয়ে দু’টির বিয়ের কথা চিন্তা করেই হয়তো। বর এক সরকারি অফিসের লোয়ার ডিভিশনের ক্লার্ক, পারমানেন্ট চাকরি। তাই কন্যার চিরস্থায়ী সুখের কথা চিন্তা করেই হারান এক অসাধ্য সাধন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েছিল সজ্ঞানেই। তবুও পাহাড় প্রমাণ মনবল আর ঐকান্তিক কায়িকশ্রমের জোরেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে যখন-তখন। একচালা টিনের ঘরের একটু ছায়ায় তার প্রাণ জুড়োয়, মন শীতল হয়। তার চাওয়া-পাওয়ার পরিধি খুবি সীমিত। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে পারলেই হাতের নাগালে তার স্বর্গ এসে হাজির। মাঝে মাঝে আত্মগøানিতে সে বেশখানিকটা চুপসে যায়। বড় মেয়েটাকে তার অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে পাত্রস্থ করতে হয়েছে বলে। টানাপোড়েনের সংসারে মেয়ের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা খুবই কঠিন ছিলো তার জন্যে। এ উপলবদ্ধি তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে কখনো কখনো। বেদনার জল চোখের কনায় জমে থাকে। রাতের মস্ত আকাশের নিচে নিজেকে তখন ভীষণ একাকী মনে হয়। তবুও স্বপ্ন দেখে একদিন বহ্নি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশ সেবায় নিজকে নিয়োজিত করবে।

২.
বক্সনগর থেকে কলাকুপা-বান্দুরা অব্দি নদীর দু’পাড় জুড়ে খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা। মাঝে মধ্যে দু’একটি অন্য স¤প্রদায় জনগোষ্ঠীর বসবাস। দু’পাড়ের মাঝ দিয়ে বহমান ইছামতী নদী। শীত মৌসুমে যার জল শুকিয়ে মৃতপ্রায় নদীতে রূপান্তরিত হয়।
হাঁটু জল বুকে নিয়ে ধুকে ধুকে টিকে থাকে সুদূরের পিয়াসী হয়ে। বর্ষায় এ নদীই হয়ে উঠে দুর্বার দুর্গম। এ সময় নদী পারাপার খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। খরস্রোতা ইছামতী নদীর দু’পার ভাংগনের মুখে প্রতি বছর বাড়ি-ঘর, ভিটে-মাটি হারায় ওখানে বসবাসরত অনেকেই। হারানেরও এমন ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে বার কয়েক। হারান কিছুতেই হটবার নয়। ভাংগবেতো মচকাবে না কোন অবস্থাতেই। ইদানিং এ পাড় দিয়ে পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে বান্দুরা অব্দি। স্বভাবতই রাস্তার কারণে পাড় যতটা সম্ভব নদী ভাংগনের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। অথচ এক সময় বার মাসই এ অঞ্চলের জনগণের প্রধান মাধ্যমই ছিল লঞ্চ ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা। আর এখন ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে বান্দুরা দু’ঘন্টায়। অথচ আগে নৌকা বা লঞ্চে বক্সনগর আসতেই লাগতো তিন থেকে চার ঘন্টা। অবশ্য নৌ-পথে বারতি পাওয়া ছিল নদী মাতৃক বাংলার অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্যসমূহ। ইছামতীর দু’পাড়ের মনকাড়া মনোরম দৃশ্য। সবুজ বনরাজির মাঝে শ্বেত-শুভ্র বাতাসে দোল খাওয়া কাশবন, চোখ জুড়ানো রং-বেরঙের পালতোলা নৌকার অপরূপ মিছিল। ইছামতীর দু’পাড়ের বসতিদের যাপিত জীবনের চালচিত্র অনেকটাই দৃশ্যমান হতো জল পথের ভ্রমণে। কাশফুল ফোটার সময় এলে হারানের পরানে দোল খায়। চারদিকে সাজ সাজ রব, পূজা আসছে, দুর্গা পূজা। ঢাক বাজবে, বসবে মেলা, তার হাতের তৈরি কাঠের নানান আসবাব, গৃহস্থালি রকমারি উপকরণ বেঁচা হবে দেদারসে ঐ মেলাতে। কেনা হবে বৌয়ের নতুন শাড়ি, বহ্নির রংগিন জামা, নতুন স্কুল বেগ আরো কত কি! বছরের সেরা বেঁচা-কেনা বিভিন্ন পূজা-পার্বণই হয়ে থাকে সাধারণত।

৩.
পরান বেঁচে থাকলে হারানের বেঁচে থাকাটা আরো সার্থক হতো। ’৭১ এ ঢাকায় ক্রেক ডাউনের পরপরই অনুমান করে নিতে ভুল করেনি হারান। অচিরেই সমস্ত বাংলাদেশে এ হত্যাকান্ড ছরিয়ে পড়বে। তাই আর দেরি না করে হারান মিস্ত্রী সপরিবারে ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করে দেয়। যে যাত্রার যেমন কোন অতীত ছিল না, ভবিষ্যতও জানা ছিলো না তার। শুধু বাঁচার তাগিদেই এমন করে নিরুদ্দেশ হওয়া। একসময় ত্রিপুরার মেলাঘরে এসে ঠাই করে নেয় উদবাস্তু শিবিরে। ক্যাম্পের ভেতরে শুয়ে শুয়ে রাতের প্রহর গুনে আর ফেলে আসা নিজ বাড়ি, ইছামতীর তীর ভাংগা ঢেউ, শরতের মেঘ, সাদা কাশ ফুলের স্মৃতি হাতরিয়ে বেড়ায়। সে জানে না কবে, কখন, কেমন করে আবার নিজ ভিটে মাটিতে ফিরে যাবে। এ এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় তার কাছে। পরান তার একমাত্র অনুজ, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ক্যাম্প থেকে একদিন চলে গেল মুক্তিযুদ্ধে। সে খবর তারই এক বন্ধু এসে জানিয়ে ছিল হারানকে। সে যুদ্ধে যাবে তা বলার অপেক্ষায় থাকবে না নিশ্চয়ই! ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়….।’ একদিন যুদ্ধ শেষ হলো কিন্তু, পরান আর ফিরে এলোনা কোন দিন। আজ পরান বেঁচে থাকলে পড়া শেষে চাকরি করে পাশে এসে দাঁড়াতো, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত হারানের প্রতি। তখন ছোট ছোট স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে হারানের এতো বেগ পেতে হতো না। যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো, হারান আবার নিজ ভিটেয় ফিরে এল। নতুন করে ঘর বানালো, ছোট ছোট স্বপ্ন বুনতে সচেষ্ট হলো।

৪.
‘বহ্নি’ নামটি তার পরান কাকারই দেয়া। সময়ের সাথে সাথে তার শিখার উত্তাপ ছড়াচ্ছিল বুঝি। পরান বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এ উষ্ণতায় উজ্জীবিত হতো। লেখা-পড়ায় ভালো থাকায় কোন শ্রেণীতেই বাবা-মা’কে একটি কপর্দ খরচ করতে হয়নি বহ্নির জন্যে। বরঞ্চ বহ্নি বাবার পাশে থেকে টিউশনি করে সংসারের জন্য সহায়তার ছাপ রেখে যেতো নিজ থেকেই। মফস্বল শহরগুলোতে এখনও মেয়েদেরকে এমন কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিক‚লতার সম্মুখিন হতে হয়। বহ্নির বেলায়ও তেমনটি ঘটেছিল।

নিজের লেখা-পড়া শেষ করে যতটুকু সময় পায় মাকে গৃহস্থালী বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে। বিকেলে দুটি টিউশনি করে বহ্নি, দুটি মেয়েকে পড়ায়। বাড়ির খুব কাছে হওয়াতে হেঁটেই চলে যেতে পারে সে। দুটো মেয়েই নবম শ্রেণীর ছাত্রী। এদের একজন এ গ্রামের এক মাতব্বরের। মেয়েটার পড়াশোনায় ভীষণ আগ্রহ থাকায় এবং তার বাবার একান্ত পীড়াপীড়ির দরুন টিউশনিটি তাকে নিতেই হলো শেষ অব্দি। মেয়ে দুটোই ভাল ফল করে দশম শ্রেণীতে প্রোমোশন নিয়েছে। বলতে গেলে প্রায় সব প্রশংসা বহ্নিরই প্রাপ্য। রেজাল্টের পর মাতব্বরের বাসায় এলে তার মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল বহ্নির জন্য মিষ্টি আনতে। এর মধ্যে মাতব্বর জিল্লুর কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল জানতে পারেনি। হঠাৎ তার ঘারের কাছে হাতের আংগুলের স্পর্শ অনুভব করলো, স্পর্শ ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছিল। হাসতে হাসতে জানালো মেয়ের ভাল রেজাল্ট করায় আগামী মাস থেকে বহ্নির বেতন আরো দু’শো বাড়িয়ে দেয়া হলো। বহ্নি আচমকা মুখ ঘুরিয়ে তার চোখে চোখ রাখলো, তার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বের হবার উপক্রম। মাতব্বর সেই মুহূর্তে ওখান থেকে পালিয়ে গেল। মেয়ে প্লেট ভর্তি মিষ্টি এনে রাখতেই বহ্নি উঠে দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে বের হতে হতে জানিয়ে দিল সে আর তাকে পড়াতে আসবে না। একটি প্রতিশোধের আগুন তার সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ছিল ক্রমশ।

৫.
পড়াশোনা শেষে বিসিএস কোয়ালিফাই করে ক্যাডার সার্ভিসের প্রশাসন বিভাগে যথেষ্ঠ সম্মানের সাথে কাজ করে যাচ্ছে বহ্নি। জনগণের প্রাপ্য সেবা দেয়াই তার মূল লক্ষ্য। তার সুষ্ঠু কর্ম পরিচালনায় প্রতিটি স্থানে আইন-শৃঙ্খলার বিশেষ উন্নতি সাধনের জন্য সুনাম কুড়িয়েছে সে। এক সময় নিজের আগ্রহেই তার নিজ উপজেলা নবাবগঞ্জে ট্রান্সফার নিয়ে আসে। ভীষণ ইচ্ছে এ উপজেলার সমূহ উন্নয়নের মাধ্যমে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা, আইন-শৃঙ্খলা বাস উপযোগি করে জনগণের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা। যেই বলা সেই কাজ, কিছু দিনের মধ্যেই নবাবগঞ্জবাসী এর সুফল পেতে শুরু করেছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মাদকসহ নারী নির্যাতনের মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রশাসনের কাজের তদারকি করে থাকে।

৬.
বছর না ঘুরতেই হঠাৎ একদিন এক বৃদ্ধ তার বিবাহিতা কন্যাকে সাথে করে তার কাছে আসে বিচারের আরজি নিয়ে। এ বিবাহিত মেয়েটিকে তার এলাকার এক দুঃশ্চরিত্রের লোক রাতের অন্ধকারে ভাগিয়ে নিয়ে চরিত্র হরন করে। বৃদ্ধের সাথে থাকা মেয়েটি হাউমাউ করে জন সম্মুখে কেঁদে ফেললো। উপস্থিত অনেকেই সেই অপরাধি লোকটি সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে যাচ্ছিল। বহ্নি সবকিছু শুনে সাথে সাথেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপজেলা প্রধানকে নির্দেশ দিলেন শীঘ্রই তাকে বন্দী করে আনতে। পরদিন কথিত অপরাধিকে ধরে নিয়ে হাজির পুলিশ কর্মী। বহ্নির পায়ের কাছে হাতজোর করে লুটিয়ে পড়ে সে। শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রæমন্ডিত লোকের চুল ধরে টেনে তুলতেই বহ্নি চমকে যায় তার কপালের কাটা দাগটি দেখে। তবুও শিউর হওয়ার জন্য বার কয়েক দেখে ঘৃণায় চোখ ফিরায়। এ সেই ঘৃণ্য অপরাধি যে তার পিঠে খারাপ উদ্দেশ্যে নিয়ে হাত রেখে ছিল। প্রতিক্ষিত হৃদয়ে দাবানল, বহ্নি শিখার তাপদাহে তাকে পুড়িয়ে দিতে মন চাইলো। বদমাশ মাতব্বর আদৌও তাকে চিনতে পারলো কি না সে দিকে ভ্রæক্ষেপ না করে রিমান্ডে পাঠিয়ে দিয়ে বাদী পক্ষকে বললো মহিলা অধিদপ্তরে আরো একটি মামলা রুজু করতে।

নিজের বিবেকের কাছে নিজেই বুঝি দায়বদ্ধ ছিল এতোদিন। তার কিছুটা তো লাঘব হলো! বহ্নির চোখের কোন্ চিক চিক করে উঠলো আনন্দ অশ্রুতে। এতো দিনের এ কঠিন পথ চলার অর্থ খুঁজে পেল বহ্নি। বহ্নি শিখা নামের যথার্থতা, যা কিনা লুকিয়ে ছিল মনের অলিন্দে। একটি হিরন্ময় সকাল কতোটা আলোকিত করে দিল রাতের সমস্ত অন্ধকারকে ঘুচিয়ে দিয়ে।

বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা