বিদ্যুৎ সরকার : জানালা খুলে আকাশ দেখলে আমার গ্রামের আকাশের কথা মনে পড়ে পৌষ মেলায় কতশত লাল, নীল ঘুড়ির উড়ান। কখনো যদি লেকের ধারে যাই আমার মেঘনার কথা মনে পড়ে মাছ ধরার ছোট্ট ডিঙ্গী আর পাল তোলা নৌকার মিছিল। টেইলর পার্কের গাছ-গাছালী দেখে কেন জানি দূরের গ্রামের দৃশ্যের কথা ভাবি। সদ্য বানানো ঘরের চালে রোদের ঝিলিক আর মাইল মাইল অন্তবিহীন সবুজ শস্যক্ষেত। মেটেধা রেলে কিপলিং যেতে যেতে কেন জানি ঢাকা কুমিল্লা ট্রেন ভ্রমণের কথা মনে পড়ে যায় আমার … সেই ঝিক ঝিক শব্দ, ভৈরব ব্রীজ, নিচে বধহ্মপুত্র আর দু’ধারে দোল খাওয়া সবুজ ল্যান্ডসস্কেপ। শীতের সকালগুলোতে গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে যায় পিঠা বানানো আর নবান্ন উৎসব। গেল বর্ষায় দেশে গ্রামে ছিলাম। কী দারুণ সকাল, দুপুর রাত্রি। সেই ছেলেবেলা থেকে এখানে চলে আসা অব্দি ভাল লাগার সবগুলো সময় কেমন ফ্যাসব্যাক হয়ে আসতে থাকলো। আমি দেহ-মন দিয়ে অনুভব করছিলাম অন্তহীন সুখের সেই পরশ। এক বিকেলে বৃষ্টি হচ্ছিলো। সেই আগের মতোই ভেজা মাটির সোদা গন্ধ, টিনের চালে অবিরাম রিম্ ঝিম্ পুকুরের জলে টুপ টুপ বৃষ্টি পড়া- অনেকদিন পর কী যে এক ভালো লাগা। এখানে চলে এলে এসব কিছু আমার ভাবনায় ভীড় করে থাকে অহর্নিশ। আমি কিছুতেই দূরে ঠেলে দিতে পারি না। এখানেও তো দূরের গ্রাম আছে, সবুজ প্রান্তর আছে, আছে বৃষ্টি, নদী, পাহাড়- তবুও কেন অবুঝের মতোন সেই সবুজে যেতে চাই, বৃষ্টি, পাহাড়, সেই শব্দ। পৌষ সংক্রন্তির পিঠার উষ্ণ গরম ভাললাগা চাই?
শেকড়ের টান, মাটির ভালোবাসা সারাটা সময় আমাকে আগলে রাখে আমার ভাবনাকে, স্বপ্নকে পথ চলতে। তবু কেন আমি এ দূর প্রান্তে চলে এসেছি সবকিছু ছিন্ন করে, সব ভাললাগাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। কী স্বপ্ন দেখতে বাকী, কী ভাললাগা পেতে বাকী, কী সুখে সুখী হতে চাই, কোন্ না পাওয়ার বেদনা মুছে দিতে চাই- তবু কেন একটি মুহূর্তের জন্যও এখানে অপেক্ষা করা, সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে সুখের স্বর্গরাজ্য আমার হবে বলে মিছে আশায় কর্মহীন, পারস্পারিক হৃদ্ধতাহীন সীমাহীন টানাপোড়েন চোখে মুখে সহ্য করা। সামাজিক নিরাপত্তা আমাকে কতটা স্বাচ্ছন্দে বাঁচিয়ে রাখবে, এমন স্বাস্থ্যসেবা আমাকে কতদিন দীর্ঘজীবী করে রাখবে? যদি আমি মনোদৈহিক কষ্টগুলো থেকে কোনভাবেই নিজকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারছি। আমি চলে যেতে চাই। চলেই যাবো যাবো, সব ¯স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়ে, সব অনাকাঙ্খিত সুখকে দু’পায়ে মাড়িয়ে আমি আমার সবুজেই ফিরে যাবো। আমার আকাশের নীল সামিয়ানায় আচ্ছাদিত হবো। বৃষ্টির সোদা ঘ্রাণ বুক ভরে নেবো, আমার ষোল কোটির জনতার বন্ধনে আবার আবদ্ধ হবো। তাদের দু:খ-কষ্ট, সুখ-আনন্দে আমি সামিল হবো। আমি আমার রুবীদির কাছে ফিরে যাবো, শীতের দুপুরে রোদের গালিচায় হেলান দিয়ে চালতার আচারের স্বাদ- আহ্লাদ, লাটিমের সবটুকু শিহরণ আমার দু’হাত ভরে নেব। নন্দী গ্রামের নৌকা বাইচে দাড় টানার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কান পেতে শুনবো। চেনা চেনা সব সুখ আমার একান্তভাবে আমার, সব দু:খ তাও আমার। আমার সকল ভাললাগা, ভালোবাসা সযতনে লালন করবো আমি। আমার মৃতপ্রায় বৃক্ষটিকে আবার সজীব করে তুলবো। মোহময় মমতায়। মমতাময়ী এক নতুন সকালে আমি জেগে উঠবো ¯স্বপ্নহীন।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা